প্রকল্প ভট্টাচার্য



বসন্তে কী হয়! বসন্তে কী না হয়! আপনাদের বলে রাখি, কক্ষনো এই ঋতুটাকে বিশ্বাস করবেন না। কিছুতেই না।  জানেন, আপনাদের মতো অপালাও প্রতিটি বসন্তে ভাবতো, এইবার তার মনে বাহার আসবে। আজ ঐ বসন্তই তার কুড়ি বছরের মন ভেঙে দিয়ে গেল একেবারে চুরমার করে...  অপালা কাঁদছিল। জানলা দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ এসে হাত বোলাচ্ছিল তার পিঠে, ফাল্গুনের ঠাণ্ডা মিষ্টি হাওয়া আলতো করে তার চুলে বিলি কেটে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। ফাঁকা ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে তবু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। শেষ পর্যন্ত রাজর্ষি! যে রাজর্ষিকে সে এত বিশ্বাস করে, সেই কিনা-!! আর ভাবতে পারছিল না সে।

রাজর্ষি বসু। ধীর, শান্ত, ইকনমিক্স থার্ড ইয়ারে অপালার সহপাঠী। শুধু সহপাঠী? হ্যাঁ, অনেক ভেবেচিন্তেও অপালা তাকে অন্য কিছু ভাবার সাহস পায়নি। পাবে কী করে! রাজর্ষি হৈ-হুল্লোড় থেকে দূরে থাকে, নিয়মিত ক্লাশ না করলেও সিসিডি-তে আড্ডা মারে না, সিনেমা দেখে না,... একদিন যদি বা আকাদেমীতে নাটক দেখতে গিয়েছিল, তাও একা!
- কীরে রাজর্ষি! তুই এখানে!
- নাটকটা দেখব...
- বাঃ, তুই নাটক ভালবাসিস? কার সাথে এসেছিস, অঙ্গনা? রূপালি?
- না না, একাই তো...
- একা? একা এসেছিস নাটক দেখতে? তোর কথা কিছুই বুঝতে পারি না!

রাজর্ষি হাসে।  অনিয়মিত কামানো দাড়ি, কোনও নেশার ছোপ না পড়া ঠোঁট, দাঁত- এবং চোখে শিশুর সারল্য নিয়ে রাজার মতো রাজর্ষি হাসে।  রজত, শ্যামলরা তারা দেয় অপালাকে।  চলে আয় অপু, এই পাগলটার সঙ্গে আরও বকবক করলে তুইও পাগল হয়ে যাবি। পাগল, ক্ষ্যাপা, কবি- নানান জনে কতো ডাকনাম যে দিয়েছে তাকে... তবু অপালার কাছে সে শুধুই রাজর্ষি।  দলছুট, স্বতন্ত্র।

*
একদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ক্লাশরুমে জোর অন্তাক্ষরী আর হুল্লোড় চলছে, তারই মধ্যে অপালা দেখেছিল জানলার ধারে বসে কী যেন স্কেচ করে চলেছে পাগলটা।
- তুই কি ছবিও আঁকিস নাকি?
রাজর্ষি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল বাস্তব জগতে ফিরতে। 
- মাঝে মাঝে, ইচ্ছে হলে! আবার সেই হাসি।
- দেখি, কী আঁকছিস, বৃষ্টি? অপালা দেখল বৃষ্টির তোড়ে নুইয়ে পড়া একটা চারাগাছের মাথায় ভাঙ্গা ছাতা ধরেছে একটা বাচ্চা ছেলে, নিজের ছেঁড়া জামা ভিজে চুপ্পুড়... বাঃ, দারুণ আইডিয়া তো! কোত্থেকে পেলি?
রাজর্ষি কিছু না বলে জানলা দিয়ে বাইরে দেখাল। সত্যি, অপালার দৃশ্যটা চোখেও পড়েনি এতক্ষণ।  তারপর যেন একটা ঘোরের মধ্যে বলতে লাগল, সব গল্পের যেমন একটা ছবি থাকে, সব ছবিরও একটা গল্প থাকতে হয়।  নাহলে...
অপু, ‘ল’ দিয়ে একটা গান বল, শিগগির!’ আর বাকিটা শোনা হল না।
তা নাহলেও অপালা জানতো যে রাজর্ষি অন্যরকম। আরও জানতে কৌতুহল হতো, আবার রাজর্ষির নিরাসক্ত ভাব দেখে তার অভিমানও যে হয়নি তা নয়! ইসসস, ভারি এসেছেন যীশুর অবতার!

