আসে বসন্ত ফুলবনে / সাজে বনভূমি সুন্দরী । / চরণে পায়েলা রুমঝুম / মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি ।। -- কাজী নজরুল ইসলাম
মানুষ আমরা মূলতঃ নিজেদের সুখ-দুঃখের সাথে বসবাস করে থাকি। আমরা প্রথমত জন্ম লাভ করি আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে। আমরা আমাদের দৃষ্টি উন্মোচন করি আমাদের বোধ জাতীয় শক্তিশালী ক্রিয়া কর্মের দ্বারা। আমাদের দেহকে তাই সজীব রাখার দায়িত্ব বর্তায় – দেখা আর শুনার মধ্যে আমাদের প্রত্যয় বাধে, বিভিন্ন দ্রব্যের স্বাদ বা ঘ্রাণ আমাদেরকে স্পর্শ করে বলে দেয় ভালভাবে বাঁচার জন্যে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে উৎকৃষ্ট জ্ঞানই বুঝি বা ভাল থাকার চাবি কাঠি, কিন্তু না, মানুষ আমরা একেবারে বাস্তবের ধরা ছুঁয়ার মধ্যে গ্রথিত নই, তাই দেখা যায় সব কিছুর মধ্যে মানুষের ঠিক সুস্থ কিনারা হয় না।
মানুষ শুধুমাত্র গুটিকতক ভাষার মধ্যেই নয়, এভাষার নিত্য সরল অর্থ ছাড়াও তার গতিতে যে অর্থ চারিদিকে লীলা করে যাচ্ছে বালুতট থেকে অনন্তের আকাশে, সেইঅর্থেরমানগত জিজ্ঞাসা মানুষকে অহরহ ইশারা করে তাকে ব্যতিব্যস্ত করেও রাখে। সত্য বা অসত্য হৃদাকাশে বিশেষ আকারে স্থান পায় বিভিন্ন পরিবেশের যুক্তি- তর্কের আবর্তে পরে, ওরা ওইভাবেই বিপরীত শব্দের দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়। প্রকৃত মানুষ বুঝে নেয় কোনটা তাদের ঘর আর কোনটা আবর্জনাতুল্য ঘর যাকে উপরে ফেলাই বাঞ্ছনীয়। তারপর মানুষ সত্যের মালমসলা গুলোকে বিবিধ প্রথায় বাধে তাদের চিন্তা চেতনার অবলোকন দিয়ে, সৃষ্টি হয় সুন্দরের জমি যেখানে ফুল ফুটিয়ে যাবার একাগ্রতার সাধনা করে যায় মানুষ। কিন্তু এখানেও ফুলের সাথে কীট রয়ে যায়, আগাছায় ভরে যায় সাধের বাগানটিতে, কখনও বা পর্যাপ্ত রোঁদ বৃষ্টির অভাবে অকালে ফুল ঝরে যায় কিংবা ফুলেরা ফুঁটিতেও বা ভয় পায় কখনও।
অক্ষর যেমন সমস্ত ভাষার হাতিয়ার তেমনি সত্য নামক চাক্ষুষ বোধ সকল সুন্দরকেই সুসংঘটিত করে। কিন্তু এই সত্য যখন লুণ্ঠিত হতে চায় মানুষেরা মধ্যে তখন দুঃখ বা দহনের তীব্র ক্ষরণ হতে থাকে। মহৎ মানুষ তাই সত্য সাধনের জন্যে ডাক দেন মানুষজনকে আর নিঃস্বার্থ এই আহ্বানে সকল মানুষ সাড়া না দিলেও তার এই মহানুভবের কাছে তারা পরাভূত হয় । কারণ তারা ততদিনে বিশ্বাস করতে পারে তাকে সাধক বা বড় বলে যে কিনা অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে সদা প্রস্তুত। আর এই মহল থেকে যে ভক্তিচেতনাটুকু আসে তা হল তাদের নিজস্ব দূর্বল দিকটা নিজেদের কাছেই উন্মোচিত হয়ে যায় বলে। সাধকের প্রতি সম্মাননার এই যে অন্তরের পূজা এ তো এক নীরব প্রাপ্তি অসদ ব্যাক্তিবর্গ হতে। যদিও তারা সাধকের কঠিন পথে পা মেলাতে ভয় পান বাস্তব অবাস্তবের প্রাপ্তি সীমার দোলায় পরে। একজন সাধকের পথ বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, কারণ সাধাকমাত্র ফলাফল আশা করেন না ভোগ করবেন বলে। তাঁরা শুদ্ধতম সত্তায় বসবাস করেন, তারা সর্বত্র ব্যাপ্ত, আমির অহং থেকে বের হয়ে বিরাট সেই মহামানব পুরুষের মাঝে তাঁরা বিস্তার করে আছেন । তাই বলা যায় তাঁরা মানব ধর্মের পথপ্রদর্শক। আমরা সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের স্বার্থের কোন