রুমকি রায় দত্ত



বাংলার ঋতু গুলো ক্রমশ যেন বদলে যাচ্ছে,আজকাল আর তাদের আসা-যাওয়ার কোনো পদচিহ্ন ভালো করে চোখেই পড়ে না। আর গায়ে শরীরে তাদের অনুভব করতে পারি না। যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে একেকটা কালকে অতিক্রম করতে করতে হিসাব করি আরও একটা বসন্ত কেটে গেল। বসন্তের তো অনেক রং। কখনও তাকে পাই বিরহে,কখনো বা প্রেমে, কখনো ন্যাড়া গাছের কচি পাতায় আবার কখনও বাতাসে ভেসে বেরানো রঙিন আবিরে,পিচকারির রঙিন জলে মা বাসন্তীর পদতলে।

বসন্ত এলেই মন উদাসী হয়,ফিরে যায় আমার বসন্ত বেলায়। দুপুর বেলায় যখন, আমার বাড়ির পিছনের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সোনাঝুরির ফাঁকে, আমার ভাতঘুম ফাঁকি দিতে চায়,চোখ চলে যায় একটা শুকনো পাতার ঘুরতে ঘুরতে মাটির বুকে ঝরে পরার দিকে, আমার বিলাসী মন তখন ডুব দেয় স্মৃতির পাতায়, আমার বসন্ত বেলায় ... 

আমার বাবা তখন ফরাক্কা বাঁধ প্রকল্পের এক সরকারি কর্মচারি। তাই আমার জীবনে প্রথম বসন্তের সাথে দেখাও সেখানে। শহুরে আন্তরিকতার বাইরে সে এক জীবন ছিল আমাদের। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষের এক মিলনস্থান যেন। একসাথে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে প্রতিবেশিরা হয়ে উঠেছিল পরিবারের স্বজন। কাউকে ডাকতাম কাকিমা,কাউকে জেঠিমা, কাউকে ছোটোমা আর প্রতিটি পরিবারের খুদেরা ছিলাম ভাইবোন। বসন্ত এলেই মনে পড়ে বসন্ত উৎসবের কথা। দোলের দু’দিন আগে থেকেই প্রতি বাড়ির খুদে সদস্যরা হয়ে যেতাম কাঠকুড়ানি। কার বাড়ির শুকনো কলার পাতা, গাছের শুকনো ডাল, এমনকি ঝাঁট দিয়ে জড়ো করা হত শুকনো পাতা। এসব না করলে যে নেড়াপোড়া হবে না। সব এনে রাখা হতো পাড়ার মোড়ে ইউনিয়ন অফিসের মাঠে। ওটাই ছিল আমাদের খেলার জায়গা। একটু একটু করে আকাশের চাঁদটা লাল হতো আর আমাদের উত্তেজনার পারদ উপরে উঠতো। ঠিক দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক জায়গায় দল বাঁধতাম, তারপর দলবেঁধে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করা হত আলু, টমেটো। তারপর মাঠে ফিরে যাওয়া। পাড়ার যারা বড় দাদা ছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে কুড়ানো কাঠ-কুঠি দিয়ে তৈরি করতো পাতার বাড়ি,ঠিক যেন গ্রামের নির্জনে জেগে থাকা রূপকথার ডাইনি বুড়ির পর্ণকুঠির মতো। এরপর ক্ষণিকের জন্য ঘরে ফিরে আসা,নোংরা ঘাঁটার জন্য মায়েদের কাছে বকুনি ... তবে সেসবে কর্ণপাত করলে আনন্দ যে মাটি হবে। চাঁদ মাথার উপর এলেই আবার জড়ো হতাম মাঠে। লাঠির ডগায় কাপড় বেঁধে তাতে আগুন লাগিয়ে পাতার ঘরে ছোঁয়াতেই চারিদিক রাঙা হয়ে উঠতো,আর ওই অগ্নিকুন্ডে একটা একটা আলু-টমেটো ছুঁড়তে ছুঁড়তে আকাশ বাতাস কম্পিত হতো আমাদের সমবেত উল্লাসে---“আজ আমাদের নেড়াপোড়া/ কাল আমাদের দোল। পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে/ বলো হরিবোল”।।

সবথেকে আনন্দ হতো যখন ঐ অগ্নিকুন্ডের ধ্বংসাবশেষ থেকে খুঁজে খুঁজে বার করা হতো আধপোড়া আলু, আর তা সবার সাথে কাড়াকাড়ি করে লবণ মাখিয়ে কচমচিয়ে খাওয়ার সময়।

পরদিন সকাল হতেই মন উসখুস,একে একে বালতিতে জল ভরা, তাতে রঙ গোলা ... কার রঙ কত গাঢ়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাস্তা জুড়ে শুরু হতো রঙিন ভুতেদের ছোটাছুটি। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ ... রঙিন জলে ভেজা।

