সাহিত্য সমাজের দর্পণ, সে দর্পণে লেখক নিজেকে দেখেন নিজেকে চেনেন, পারিপার্শিকতার হাজার ভিড়ে খুঁজে পান নিজের ঐকান্তিক সত্ত্বা। কবি পূজা মৈত্রের আত্মজা সিরিজ পড়তে পড়তে যেন হারিয়ে গেলাম এক অতলান্ত সমুদ্রে ; সেখান থেকে কলম্বাসের মতো আবিষ্কার করলাম কবির এক অনাবিষ্কৃত ভূখন্ড- যে ভূখন্ডে সূর্যের আলো আসে না,সাধারণের প্রবেশ নিধিদ্ধ সেখানে, সে ভূখন্ড কবির একান্তই নিজস্ব। সেখানে শুধু কুলকুল করে বয়ে চলে অপত্য স্নেহের ঝর্ণাধারা।
আত্মজা কি সেটা জানতে গেলে কবির মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে, কবিতা তো শুধু কিছু সঙ্গবদ্ধ শব্দের কাঠামো নয়, কবিতা একটা অবয়ব,যে অবয়বকে কবি তিল তিল করে গড়ে তোলেন , মাটি দেন, জল দেন, কাঠামো তৈরী হলে তাকে সাজ সজ্জা অলঙ্করণে ভূষিত করেন। তারপর চক্ষুদান পর্ব সেরে গড়ে তোলেন এক মাতৃপ্রতিমা। পরিশেষে সেই মাতৃ প্রতিমায় কবি নিজেই অন্তর্লীন হয়ে যান। কবির অন্তরের সেই সুপ্ত মাতৃ প্রতিমা আত্মজার সুখে নিজেকে বারে বারে বিলিয়ে দিয়েছেন। নদীর বুকে ভাসতে থাকা মাতৃ প্রতিমার মতো কবির অশ্রুসিক্ত চোখ খুঁজেছে এক আশ্রয়, তবু মাতৃ প্রতিমার কোনও নিরঞ্জন হয় না,বিসর্জন হয় না,স্রোতের বুকে ভাসতে ভাসতেই কবি নিজেকে ভাঙেন গড়েন। এই ভাঙা গড়া নিয়েই আত্মজার এক একটি কবিতা।
আত্মার থেকে যা জাত সেটাই আত্মজা। এই বন্ধন নাড়ির বন্ধন, যদিও গর্ভজাত না হয়েও যদি আত্মার যোগসূত্র অটুট থাকে সন্তানের সাথে তবে সে আত্মজাই।
কবি লেখেন -
"দেওয়ার অনেক কিছুই ছিল
জাগতিক যা কিছু হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে চলে যায়-
ওরা নশ্বর-
এমন কিছু দিতে চাই যার ক্ষয় নেই,আদি নেই,অন্ত নেই
এক পৃথিবী ভালবাসা দিতে পারি যদি তোর আঁচলে ধরে.....
তবে যদি আমাকে,শুধু আমাকেই দিতে চাই?"
এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে একজন জননীই পারেন । আত্মজা সিরিজ কবির সেই অন্তর্লীণ মাতৃসত্ত্বা। আত্মজা কি এই প্রশ্নের উত্তরে বলি আত্মজা এক নামহীন সম্পর্ক। সব সম্পর্কের উর্ধে এই নামহীন সম্পর্কগুলোই মনের গভীরে দাগ কেটে যায় । অনেকখানি মায়াকাজল লাগিয়ে দেয় দু'চোখে । কবির ভাষায় -
" যা আপনার না হয়েও একান্ত তার কপালে এঁকে দি অসম্ভব স্নেহ'। এই আত্মজাই তার শক্তি,তার ক্ষয় । আবার বিনাশের পূর্বে মৃতসঞ্জীবনী সুধা । কবির উপলব্ধি,
'সুতো কাটা ঘুড়ির মতো উড়ছি আকাশে,
উড়ছি কিন্তু একেবারে উড়ে যেতে পারি নি এখনও...
সুতোর অন্য প্রান্তটা আত্মজার হাতে ।
কাব্যের শেষে কবি এক গভীর জীবনবোধ এর কথা বলেছেন ।সে বোধ কবির নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ফসল। আত্মজার আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছেন কবির মন্দির । ভালবাসায় যদি নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়া যায় সে তো পূজাই ।
'লাবন্যের যে প্রভা ছিল তা বর্তায়
প্রতিমায় পূজা করলে তবেই তা জ্বলে ওঠে
যেমন আজ সহস্র দীপ আমার দেউল জুড়ে
অন্ধকার কুটির আমার ভরে দীপিকায়।"
এ যেন কবিগুরুর "আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস করবো নিবেদন/ আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন' এই লাইনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। পরিশেষে কবি তার শেষতম আর্তি জানিয়েছেন আত্মজার উদ্দেশ্যে -
'ঘুম আসবে নেমে চির সুন্দর ঘুম যাকে বলে
চিরসত্য আসবে সব মিথ্যার আবসান হলে
তন্দ্রা জাড়নো গলায় বলে যাবে পাখী
মাথা টি তার যেন থাকে আত্মজার কোলে..'
এইভাবেই আত্মজার সাথে মান-অভিমান,হাসি কান্না,ত্যাগ তিতিক্ষার এক ছবি এঁকেছেন কবি পূজা মৈত্র তার শব্দ কলমে। এ যেন কোন কাব্যগ্রন্থ নয় কবির নিজস্ব আত্মকথন।
কাব্যগ্রন্থ-আত্মজা সিরিজ। প্রকাশক-পানকৌড়ি। মূল্য-১০০টাকা।
কাব্যগ্রন্থ-আত্মজা সিরিজ। প্রকাশক-পানকৌড়ি। মূল্য-১০০টাকা।
Tags:
প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