১। সজনেগাছ, আমি ও বৃষ্টিবিলাস
আজও যখন বসন্তের আলগা পথভোলা ভোর হয় বৃষ্টি নিয়ে, সজনেগাছের ডাল বেয়ে টুপটাপ শব্দে চুঁইয়ে পড়ে শাদা আলো। পাঁচমারি মোড়ের ঠিক আগে যেখানে মায়ের ঘুমভাঙা ডাকেরা লুকিয়ে যায় ধোঁয়া ধোঁয়া অজানার উল্টোপিঠে, সেখান থেকে ভেজামাটির সোঁদা গন্ধ নিয়ে আসে ভোরের ভেজা বাতাস, কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে শীত করে। সজনের ডাল ভরে ফুটে ওঠে উড়োঝুরো বুনোগন্ধের শাদা শাদা ফুল। আমি বুকভরে বসন্তের সুবাস নিতে নিতে সজনেগাছের ফুলঝরানো বৃষ্টি মাখি।
২। শীত-জারুল উৎসব
শীতরাতের মিঠে-কড়া খুনসুটির শেষে রক্ষনশীল আকাশ চুইয়ে নেমে আসে বসন্তের সকাল। ঘুমচোখেই দেখে নিই জানলার চৌকো ফ্রেমে বাঁধানো আকাশী ক্যানভাসে আঁকা বাগানের নিস্পাপ জারুলগাছ। দেখতে পাইনা তবু মনেমনে টের পাই গাছের ঝিরিঝিরি পাতা বেয়ে মোতিদানার মত শিশির ঝরে। জলেভেজা শীতার্ত ভোরের ঘাসে ছড়িয়ে যায় ঝরাফুল। আলোছায়া গাছতলায় আইশবাইশ খেলে বেড়ায় দুব্বোঘাসের সন্ততিরা। পাতায় পাতায় সোনারঙ আলো। সবুজ গাছ জুড়ে যেন ডাকের সাজ পরানো ঝলমলে রোদ্দুর। বৃন্তে-বৃন্তে ফুলের সুগন্ধী মঞ্জরি, লজ্জাবতী হিমেল ছোঁয়ায় শিউরে ওঠে জারুলেরডালে বাঁধা চড়ুইপাখির বাসা। পায়ে পায়ে গাছের কাছে যাই। নীরবে শ্যাওলামাটির সবুজে মিশে যায় তার পর্ণমোচী উৎসব। গাছ জানে, ওই ঝরে পড়া পাতারা জানে, হলদে জারুল ফুলেরা জানে – আমাদের হিমদিন ফুরানো পিছুডাকের পদাবলী।
৩। কুসুমপ্রেম
শীতার্তমাঠের সব বোরোফসল মরাইয়ে তুলে দিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন গুনে গুনে এগিয়ে আসে বসন্ত। বোসবাবুদের ঝিল লাগোয়া গাছেদের অস্ফুট কানাকনিতে আমি স্পষ্ট শুনতে পাই বসন্তের আগমনবার্তা। দিশা না জেনেই মোবাইলে রিংটোন পাল্টে দেয়, “ বসন্ত এসে গেছে….”। আলো-হাওয়ার সঙ্গে আবাল্য মিতালী যে পাতার, তাদের গাছের ডালে, বৃন্তে, আটকে থাকার ভবিতব্য জেনেও বসন্তের ঝকঝকে সোনালী আলো ডাক দেয়, চলো। শীতশীত সুগন্ধী হাওয়া নাড়া দিয়ে বলে, চলো। পাখীর গানেগানে ভরে ওঠে আমার রৌদ্রছায়া কুসুমবিলাস, গাছেগাছে সোনারঙ ফুলকলিরা আধোঘুমে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। ভরভরন্ত বৎসল্যে সেই সোনালী রঙ ছড়িয়ে যায় পথে মাঠে বনে। বুকে দুধ নিয়ে নীরবে নতমুখী হয় মাঠের ধান্যমতী সুন্দরীর দল। পোয়াতী মাটির লজ্জা ঢেকে নেমে আসে কুয়াশা। ওড়নার মত ঢেকে নেয় গাছবালিকার