কিছুর টান পরলে সেই অভাব-অভিযোগকে প্রকাশ করে থাকি। কিন্তু একজন মুনি বা ঋষিকে এই ধরণের অভাব ছুঁতে পারে না, দিতে পারার আনন্দেই তারা বিভর থাকেন। এমনকি যারা তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না তবু দেখা যাবে এই জ্ঞানী মানুষের উপস্থিতির কারণেই একযোগে সকলেরই কল্যাণ বয়ে যাচ্ছে অযাচিত প্রার্থনার ব্যতিরেকেই। সাধক মানুষ লেনদেনের তোয়াক্কা করে না , তিনি তাঁর কাজকে বিশ্বাস করেন, মতকেও, এমনকি প্রয়োজনে মতের তারতম্য করে হলেও বৃহৎ শক্তির সাথে মিলনের আরধনা করে যান। বুদ্ধির গতিতে দেখা যাবে প্রয়োজন হয়ত মিটল কিন্তু চিত্তে প্রসারতা বাধল না । তাই সাধকের পথ অতি দূর্গম । পুর্বের সাধকের দায় ছিল একাকীর এখন মানুষেরা সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজ সেবায় নিয়জিত থেকে সেই কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ইহা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আঙ্গিকে প্রকাশিত স্ব -স্ব দক্ষতার দক্ষিণায় । রাজনীতিবিদগনের বলিষ্ঠ নীতিতে আজ ঘুনে পোকা ধরে গেছে – জনগণের স্বার্থের দোহাই দিয়ে সবাই কাজে লিপ্ত। দেশকে উদ্ধারের পরিবর্তে স্বজন-প্রীতি বা নিজের আখের গুছিয়ে নেবার তৎপরতাই চলছে চারিদিকে। মানুষের উপরে মানুষের অবিশ্বাস, মানুষের পরে বিদ্বেষ, অনাচার হানাহানি ছাড়া আমরা আজ কিছুই উদ্ধার করতে পারি না এই সমাজ থেকে। দেশের মানুষের আত্মশক্তি আজ বিলুপ্ত প্রায় । রাজনীতির কর্মকাণ্ড বলতে সৃষ্টি হয়েছে স্বৈরাচারী কারখানা মাত্র। তাঁরা দেশকে উদ্ধার করতে গিয়ে মানুষকে কচুকাটা করে যুদ্ধের ময়দান লড়াইয়ের আহ্বান করছে। এর কোন সুঠামো গতি নাই বিশেষ কোন ভাল লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। নিরীহ দেশবাসীরা তাই রাজনীতিবিদদের এক বলির পাঠামাত্র নিমেষে বলা যায়। আমরা জানি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়ে তাঁর দাফন হয়েও গেছে,আমরা এখানে আশাবাদী নই।
আমাদের পুনরায় রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা দরকার রাজনীতির ছত্রছায়া থেকে বাহির হয়ে। রাজনীতিবিদগণ চান ক্ষমতা, কামনা করেন দেশ তাঁর একক মালিকানার সম্পত্তি হোক । কিন্তু রাষ্ট্রের ভাল-মন্দ আপার জনগণের শান্তির উপর নির্ভরশীল। আজ দেশের অনেক অন্ধকার কূপ স্থানে স্থানের বিপদ সংকুল হয়ে আছে কিন্তু এই অন্ধাকারের গোপন আস্থানা থেকেই আলোটা প্রজ্বলিত করতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানীদের তৎপরতা দুষ্ট -রাজনৈতিকের আওতাবিহীন হয়ে শুরু করা আশু বাঞ্ছনীয়।
পশ্চিমের দেশগুলো রাষ্ট্রতন্ত্র নির্ভর । কারণ রাষ্ট্রের শরীর থেকেই মানুষের পুষ্টি বাধা। বিজ্ঞানের স্পষ্ট আলোকে যুক্তিকেন্দ্রিক নীতিধারা সেখানে সন্নিবেশিত। দলীয় সুখের কাছে একান্ত ব্যক্তি মতামত সেখানে অরক্ষণীয়, দেশ বলতে এখানে জনগণের স্বার্থই মুখ্য। কোন ধর্মের বর্ম এখানে পরিয়ে দেওয়া হয়নি যাতে সাধারণ স্বার্থে মানুষের ব্যাঘাত করা হয় । তাই কোন ধরণের কুসংস্কারের অবগাহণে দেশ নিমজ্জিত নয়। প্রতিটি মানুষ তাদের আপন সৃষ্টির কাণ্ডারি হয়ে সমাজ তথা জাতির পরিচয় বহন করে যেতে পারছে। জনগণ রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ, রাষ্ট্রও তেমনিভাবে জনগণের অভিভাবকের পরিচয় বহন করে তাদের দায় ও অধিকারগুলোকে সুরক্ষা করে থাকে। এটিই তাদের ঐক্যকেন্দ্র। গতির তরঙ্গে ধাবমান এই পশ্চিমের সমাজ আমাদের দেশের সমাজ থেকে বহুদূর এগিয়ে আছে।বিজ্ঞানের চর্চা সেখানে যথাযথ ভাবে পালন করা হয়, যা দেশের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে বিশেষ অবদান রাখছে।
