রক্তিম তমাল গঙ্গোপাধ্যায়


ধূসর মেঘদের দল পূর্ব দিক থেকে ক্রমশই পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসছে । রাত্রিরের আকাশটাকে বেষ্টন করছে দ্রুত । আজ মনে হয় অমাবস্যা।  কয়েকটা তারা বাঁচতে চাইছিল ।  মেঘদের হৃদয়ে আজ কোনও দয়ামায়া নেই ।  দমকা হাওয়া আজ মেঘদের সাথী ।

সৌম্য ছাদে দাঁড়িয়ে মেঘদের এই দৃপ্র রূপ লক্ষ করছিল । রাত্রির বেলা খাওয়ার পরে ছাদে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট টানা তার বহুদিনের অভ্যাস । প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বেশ কিছুক্ষণ আলতো করে আদর করলো ।  প্রিয় মানুষটিকে চিতায় তোলবার ঠিক আগে তার আত্মীয়রা পরম মমতায় মৃত মানুষটির শরীরে ঘি মাখিয়ে দেয় ।  সৌম্য ঠিক সেই রকম মমতায় সিগারেটটাকে আদর করলো ।  একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ।  সিগারেটের মুখে অগ্নি সংযোগ করে তাকে মুক্তি দিল ।

মৃত মানুষের শরীরই যখন দগ্ধ হয়,তখন শ্মশানবন্ধু থেকে শুরু করে আত্মীয়রা চা-কচুরি খাওয়া শুরু করে দেন। ঘনঘন ঘড়ি দেখেন । অন্য আলোচনা শুরু হয়ে যায় ।  সিগারেট ধরানোর পরে সৌম্যর মনের জানলায় অন্য চিন্তা পাক খেতে শুরু করলো । সে চিন্তায় মৃত মানুষের কোনও স্থান নেই । সে চিন্তায় যৌনতার গন্ধ । সে চিন্তায় কেবল “অনুমিতা-কে” ঘিরে । শেষ তিন বছর না কি তারও আগে থেকে,  অনুমিতা তার শরীর মনের দখল নিয়ে বসে আছে । ডাইনিং টেবিলে অপর প্রান্তে যখন সে  অনুমিতা-কে দেখে অথবা বাথরুম থেকে স্নান করে বের হওয়ার সময়,  উরু-দ্বয়ের মাঝে চাপা পরে থাকা শিশ্ন জানান দেয় ।

ফোটা ফোটা  বৃষ্টি শুরু হল ।  বৃষ্টির স্পর্শ তার তপ্ত শরীরটাকে স্নিগ্ধতা দিল না । তৃষ্ণার আগুনটাকে উস্কে দিল । সৌম্য তাড়াতাড়ি ছাদের ঘরে আশ্রয় নেয় । এই ঘরটা তার নিজস্ব পৃথিবী । একটা খাট। বড় আয়না।  লেখার টেবিল । এছাড়া আর কিছুই এ ঘরে নেই । সৌম্য বালিশে মাথা রাখল । ঠিক তখনই খুব কাছেই কোথাও প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল । ছাদের ঘরটা কেঁপে ওঠে । সৌম্য আতঙ্কে বিছানা থেকে উঠে পড়ল । ঠিক তখনই আবার প্রচণ্ড শব্দ । আবার বজ্রপাত । সৌম্য স্থির করলো আজ রাতটা ড্রয়িংরুমের সোফাতেই কাটাবে । দরজা খুলে সৌম্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় ।

*
দু-বছরের ছেলেকে অনেক চেষ্টার পরে ঘুম পাড়াতে পেরে অনুমিতা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।  এক একদিন এই কাজটা করতে এত সমস্যা হয় যে ছেলের ওপর, নিজের ওপর বিরক্তি লাগে । অবশ্য ইদানীং তার সব কিছুতেই বিরক্তি লাগে।  রান্নাঘর , ছেলেকে খাওয়ানো আর সিনেমা দেখা । জীবনটা কি এইভাবেই শেষ হয়ে যাবে ! অনুমিতা বিছানা থেকে নামল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে প্রত্যক্ষ করল । তার এই শরীরটা কি এতই আকর্ষণহীন ? সৌম্য কেন তার দিকে ভালো করে দেখে না ? অথচ সে সৌম্যকে বোঝাতে চেয়েছে । বাথরুম থেকে স্নান করে আসার সময় সে ইচ্ছা করেই ব্রা পড়ে না।  তার স্তন আরও বেশি করে প্রকাশিত হোক সৌম্যর দৃষ্টিতে।  সন্তান জন্মানোর পরে কি তার স্তনের আকর্ষণ কমে যাচ্ছে ? তা হলে কেন সৌম্য তার শরীরে অধিকার করতে চায় না ? সে সমর্পণ করতে রাজী । পঁচিশ বছরের যৌবন পরিতৃপ্ত হতে চায়। কিন্তু কিভাবে ? পথ খুঁজে পায় না অনুমিতা।  মাঝে মাঝে খুব মন চায় রাত্রিবেলা ছাদে যেতে ।  আকাশ দেখতে । সৌম্য কী করছে দেখতে ?  ছাদে ওঠার সিঁড়ির মুখে একটা দরজা আছে ।  সৌম্য সেটা বন্ধ করে রাখে । একদিন সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে সে গিয়েছিল, দেখেছে দরজাটা বন্ধ ।

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি  পড়ছে । সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে । কেবল সে একা জাগ্রত । ঘরের দরজাটা খুলে সে বাইরের ড্রয়িংরুমে এসে বসল । জানলাটা খুলে দিল । বৃষ্টির ছাঁট আসছে । অনুমিতার ভালো লাগল । সে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ছুঁতে গেল ।ঠিক সেই সময়ই প্রচণ্ড শব্দে একটা বজ্রপাত । অনুমিতা তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করে দিল । সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ ? সৌম্য কি নিচে আসছে ? সারা শরীরটা কেঁপে উঠল । সে মনে মনে প্রার্থনা করল সৌম্য তুমি এসে আমাকে একটু আদর করো ।