*

দিন পনেরো আগে রাজর্ষিই তাকে ক্লাশরুমের বাইরে ডেকে কথা বলল। 
- অপালা...
বিস্ময়, অভিমান, সব কিছুর ওপর জয় হল কৌতুহলের। ‘হ্যাঁ বল?
- তোর একটা হেল্প দরকার, কিন্তু...
- হেল্প? আমার? হ্যাঁ বল না! কী লাগবে?
- একটু বাইরে আসবি? বাগানে? আসলে, সবার সামনে...
অপালা হাসবে না কাঁদবে বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করলো বাগানের এক কোণে। কিন্তু তার জন্যে অপেক্ষা করছিল আরও বড় বিস্ময়।
- ইন্টারকলেজ আর্ট কম্পিটিশনে নাম দিয়েছি
- বাঃ, দারুণ! কী ছবি আঁকবি ভেবেছিস?
- তোর ছবি।  তোর চোখদুটোর মধ্যে একটা গল্প আছে, সেটা তোর ঠোঁটে গিয়ে শেষ হয়।  না করিস না প্লীজ!

অপালা ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিল। একবার মামার বাড়ির পেয়ারা গাছে চড়তে গিয়ে পড়ে গেছিল মুখ থুবড়ে... সেই গল্পটাই কী? আর কিছু বলেনি রাজর্ষি, অপালাও জানতে চায় নি। তবে সিটিং দেওয়ার আগে শর্ত হয়েছিল যে ছবি সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপালা দেখতে চাইবে না।

আর সেই নিজের চোখের না-জানা গল্প জানবার আগ্রহে সে যখন প্রতিযোগিতার ছবিগুলোর প্রদর্শনীর উন্মোচনের সাথে সাথে ঘরে ঢুকল, দেখতে পেল তার পূর্ণাবয়ব ছবি... শরীরে কোনো আবরণ নেই, লজ্জা বা গোপনীয়তার কোনও আড়াল নেই... ছবির নাম ‘অপালা’!! আর সে ভাবতে পারছে না, মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী করে মুখ দেখাবে সে কলেজে, কী জবাব দেবে এত দর্শক, সমালোচকদের! তার সারল্যের এই পুরষ্কার দিল রাজর্ষি!

হঠাত মুঠো ফোনটা বেজে উঠল। না, সে তুলবে না, কোনও কথা বলবে না কারো সাথেই! বেজে বেজে ফোনটা থেমে গেল একসময়। তারপর একটা বার্তা এল- ‘রাগ করেছিস? তুই কতো সুন্দর তা আমি অন্য কোনও ভাবে বোঝাতে পারিনি রে কোনও দিন!’  

সব, সমস্ত দোষ ও বসন্তের। বিশ্বাস করুন, রাজর্ষির সাথে আমার পরিচয় হয়নি, অপালাকেও চিনিনা।  অথচ আজও, এই বসন্তের সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একটা আলাভোলা ছেলে হঠাতই তার বান্ধবীকে বলল, ‘তোর চুলের কাঁটাটা দিয়ে ঐ ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটাকে যদি ফাটিয়ে দিই, সারা আকাশ জুড়ে দেখবি লাল-হলুদ রঙের খেলা!’ 

সব ছবির পিছনে সত্যিই একটা গল্প থাকে, নাহলে সে ছবি ব্যর্থ।   



Previous Post Next Post