উদ্ভিন্নযৌবনা সৌন্দর্য্যটুকু। সবুজ হয়ে সেজে ওঠে আমার চিরকালের চেনা কুসুমমায়া। পাতার আড়ালে নীড় বাঁধে দোয়েল পাখী। বাবুইপাখিও বড় যত্নে বুনে নেয় তার সংসারস্বপ্ন। কুসুমগাছ যে পাখিদের ঐ পালকস্পর্শটুকুর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আলোছায়া লুকোচুরি খেলা সন্ধেগুলো ধুনোর গন্ধে, ধূপের ধোঁয়ায়,শাঁখের ডাকে ভরে যায় আতপ্তসুখে। অলীক মোহ কুসুমগাছের জরায়ুঘরে বসন্ত অঙ্কুরিত হয় রূপকথা প্রতীক্ষায়।
৪। বিরহী শিমূল
আকাশের বুকে লাল ছোপ। বুঝি তুমি আগুনরঙা সিঁদুর পরেছ সিঁথিতে?কার নামে সিদুঁর পড়লে সই?বসন্তের নামে বুঝি?তোমার ডালে ডালে তো ফুল নয়, ও যে যন্ত্রণার লাল রঙ। রুক্ষ মাটিতে অসহনীয় প্রসবযন্ত্রণায় রক্তাক্ত লাল তোমার শিমূলফুল সন্তান। এই শিমূল যন্ত্রণা থেকেই বুঝি ফুলফোটানোর আনন্দে তোমার চোখে জেগে ওঠে আনন্দাশ্রু! টুপটাপ ভোরের শিশির হয়ে ভিজিয়ে যায় তোমার কন্টকাকীর্ণ ত্বক। যেন বড় বেদনার্ত তুমি, মুখ ধুয়ে যাচ্ছে বিন্দুবিন্দু আঁখিজলে। তোমার বল্কলে নারীসুলভ কোমলতা নেই, আছে রুক্ষতা, শরীরে শরীরে ক্ষত্রয়নীর বর্মের মত ঢেউতোলা শল্কপত্র। সতীত্বের পরকাষ্ঠা। এক-কাঁটাভরা মনষ্কামনাপূরণের দাগ । তারপরেও যন্ত্রণালাল ফুলের গর্ভকোষ ছুঁয়ে উঠে আসে তোমার অঢেল অপার বসন্তপ্রেম । অনিন্দ্য খুশিতে জড়িয়ে ধরো ঋতুরাজের মোহনীয় শরীর। পর্ণমোচী খুশীতে যৌথবিভঙ্গে নেচে ওঠো বসন্তসখার গানে। প্রিয়পুরুষটির আঙ্গুলে পরিয়ে দাও বাসন্তি জ্যোৎস্নার আংটি। আহা বিপ্রলব্ধা অভিমানী শিমুলের প্রিয়তম বসন্ত ! বিরহান্তরিতা শিমুলের প্রাণসখা বসন্ত! প্রেয়সী শিমূলের বড় আপনার ঋতুরাজ বসন্ত!বসন্ত রূপে পুরুষে পুরুষে, শিমূল হয়ে নারীতে নারীতে শুষে নেয় সেই অপার্থিব আলো। রাতভর রাতচরা পাখী সে প্রেমকাহিনীর গান শোনায় । চাঁদের আলোয় ভিজে যায় চারপাশ। এলোমেলো হাওয়া বয়। নববধুর মত লাজরক্তা শিমূলের জরায়ূঘরে মিলনের শেষে তুলোর বীজ রেখে যায় বসন্ত। কিছু সম্ভাবনা ঝরে পড়া শিমুলের পাপড়ির মত আলতাপড়া পায়ের ছাপ হয়ে গৃহস্থের আঙিনা উঠোনে মাঙ্গলিক আল্পনা এঁকে দেয়।বাকি সম্ভাবনারা, আগামী বসন্তে অমৃতের সন্তান হয়ে ফেরত আসার প্রতীক্ষায় দিন গোনে।।
৫। ওলো সই কৃষ্ণচুড়া
