সুমনা পাল ভট্টাচার্য্য



এই মাঘেই বিয়ে হয়েছে মল্লিকার। বছর দেড়েকের প্রেম আর তারপর পরিণয়। ছোট থেকেই সব উৎসবের মধ্যে এই দোল-উৎসব তার সবথেকে প্রিয়। রঙ বড্ড টানে মলি কে। মুঠোয় ভরে ভরে আবীর নিয়ে খেলে সে। এবারের দোলের অপেক্ষা মলির কাছে বড় বিশেষ। নিজের প্রিয়জনের হাতে, সোহাগে, আদরে রঙে মাখামাখি হবে সে। এক অদ্ভুত পুলক মলির চোখে-মুখে। ভাবলেই,  শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ে আবেগ ঘন মুহুর্তের কথা।  কত ছবিই যে সে সাজিয়েছে তার মন জুড়ে...

*

অনিন্দ্য মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির পি.আর.ও। খুব ভাল কথা বলতে পারে ও। এই কথাই যেন টেনেছিল মল্লিকা কে, যেদিন রাত দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ বাইপাশের শুনশান রাস্তায় ওর ট্যাক্সিটা খারাপ হয়ে গেছিল, সেদিন ভয়ে তো হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া মল্লিকার সামনে অনিন্দ্যই তার গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে এসেছিল।  এগিয়ে এসে বলেছিল, " ট্যাক্সিওয়ালা কে বিশ্বাস করার থেকে আমায় বিশ্বাস করা ভাল, - কারণ গুলি যেতে যেতে বলি? " অচেনা, অজানা, ইয়ং,  হ্যান্ডসাম ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে মল্লিকার অবিশ্বাস, সন্দেহ কিছুই হয়নি, বড্ড ভাল লেগেছিল।  সেই প্রথম আলাপ।

ভাবতে ভাবতে আনমনে আলমারিটা খুলে নতুন শাড়িগুলো দেখছে মলি।   শাড়িগুলোর মসৃণ গায়ে বার বার ছুঁয়ে নেয় আঙুলের ডগা।  কত রঙ বে রঙের শাড়ি ।  নীলেরই কত শেড।  হলুদ ! সেতো সাক্ষাত বসন্ত।  এইতো ফিকে হলুদ শাড়িটা সেদিন পড়ে সামনে যেতেই,  এমন হ্যাংলামি করছিল অনিন্দ্য ... একদম যা - তা - লোকজন মানে না, উহু কিচ্ছু না।

ঠোঁটে আলতো কামড় দিয়ে মনে মনে বলল, ভাগ্যিস মানে না! ভাবতে ভাবতে আলমারিটা বন্ধ করে বিছানায় শরীর বিছিয়ে দুটি নিটোল পা ক্রমাগত: আগুপিছু করে দোলাতে দোলাতে, খুব আদুরে আঙুলে, চোখে চকচকে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে ঝট্  করে মোবাইলে মেসেজ টাইপ করল মলি- " মিসিং ইউ অনি"..

মেসেজের রিপ্লাই এলো না! এলোমেলো হয়ে আসা শরীরে কখনো শুয়ে কখনো ঢেউ খেলা বুকে ঝুকে পরা ছোট্ট মালায় আঙুল জড়িয়ে আঙুল ঘুড়িয়ে গুনগুন করে আনমনে।  এখনো কোন রিপ্লাই এলো না।  কি হল! মিটিং এ থাকলেও অনিন্দ্য একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেয় অন্তত:... মিনিট কুড়ি কেটে গেল, একটু অস্থির লাগছে এবার মল্লিকার।

*

বিয়ের পর এই তিন-কামরার সাজানো ঝকঝকে ফ্ল্যাটে মল্লিকা আর অনিন্দ্যর সংসার।  দরজার নেমপ্লেটে লেখা - "ভালবাসা"।  এটা ওদের দুজনেরই ঠিক করা নাম, কতো যে প্ল্যানিং।  বারান্দার ডানদিক ঘেঁসে ওই বোগেনভেলিয়া গাছটা থেকে শুরু করে বাথরুমের আয়নার শেপ কেমন হবে, বসার ঘরের দেওয়ালে ঠিক কি ছবি, কার্পেটটার ঠিক কি রঙ, ডাইনিং এর পর্দা, এতো খুঁটিনাটি নিয়ে গড়া তাদের "ভালবাসা"। অনিন্দ্যর বাবা মা থাকেন দিল্লীতে।  অনিন্দ্য প্রবাসী বাঙালি। মল্লিকার বাবা নেই।  মা, দাদা, বৌদি সব ঐ কলেজ স্ট্রিটের আদি বাড়িতেই। তাই বালিগঞ্জ প্লেসের এই "ভালবাসা"য়  শুক-সারী এই অনিন্দ্য-মল্লিকা।

মেসেজ,  ফোন কিছুই এলো না তো এখনও!!  হোলো কি!! ভাবতে ভাবতে আবার মেসেজ করল মল্লিকা," কি হল? কোথায়?" এইবারও নিরুত্তর।  ঘড়িতে প্রায় ১১টা।  না, এতো দেরী করে না তো অনিন্দ্য।  কাজের চাও বেড়ে গেলেও বারবার ফোন করে।  ভীষণ ভয় করছে এবার মল্লিকার।  হাঁটু দুটো বুকের কাছে টেনে এনে,  বারমুডার পকেট থেকে মোবাইলটাকে বের করে টেবিলের উপরে রাখল মলি।  খুব কান্না পাচ্ছে.. কি করবে মেসেজ রিসিভড এর কনফার্মেশন আসছে না, ফোন যাচ্ছে না, কল ডিসকানেক্টেড হয়ে যাচ্ছে। কি সব আবোল-তাবোল চিন্তা যে আসছে এবার মাথায়, কি করবে মলি! মা কে ফোন করবে? দাদা কে জানাবে? অনির বন্ধু নীলাভ কে ফোন করবে? উফ্ আর পারছে না, মলি..