*
অন্ধকারে দেওয়াল ধরে সৌম্য কোনোমতে ড্রয়িংরুমে পৌঁছুল। বিদ্যুতের ঝলকে বুঝতে পারল একজন নারী সোফায় বসে আছে। সেই নারীটি যে তার মা নন সেটা বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হল না । সৌম্যর মা অনেকদিন arthritis-এ ভুগছেন। কারও সাহায্য ছাড়া বিছানা থেকে উঠতে পারেন না।  সৌম্য সোফায় গিয়ে অনুমিতার পাশে বসল ।
- কি ঘুম আসছে না ? প্রশ্ন করল সৌম্য ।
- না। উত্তরটা দিতে গিয়ে অনুমিতার গলাটা কেঁপে গেল ।
- হ্যাঁ । একে লোডশেডিং তার ওপর যা বাজ পড়ছে ঘুম আসা মুশকিল।
- তুমি বুঝি তাই ভয়ে নেমে এলে?  সহজ হওয়ার চেষ্টা করল অনুমিতা ।
- ঠিক ধরেছ তবে অন্য একটা কারণও আছে।
- কি সেটা ?
- ভাবছিলাম তোমার সাথে গল্প করবো ।
- মিথ্যে কথা বলার দরকার নেই । দিনের বেলা কথা বলার সাহস নেই তো রাত্রিরে,এমনকি এই তিন বছরে তুমি একবারও আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারোনি !কথাটা বলেই অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠল অনুমিতা ।  সেই হাসির শব্দে সৌম্য বিবশ হয়ে গেল ।
- দিনের আলোয় যে কথা বলা যায় না সে কথা রাতের অন্ধকারে বলা অনেক সহজ ।  ফিসফিস করে বলল সৌম্য ।
অনুমিতা এতক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল । সৌম্যর ফিসফিসে কণ্ঠস্বর শুনে তার দিকে ফিরতে চাইল। অনুমিতার কাঁধটা সৌম্য স্পর্শ করলো ।  সৌম্য নিজেকে  ধরে রাখতে পারল না । দুহাত দিয়ে অনুমিতাকে জড়িয়ে ধরল । ।অনুমিতা সৌম্যর মুখটা তার বুকে চেপে ধরে । অন্ধকার সিঁড়ি ধরে দুটো আতৃপ্ত শরীর দ্রুত ছাদের ঘরের পৌঁছে যায় ।

*
সকালবেলা ঘুম ভাঙতে সৌম্যর দেরী হয়ে গেল । রোজ সকালে মাকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়াটা সৌম্যর দায়িত্ব । বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলো, সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা । দুটো কাঁধে অনুমিতার দাঁতের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । একটা গেঞ্জি চাপিয়ে বাইরে খোলা ছাদে এসে দাঁড়াল । পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ । কোথাও বিন্দুমাত্র মেঘের চিহ্ন নেই ।  অনুমিতার গলা পেল । রান্নাঘরে কাজের মাসীকে কিছু বলছে । এক কাপ চা দরকার । সৌম্য একতলায় নামতে যাবে এমন সময় নজরে পড়ল একটা সবুজ রঙের জিপসি তাদের বাড়ির সামনে এসে থামলও ।  সৌম্য তাড়াতাড়ি একতলায় নেমে এলো । ততক্ষণে একজন আর্মি অফিসার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন । সৌম্যকে দেখে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, “এটা কি ক্যাপ্টেন আবির চৌধুরীর বাড়ি ?” সৌম্য হ্যাঁ বলাতে উনি আবার প্রশ্ন করলেন, “আপনার সাথে তার সম্পর্ক ?”
- আবির চৌধুরী আমার দাদা ।
সৌম্যর উত্তর শোনার পরে অফিসার একটি খাম তার দিকে এগিয়ে দিলেন । সৌম্য তাড়াতাড়ি খামটা খুলল । অনুমিতা ততক্ষণে সৌম্যর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ।  ইংরাজিতে লেখা চার লাইনের ছোট্ট একটা চিঠি । বাংলায় যার মর্মার্থ-

“ ক্যাপ্টেন আবির চৌধুরী গতকাল রাতে কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের আক্রমণে মারা গিয়েছেন । তার মৃতদেহ আজ বিকেল চারটের সময় ‘নেতাজী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে’ সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমানে নিয়ে আসা হবে । পরিবারের সদস্যদের বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে ।”

চিঠিটা পড়ার পরে সৌম্য হতভম্ব হয়ে গেল । সম্বিত ফিরে পেতে কেটে গেল ভীষণ দামী কিছুটা সময় । সৌম্যর মনে পড়ল অনুমিতা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল । সে নিশ্চয়ই পড়েছে । সৌম্য দেখল তার পাশে এখন আর অনুমিতা নেই । অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে গেল । সে তাড়াতাড়ি দাদার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল । দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ । সৌম্য দরজাতে তার শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল ।“বৌদি প্লিজ । দরজা খোলো । বৌদি....”

কান্না আর আর্তনাদ মিলে মিশে একাকার হয়ে আছাড় খেতে লাগল রুদ্ধ দরজাতে ।  তিন বছর যে সৌম্য একদিনও ডাকতে পারিনি সে আজ প্রথমবার  অনুমিতা-কে সম্বোধন করল । জীবনের এক জটিল সন্ধিক্ষণে । সেই প্রথম এবং শেষবার ।

Previous Post Next Post