মৃন্ময় মান্না



একশো বছর আগে বর্তমান পৃথিবীর মত এত প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত ছিল না। তখন গবেষণার বেশির ভাগটাই ছিল হিসেব নির্ভর। ছিল না ‘অবজারভেটরি’ পদবি যুক্ত বড় বড় দূরবীক্ষণ যন্ত্র অথবা ‘সার্নে’র ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে’র মত বিশাল বিশাল ত্বরক যন্ত্র। বিজ্ঞানীদের ছোট্ট পরীক্ষাগারে দীর্ঘ গবেষণার পরীক্ষা করার জন্য আলো দেখাতো এক টুকরো মোমবাতি।

একশো বছর আগে তখন সবে মাত্র কনা পদার্থবিদ্যায় জোয়ার এসেছে।বিংশ শতকের শুরুতে ম্যাক্স প্লাঙ্ক, হাইজেনবার্গ, স্রয়েডিঞ্জার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা জগতের চেনা চরিত্র বদলাতে শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময় পদার্থবিজ্ঞানে নিজের জায়গা বুঝিয়ে দিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন নামক এক ইহুদী যুবক। নিউটন-ম্যাক্সওয়েল এর ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, কোনও বস্তুর ভরের কারনে স্থান-কাল উভয়েই বক্র হয়। এটাই মাধ্যাকর্ষণের নতুন নিয়ম। ১৯১৫ সালে নভেম্বরে তিনি স্থানকাল বক্রতা সম্পর্কিত নতুন সমীকরণ তৈরি করলেন যা ‘সাধারন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। আর এই স্থানকাল বাঁকিয়ে দেওয়ার পেছনে তিনি দায়ীও করেছেন ‘মহাকর্ষীয় তরঙ্গ’ নামক মহাকাশীয় ঢেউ কে যা কিনা প্রমানিত হতে সময় লাগলো পুরো একশো বছর। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হল আলোক তরঙ্গের মতই একরকম আন্দোলন যা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে। যেকোনো ঘূর্ণনরত, স্পন্দিত ভরই(গ্রহ, নক্ষত্র বা অন্য কোনও পার্থিব বস্তু)এইরকম আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম। মহাকর্ষীয় আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট বিকিরনের কোয়ান্টামকে বলা হয় গ্রাভিটন।(আলোক তরঙ্গের কোয়ান্টাম কে বলা হয় ফোটন। )

এই মহাকাশীয় ঢেউ প্রমানিত হওয়ায় নিঃসন্দেহে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ‘মহাবিস্ফোরণ’ বা বিগ ব্যাং তত্ত্ব আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। সঙ্গে আলবার্ট আইনস্টাইন নিয়ে নিন্দুকদের কুৎসা কিছুটা হলেও থামবে সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ‘Universe In The Nutshell’ বইতে স্টিফেন হকিন্স বলেছেন,‘আমি এখনও সপ্তাহে দু-তিনটে চিঠি পাই যার মূল বক্তব্য আলবার্ট আইনস্টাইন ভ্রান্ত’। এই পরীক্ষার নিখুঁত ফলাফল সাধারন আপেক্ষিকতা তত্বকে আরও উচ্চতায় স্থান দিল। পৃথিবী থেকে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ ভারী দু’টি কৃষ্ণ গহ্বরের (ব্ল্যাক হোল) সংঘর্ষ থেকে সৃষ্টি এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা হয়েছে। এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের জন্য বিজ্ঞানীরা লেজার রশ্মি ভ্রমণ করতে পারে এমন চার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল তৈরি করেন। লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অভজারভেটরি (LIGO) নামে পরিচিত এই সিস্টেম একটি পরমাণুর ব্যাসের ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত সূক্ষ্ম দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে পারে। আসলে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের এই তরঙ্গের প্রভাব যখন পৃথিবীতে পৌঁছায়, তখন তা ক্ষীণ হয়ে যায়। তা ছাড়া পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন রকমের তরঙ্গ প্রতিমুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে যা তুলনায় ওই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য খুবই সূক্ষ্ম। এত তরঙ্গের মধ্যেও এটা পরিমাপ করা বেশ কঠিন কাজ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রভাবে লেজার রশ্মিই অতি সামান্যতম বিচ্যুতিও পরিমাপের ব্যবস্থা করা হয় ওই যন্ত্রে।‘সার্নে’র ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে’ হিগস-বোসন কনার অস্তিত্বের প্রমান তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হলেও এটির গুরুত্ব যে তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় তা স্বীকার করে নিয়েছেন ‘সার্নে’র বিজ্ঞানীরা। হিগস-বোসন কণা শনাক্তের পর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের ঘটনা বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মন্তব্য করেছেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব গ্র্যাভিটেশনাল ফিজিক্সের অধ্যাপক কারস্টেন ডানসমান। অধ্যাপক ডানসমান বিবিসিকে বলেন, “এটা প্রথমবারের মতো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত; এটা প্রথমবারের মতো ব্ল্যাক হোলের সরাসরি শনাক্ত করার ঘটনা এবং এটা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের নিশ্চয়তা। কারণ এই ব্ল্যাক হোলগুলোর বৈশিষ্ট্য শত বছর আগে আইনস্টাইন যেমনটা ধারণা করেছিলেন তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।” সংবাদ সম্মেলনে লিগোর নির্বাহী পরিচালক ডেভিড রেইতজে বলেন, আমরা মহাকর্ষীয় মৃদু তরঙ্গ শনাক্ত করেছি। এই আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা করলো। মূলত এই আবিষ্কারের ফলে বহু দশকের অনুসন্ধান-প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো। এর মাধ্যমে বিগ ব্যাং তত্ত্বের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। 