আমাদের ফরাক্কা একটা দ্বীপের মতো, মাঝখানে বসবাস আর চারপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গানদী। তাই যে, যে পাড়াতেই থাকুক না কেন গঙ্গায় স্নানের সুযোগ ছিল উত্তম। মাঝ দুপুরে ভুতের দল গিয়ে জড়ো হতাম গঙ্গার পারে। এ ওর পিঠ ঘষছে তো সে ওর মাথা। স্বচ্ছ গঙ্গার তখন অস্থির অবস্থা। আমাদের পায়ের দলাদলিতে প্রথমে তার রঙ ঘোলা, তারপর হয়ে উঠতো লাল,সবুজ আরো রঙে রঙিন। মজা টের পেতাম মাথা ঘষার সময়। আবিরের ছদ্মবেশে রঙ যে কখন মাথায় বাসা বেঁধেছে বুঝতেই পারিনি কেউ। ...এরপরের দু’দিন ... কি আর করা যাবে না হয় একটু হাঁচলাম আর কাশলাম। তাই বলে রঙের উৎসবতো আর রোজ রোজ আসে না।

আমার বসন্ত বেলায় সারা বসন্ত জুড়েই থাকতো উৎসবের আমেজ। দোল যেতেই অপেক্ষায় থাকতাম বাসন্তি পুজোর। বাসন্তি পুজোটা আসলে বাঙালির আসল দুর্গাপুজো। বসন্তকালে হয় বলে এই পুজো বাসন্তিপুজো নামে পরিচিত। পুরাকালে সুরথ নামে এক রাজা তার শ্ত্রুরাজ্যের হাতে পরাজিত হয়ে যখন বনে বনে ঘুরে বেরাচ্ছেন,ঠিক তখন তার সাথে দেখা হয় আরেক পরাজিত রাজা সমধির সাথে। রিক্ত দুই রাজা তখন নিজের রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া। ওই জঙ্গলেই তাদের সাথে দেখা হয় মেধা মুনির সাথে। দুই রাজা তাদের মনবাসনা মুনির কাছে জানালে তিনি তাদের পরামর্শ দেন দেবী দুর্গাকে আবাহন করার। তখন চলছে বসন্ত কাল। দুই রাজা মিলে মেধা মুনির পরামর্শ মতো আয়োজন করলেন দুর্গাপুজার। সেই থেকেই বসন্ত কালে বাসন্তি নামে দেবী দুর্গার পুজার সুচনা হয়। যদিও এই পুজা সব জায়গায় এখন আর বিশেষ হয় না। তবে আমাদের ফরাক্কায় এই পুজোটায় বেশ ধুম হতো। ... ষষ্ঠি থেকে দশমি পুজা প্রাঙ্গণে মেলা বসতো। এই কটাদিন বই খাতা শিকেই তুলে শুধুই প্রজাপতি সেজে ঘুরে বেরানো। যখন খুব ছোটো ছিলাম তখন মজা হতো মা-বাবার হাত ধরে মন্ডপের সামনে বেলুন হাতে ঘোরা, বাদামভাজা খাওয়াতে। বড় হওয়ার সাথে সাথে আনন্দের রকমটাও বদলালো।

বসন্তটাকে মনে উপভোগ করার আনন্দও কিছু কম নয়, তখন মা-বাবার সঙ্গ এড়িয়ে বন্ধুদের সাথে দল বাঁধা। মন্ডপের সামনে রঙিন সাজে জমিয়ে আড্ডা, অকারণে হেসে পড়া, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া আর আড়চোখে ঝারিমারা। বাদামভাজার ভিড়টা তখন চপের আর এগরোলের দোকানে। অষ্টমিতে শাড়িপড়তেই যেন হঠাৎ বড়ো হয়ে যেতাম। অঞ্জলির পুষ্প হাতে কি চায়তাম? ...বলবো না।  তখন ঈশ্বরের সামনে দাঁড়ালেই কত চাওয়ারা ভিড় করতো,এখন আর চাওয়া আসে না।

কালের স্রোতে বুঝি আমার বসন্তবেলার সারল্য হারিয়ে গেছে। উচ্চশিক্ষার জন্য ফরাক্কার বাইরে যেদিন পা রাখলাম, সেদিন থেকেই আমার বসন্ত বুঝি ফিকে হতে লাগলো।  এখন আমার বসন্ত কাটে সংসারের ব্যস্ততায়। দোলের রঙ দুগালে দুটি আঙ্গুলের ছাপেই সীমাবদ্ধ। তবু বসন্ত এলে মনে তার উপস্থিতি টের পাই।  সোনাঝুরির ফাঁকে বারবার মনটা হারিয়ে যায় যে।


Previous Post Next Post