সুদীপ ভট্টাচার্য্য



পিচের সরু রাস্তাটার পাশেই মাঝারি সাইজের পাতাহীন একটা গাছ। তাতে দু একটা পাখির বাসা। পাশ দিয়ে সরু রাস্তাটা চলে গেছে পুকুরের দিকে। বাঁধানো চাতাল। সিঁড়ি নেমে গেছে পুকুরে। বড় শান্ত, কাজল কালো চোখের মতো সে পুকুর। ঢেউ ওঠে কম। মাঝ পুকুরে একটা বালি হাঁসের দল সাঁতার কাটছে। তাদের অনুচ্চারিত জলকেলির তরঙ্গ ঘাটে আসতে আসতে মিলিয়ে যাচ্ছে অনেকটাই।  ঘাটের কাছে কতকগুলো শোলার কাঠি লাগানো কি সব ভেসে বেড়াচ্ছে। অল্প ঢেউ আর বাতাসে সেগুলো সামান্য কাঁপছে, আর তার ওপর একটা জল ফড়িং বার বার বসছে আর উড়ে যাচ্ছে।  তার নিচে একটা তেচোখো মাছ ফড়িংটার ছেলেমানুষিটা অবাক চোখে দেখছে।

দুদিন ধরে আসছি এই পুকুর ধারে, তবে কাউকে দেখিনি ছিপ ফেলে মাছ ধরতে।  গ্রামের পুকুরে এত মাছ পাওয়া যায়, তাই বোধয় আসে না এই নির্জন পুকুরে।  ছবি তোলা আমার নেশা। প্রতিদিন আসি ওই বালি হাঁস গুলোর ছবি তুলব বলে। দুদিন আসার ফলে ওদের দলের দু একজনকে চিনতেও পারি। ওই যে যার গলার কাছে কালো আর সাদা ছোপ ছোপ দাগ, ওটা হল দলের নেতা।  আর সাদার ওপর বাদামি দাগ ওলা, ওটা মহা বিচ্ছু। কিছুতেই নেতার কথা শোনে না।  জলফড়িং টার দিকে ক্যামেরা তাক করলাম।  আবার উড়ে গেল।

পাশের নাম না জানা গাছটার থেকে ঝুরি নেমেছে জলে। ঝুরি গুলোর গায়ে শ্যাওলা জমেছে। মেয়েদের চুলের মত। ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে। অল্প ঘুম এসে গেছিল, এক মহিলা কণ্ঠে চমক ভাঙল। .... নতুন লোক নাকি?...
চেয়ে দেখি অল্প বয়সী এক বউ।  জল থেকে উঠছে।  ভেজা শাড়ি।  ওপরে শাড়ির ওপর একটা গামছা জড়ানো।  নিচের সিঁড়িতে পায়ের দাগ।
আশ্চর্য, কখন স্নান করতে নামল দেখি নি তো! বললাম, হ্যাঁ বোন, নতুন এসেছি পাশের গ্রামে, রঞ্জনদের বাড়ি।
- ও, তা কি করা হয়?
- কিছুই করি না তেমন, ভবঘুরেও বলতে পারেন। একা মানুষ, এই চলে যায় আর কি....

বউটি ফিক করে হেসে বলল, তা ঘাটে বসে আছেন যে, ক্যামেরা নিয়ে! জানেন না, স্নান করার সময় মেয়েদের ছবি তুলতে নেই! অপ্রতিভ হয়ে আমতা আমতা করে বললাম, না না, আমি তো হাঁসের ছবি তুলছিলাম।.
- ও  তা ভালই, তবে অনেকে আবার লোভ সামলাতে পারে না। খুব সুন্দর খেতে ওরা।  আজ আবার রেঁধেছি, আসবেন নাকি আমাদের বাড়ি।

এতোক্ষণে বউটার মুখের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। কালো সুশ্রী। আর চোখ দুটো এতো সুন্দর যে একবার দেখলে চোখ ফেরানো যায় না।  বললাম, না বোন, আমি ওদের ভালোবেসে ফেলেছি। ওদের খেতে যাব কেন! মুচকি হেসে বউটা চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পায়ের দাগগুলো মিলিয়ে গেল রোদের তাপে। বিকেলের রোদ। জলফড়িং টা এখনো খেলা করছে।

কিছু পরে রঞ্জন এসে হাজির মোটর বাইক করে। তোমায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও, মাঠের চাষিদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম তুমি এদিকে এসেছ।
- হ্যাঁ খুব ভালো লাগে জায়গাটা। বড় শান্তির।
- হুঁ শান্তির, তবে এদিকে এস না বেশি। তোমাকে বলা হয় নি, জায়গাটা ভাল নয়। কয়েক বছর আগে নাকি একটা বউ সুইসাইড করেছিল এখানে।

চমকে উঠলাম।  বাইকের পেছনে বসে যাচ্ছি। সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে। পেছন ফিরে একবার তাকালাম। এখনো পাতাহীন গাছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, তার নিচে লাল রঙের ওটা কি! সেই ভেজা গামছাটা নাকি!!!

Previous Post Next Post