সত্যিই তো একশো বছর পরে হলেও এই বিজ্ঞানীরা যেটা করে দেখালেন সেটা অনেক পরিশ্রমের ফল। ‘লিগো’র(LIGO) প্রত্যেক বিজ্ঞানিকে বাঙালী বিজ্ঞানপ্রেমীদের তরফ থেকে অনেক অভিনন্দন।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের দীর্ঘ একশো বছরের ইতিহাস সংক্ষেপে : -

• ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রকাশ করেন ‘সাধারন আপেক্ষিকতা’ তত্ব যাতে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সম্পর্কে ধারনা দেওয়া আছে। 
• ১৯১৬ সালে তিনি সাধারন আপেক্ষিকতা তত্বে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের কথা ভবিষ্যৎবানী করেন। 
• ১৯৫৭ সালে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ও হারমান বন্ডি তাদের গবেষণাপত্রে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কথা স্বীকার করেন। 
• ১৯৬২ সালে ‘এম.ই.গার্টসেনটেন’ ও ‘ভি.আই.পাস্টাভট’ একটি প্রথমপত্র প্রকাশ করেন যাতে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ‘ইন্টারফেরমিটার’রের সাহায্যে কিভাবে শনাক্ত করা যায় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। 
• ১৯৬৮ সালে ‘জোসেপ ওয়েবার’ নামে একজন বিজ্ঞানী বললেন যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করা গেছে। কিন্তু রিপোর্টটি ভ্রান্ত প্রমানিত হয়।‘রেনার অয়েজ’ ‘ওয়েবার মেথড’ বিশ্লেষণ করেন ও লিগো (LIGO) র কল্পনা করেন। 
• ১৯৭০ তে জোড়া পালসার নক্ষত্রের ক্রিয়ায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের হাল্কা ইঙ্গিত পাওয়া গেলো। জানা গেলো যদি তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিঃসরণের মাধ্যমে শক্তি ক্ষয় করে তাহলে তারা নিবিড়ভাবে ও দ্রুত কক্ষপথে ত্বরণসহিত ঘুরতে থাকবে। 
• কিপ থর্ন, রনাল্ড ড্রেভার এবং রেনার ওয়েজ এর নেতৃত্বে একসঙ্গে বৈজ্ঞানিকরা একত্রিত হয়ে লিগো (LIGO) প্রজেক্টের কাজ শুরু করেন ১৯৮৪ সালে। 
• ১৯৯৪ সালে লিগো ল্যাবরেটরি ডিরেক্টর ‘ব্যারি বারিশ’ এবং তার দলবল ‘লিগো’র পড়াশোনা, প্রজেক্ট প্ল্যান ও সম্ভাব্য বাজেট এর বিবরন তৈরি করলেন। সেগুলো এন.এস.এফ (NSF) এ দীর্ঘ আলোচনার পর আর্থিক সমর্থন জুটল ও কন্সট্রাকসানের কাজ শুরু হল।
• এই বছরেই বারিশ প্রধান তদন্তকারী নিযুক্ত হলেন। এবং লিগো তে ৩৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হল যা ‘এন.এস.এফ’ (NSF) এর প্রোজেক্ট এর ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। 
• ২০০২ এ লিগো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খোঁজার কাজ শুরু করল। 
• ২০১৪ সালের ১৭ই মার্চ ‘হার্ভাড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার অফ অ্যাস্ট্রফিজিক্স' এর বিজ্ঞানীরা ভ্রান্তভাবে দাবি করেন যে তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করেছেন এবং সরাসরি একটি ছবিও তৈরি করতে পেরেছেন। 
• ২০১৬ সালে ‘পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির’ একজন বিজ্ঞানীর গবেষণায় দাবি করেন যে ডার্ক এনার্জি মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে নষ্ট করে দিতে পারে। 
• ২০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ‘লিগো’র অগ্রজ দল ঘোষণা করল তারা ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে ৪০০ পারসেক দূরে(১.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ)দুটো ব্ল্যাক হোলের সংযোজনে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন। আর এই সংযোজনে ঘটনাটির পোশাকি নাম GW150914 .




Previous Post Next Post