*

বাইরে কি হই হই হচ্ছে - ন্যাড়া-পোড়ানো হচ্ছে - হুল্লোড়,  গান- মারোয়াড়ী বউগুলো কি সেজেছে, সবাই মিলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পূজো করছে। মলির চোখ ঝাপসা হচ্ছে এবার, পায়ের পাতা ঘামছে, আবার ফোন- আবার ফোন- আবার ফোন.... না: আর পারা যাচ্ছে না, দাদা কে ফোন টা করতেই হবে ভাবতে ভাবতেই আননোন নাম্বার থেকে মোবাইল বেজে উঠল  -
- হ্যালো ..
- হ্যালো, আপনি কি মল্লিকা বলছেন?
মলি প্রায় চিৎকার করে- " হ্যাঁ, কে বলছেন বলুন?"
- আসলে, অনিন্দ্য বাবুর একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে, ওনাকে আমরির এমার্জেন্সিতে এনেছি আমরা। রাস্তায় এক্সিডেন্টটা আমাদের চোখের সামনেই ঘটল।
ভদ্রলোকের গলাটা যেন হাজারো মাইকে গমগম করে বাজছে, ঘরের দেওয়ালগুলো যেন হঠাৎ অক্টোপাস হয়ে উঠেছে, চারপাশ থেকে তেড়ে আসছে মলির দিকে... মলি এক্ষুণি পিষে যাবে,  মিশে যাবে মাটিতে। 
- হ্যালো, হ্যালো.. না চিন্তার তেমন কিছু নেই- ওনাকে ছেড়ে দেবে আর এক-দু ঘণ্টার ভেতর, আমরা ওনাকে নিয়ে আসছি। পায়ে একটা বোন ক্রাক হয়েছে- হ্যালো শুনছেন?"
- ও এমনি ঠিক আছে তো একদম? আমি আসছি-
- না, ম্যাডাম, আপনি আসবেন না আর, আপনাকে ইনফর্ম করলাম, ওনার ফোনটা আসলে ভেঙে গেছে ; তাই উনি আপনাকে আগে খবরটা দিতে বললেন"..

*

ভোর চারটে।  কিছু আগে অনিকে নিয়ে ফিরেছে ওরা- মলি, মলির দাদা, অনির বন্ধু নীলাভ।  মলি বসে আছে সামনের চেয়ারটায়, অনিন্দ্য শুয়ে, পায়ে প্লাস্টার।  এখন সাড়ে ছয়টা হবে হয়তো ।  দাদারা কিছু আগেই বেরোলো।
- চা খাবে তো?
- কাছে এসো..
মলি আস্তে করে পা ঘষে এগিয়ে গেল অনির কাছে, যেমন করে পোষা বিড়াল আদরে ঘাড় নুইয়ে এগিয়ে যায়,  অনেকটা সেরকম.. মলির হাতটা নরম করে টানল অনি,
- আরও কাছে এসো মলি ..
মলির কাজল চোখদুটো জলে টলটল করছে, অনিকে এবার জড়িয়ে ধরল মলি।
- কি হতো অনি? কি হতো? আমি কি করে বাঁচতাম? ওনারা বললেন,  তুমি নাকি ফোনটা সেভ করতে যাচ্ছিলে!!  কেন?? "

অনি চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে মলিকে।  কপাল, গাল, চোখ, ঠোঁটে অজস্র চুমুতে চুমুতে ভেসে যেতে চাইছে দূর মোহনায়।  ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে মলির মুখ।  ভীষণ আহ্লাদী হয়ে উঠছে শুভ্র বুক , মাদকি কণ্ঠ ...

- এসবে হবে না অনি।  বলো এরম রিস্ক কেউ নেয়?  সামনে লরি এসে গেছিল, তার ওপর তুমি ফোন বাঁচাচ্ছো?

মলির কানের লতি ভিজে যাচ্ছে,  গলা, ঘাড় জুড়ে শুধু মধু গড়িয়ে পড়ছে.... অনি মলির কানের ওপর ঠোঁটদুটো নিয়ে এসে খুব আস্তে আস্তে চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল...

- পাগলি ওতে যে তোমারই ভর্তি ছবি।  দিন রাতের কত বৈচিত্র এবং দুস্প্রাপ্য তোমাতে আমার পরিক্রমা।  ওই ফোন হাতছাড়া করতাম কি করে বলো! পারলাম না ফোনকে অক্ষত রাখতে, গুড়িয়ে গেলো।

মলি দুমদাম আদুরে ঘুঁষিতে ভরিয়ে দিচ্ছে অনির বুক আর অনি আদরের নৌকায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মলিকে।  দূর মোহনার দিগন্তে  লাল, নীল, হলুদে সব রঙের সমাহার।   আদরের রঙে ঘনীভূত নদীর নাব্যতা।    পরিক্রমায় সোহাগী ভালবাসা   ... 


Previous Post Next Post