আমদের সমাজ রাষ্ট্রীয় ঐক্যের উপরে ন্যস্ত নয় বলে আমাদের পরাধীনতার মাত্রা বেড়েই চলছে। জাতীয় চেতনা আমাদের মধ্যে কমই লক্ষ্যনীয়, পাশ্চাত্যে ব্যাক্তি থেকে সমষ্টি তারপর জাতিতে চুড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে যেখানে আমাদের সমাজের পরিচয় আমাদের সভ্যতার মিথ্যা লোকাচারের মধ্যে পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। আমরা জাত-পাত-ধর্ম ইত্যাদিকে নিজেদের সভ্যতার সিংহভাগ মনে করে ঐতিহ্যের গর্ব মনে করি। আর একে অপরের সহচরের অভিনয় করলেও মিলনের ভেতরে স্বতন্ত্রের কাটাটুকু নিঃশব্দে রেখে দেই। তাই বিরাট এক ফাঁকিতে জনগণ বসবাস করেন যেখানে উচ্চ নীচের ব্যবধানের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আর এখানেই রাজনৈতিক কুন্দলের মোহড়া চলে অবজ্ঞার লাঞ্ছনা পেয়ে। পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যে তাই ক্ষুব্ধ জনতা নতুনের দ্বার খুলে দিয়ে এগুতে চায় সনাতনী নিয়মের সংস্কৃতি বা সভ্যতাকে ভাংচুর করে। বলা বাহুল্য সংখ্যালঘুর এই অত্যাচারিত মানুষের দাবীগুলো অমূলক নয়। আবার বহুদিনের সঞ্চিত সভ্যতা যা সমাজে আমূলে গেঁথে আছে তাকে অতিক্রম করে সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সৎ সাহস হয় না কারো, বিশেষত সমাজপতিরা হুমড়া চোমড়া মহলের হয়ে এই সব নথিপত্রের পাহারা দিয়ে থাকেন বলে। কিন্তু কালের একটা দাবী থেকেই যায় পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে, কোন কিছুই প্রজন্ম পরম্পরায় একভাবেই থাকার বস্তু নয় যদি না তাঁর ভীত সৎ হয়। তাই দেখা যায় বজ্র আটুনির ফসকা গির । কিছুই আর বাধন দিয়ে শৃঙ্খলিত করা যায় না। উচ্চ আর নীচ বর্ণের মিলন কিংবা ধর্মের দোহাই দিয়েও মানুষের সাথে ভিন্ন মানুষের মিলন স্তরে আর বাধা হয়ে কিছু দাঁড়াতে পারছে না, সমাজের শিকল নড়বড় হচ্ছেই। কিন্তু গাছেরা প্রবীণ হলে দেখা যায় তাঁর গুড়া অটল থাকেই মাটিকে আগলে ধরে, প্রবীণ গাছকে সরাতে হলে জল দিয়ে মাটি আলগা করে তাকেও আঘাত থেকে বাঁচাতে হয় – মনে রাখতে হবে এই সংঘর্ষ শুধু মাত্র নবীনদের মানসিক আঘাতকে হানে না বরং অনেকখানি ক্ষয়ে যায় প্রবীণদের মননশীলতাতেও । আমরা প্রকৃত শিক্ষার দরবারে যতক্ষণ আসীন নিতে না পারব ততদিন আমরা পথে এগিয়ে যাবার চিন্তা করতে পারব না। – রবি ঠাকুরের এক উদ্ধৃতি থেকে আমরা উদারতার আশ্রয় নিতে পারি --- অবিশ্বাস করিবার শক্তি মানুষের অবশ্য প্রয়োজনীয়। ইহা কেবল একটা নেতি বাচকগুণ নহে, ইহা একটি কর্তৃত্বভাবক। মনুষ্যত্বকে রক্ষা করিতে হইলে এই অবিশ্বাসের ক্ষমতাকেও নিজের শক্তি দ্বারা খাড়া করিয়া রাখিতে হয়। যিনি বিজ্ঞান চর্চায় প্রবৃত্ত তাহাঁকে অনেক জনশ্রুতি, অনেক প্রমাণহীন প্রচলিত ধারণাকে অবিশ্বাসের জোরে খেদাইয়া রাখিতে হয়, নইলে তাহার বিজ্ঞান পণ্ড হইয়া যায়। যিনি কর্ম করিতে চান অবিশ্বাসের নিড়ানির দ্বারা তাহাঁকে কর্মক্ষেত্র নিষ্কণ্টক রাখিতে হয়। এইযে অবিশ্বাস, ইহা অন্যের উপরে অবজ্ঞা বা হিংসাবশত নহে, নিজের বুদ্ধি বৃত্তির প্রতি, নিজের কর্তব্য সাধনার জন্যে সম্মানবশত । ( অবস্থা ও ব্যবস্থা )