আমার দোতলার জানলা ছুঁয়ে হাতছানি দেয় এক পাতাভরা ডাল। রোজ ছাদের জল পড়ে পড়ে গাছের কান্ডে পিচ্ছিল শ্যাওলার পেঁজা পেঁজা জলছাপ বসতি। পাতার আড়ালে এক-পা দু-পা করে জড়ো হয় যত সবজেটে কলিরা, বসন্তের গল্প শুনতে উন্মুখ হয়ে রয়। তারপর টুকটুকে লালমুখ বাড়িয়ে একটু উঁকি দিতেনা দিতেই পড়িমড়ি করে দৌড়ে আসে দামাল দক্ষিণাবায়ু। সব নেড়েচেড়ে লন্ডভন্ড করে পাতাটাতা ঝরিয়ে হো হো করে হেসে এগাছ সেগাছ ছুঁয়ে পালায় সেই ঠিকানাছাড়া মেঠোপথে। তাতেই বৃন্তে শিউরে ওঠে কৃষ্ণচূড়ার নরম লাজবতী কলি। গাছের পাতাঝরা ডালে মায়ের মেলে দেওয়া ভেজা শাড়ীটার মত বিছিয়ে থাকে দুপুরের রোদ। তার ওপর জানলার কার্ণিসে রাখা টব আর পড়শি নারকেলগাছের পাতাদের ঝিলমিল রোদছায়া কারুকাজ। কৃষ্ণচুড়ার লালফুলেরা তাতে হাজারবুটি নকশা তোলে। কখনও স্থিরবিশ্বাসে আকাশে চেয়ে থাকে, মায়ের গানের সুর মেখে ভেসে যায় যে মেঘ, তাকেও হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে. প্রজাপতিপাখায় নিমন্ত্রণ-পাঠায় বসন্ত-উৎসবের। গাছের নীচ দিয়ে একতারা বাজিয়ে মাধুকরীতে যায় বুড়োবাউল। গান ভেসে আসে “ওলো কৃষ্ণচুড়া সই”…
৬। মহুয়া
শীতের শেষেই একজোড়া কালো বুলবুলি কোথা থেকে এসে বাসা বেঁধেছে মহুয়ার ডালে। রোজ চুপিচুপি দেখি কেমন করে আকাশ নেমে আসে ওদের ওম-মাখা খড়কুটো বিছানায়, বসন্তের গল্প শোনায়।শুনতে শুনতে জানলার বাইরে দূলে ওঠে গাছ।আমিও নেশায় দুলি। মহুয়া নিতান্ত অপরিচিতা নয় আমার। ওর তীব্রগন্ধী সাদা মোহে ঘর ছেড়েছি বহুবার । ফুলেরা আমায় নিয়ে গেছে পাতাঝরা গাছেদের অরণ্যে। ঝরা মহুয়ার গন্ধ চিনে চিনে হেঁটে গেছি বসন্ত আবাহনের উৎসবে। রঙের আসরে। আবীর ভেবে নেশা-নেশা সুগন্ধী অন্ধকার মেখেছি সারাগায়ে।তবু মহুয়া আর আমি এক হতে পারিনি কোনদিন।।অথচ আমি তো বসন্তের অমোঘ টানকেই ভেবেছি -ভালোবাসা, তারপর ঘুম ভেঙেছে।ভোরের আলোয় দেখেছি গাছের অপাবৃত সুখী ডালে ডালে বীজমন্ত্রের মত কিছু ফুল যন্ত্রণার মাঝেও আলো হয়ে ফুটে আছে। বড়ো যন্ত্রণার এই শিকড়ছেঁড়ার ভালোবাসা। তাইতো মহুয়া এত নেশা ধরায়, এত গন্ধ ছড়ায়, এত রঙ অবহেলায় ফিরিয়ে দিয়ে শ্বেতবসনা উদাসিনী হয়ে বসন্তের কুয়াশামাখা হাওয়ার ভেতর রঙহীন তুলির টানে কার যেন মুখ আঁকে! আমার নেশা কেটে যায়। পাতায় পাতায় বসন্তের সোনারঙ আলো। নতুন আলোয় বুলবুলির সদ্যডিমফোটা শিশুদুটিকে নতুন করে দেখতে পাই। ডানা মেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে ওরা। আমি মনেমনে বলি “ওই তো তোদের আকাশ, বসন্তকেও কেমন ভরে দিলাম তোদের বুকে ওমে। যা তো পাখী, মহুয়ার নেশা কাটিয়ে একবারটি উড়ে যা দেখি”।।
Tags:
মুক্ত গদ্য