কাজেই আমাদের দেশের স্বাধীনবার্তা পোঁছতে অধিক সময়ের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে যতদিন না একে অপরের উপর থেকে শ্রেষ্ঠতা অর্জনের মনোভাব বর্জন না করে। যে শ্রেষ্ঠতা মানুষের শ্রমলব্ধ কিছু নয় যা অহংরূপে আভিজাত্যের একাংশ রূপে দাবী করা হয় বংশপরম্পরার অনুকম্পা নিয়ে। এ যেন সেই কথা বলা - রাজার ছেলে মূর্খ হলেও মুকুটটি তাঁর মাথাতেই শোভা পেতে হবে।
কর্মস্পৃহার বদৌলতে আমাদের সকলেরই রাজার আসনে থেকেই বসে বসেখাওয়ার প্রবৃত্তি, আমাদের ঐক্যটি এইখানে এসে জোট বেধেছে ।
রিডারস ডাইজেস্টে পঠিত নেলসন মেন্ডেলার এক উক্তি থেকে উদ্ধৃত করছি – RD: YOU WERE RAISED IN THE METHODIST CHURCHAS A YOUNG MAN. HAS RELIGION PLAYED AN IMPORTANT ROLE IN YOUR LIFE ?
MANDELA: IT IS IMPORTANT TO NOT TO BE HOSTILE TO WHAT A GREATER PART OF SOCIETY HAS EMBRACED, WHEATHER AS CHRISTIANS, HINDUS OR MUSLIMS. IT IS IMPORTANT TO RESPECT THAT BECAUSE WHEATHER YOU BELIEVE OR NOT IN THE EXISTENCE OF A SUPERIOR BEING, HUMINITY DOES BELIEVE IN THEAT. FOR YOU TO BE AGAINST THAT YOU COMPLETELY ISOLATE YOURSELF AND MANY PEOPLE WILL NOT REGARD YOU AS SOMEBODY CAN LEAD THE SOCIETY. THE RELATION BETWEEN MAN AND HIS OR HER GOD IS PERSONAL MATTER; YOU CAN’T GO OUT AND CHALLENGE THE BELIEF OF PEOPLE IN A SUPERIOR BEING. (NEW ZEALAND READER’S DIGEST, APRIL 2005)
আকবর সকল ধর্মের বিভাজন দূর করে আপন হৃদয়ের দর্পনে এক ঐক্যের আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। সে আদর্শ অন্তরের প্রেমের কুড়িতে মাখা ছিল রাজনীতির পরিবর্তে। রাজা আর প্রজাতে মিলনসম্মেলনের ডাক ছিল হিন্দু মুসলমানকে ঘিরে। ১৮৯৮ সালে হিন্দু মুসলমানের পরিধানের কোট বা চাপকানের মধ্যে ঐক্য লক্ষ্য করা গেল। পোশাক পরিচ্ছদের পরিচয় ছাড়াও শিল্প সাহিত্যের উভয়ের আদান প্রদানের এত ঘনিষ্টতা ছিল যে কার অবদান কোনটি বলা দুঃসাধ্য ছিল বরং সকল পরিবর্তনের পরে বলা চলে বস্ত্র, সঙ্গীত এবং অন্যান্য শিল্পও উভয়ের মিলিত সৃষ্টি। এর কারণ উভয়ের পারস্পরিক আদান প্রদান। কাজেই জাতির শীর্ষে হিন্দু মুসলমান অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। নজরুলের গানে তাই দেখি -
মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান,
মুসলিমতারনয়নমনিহিন্দুতাহারপ্রাণ।।
আমাদের কবিগুরু চেয়েছিলেন সোনার বাংলার হিন্দু মুসলিমের সহবস্থান ঔদার্যের সহমর্মিতায়। কিন্তু শেষমেষ হিন্দু মুসলিমের পাপের মূলবিন্দুতে তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ হল। হিন্দু মুসলমানের মাঝখানে এক বিরোধ আছে – আমরা যে স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।তিনি প্রখরভাবে নিরীক্ষণ করে দেখলেন ধর্মের অমিল ছাড়া জীবন ধারণের পদ্ধতিতে, চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্র, সূচি শিল্প, নৃত্যগীতে মিলন চিহ্ন রয়ে গেছে। ভারত বর্ষের হিন্দু মুসলমান একই অঙ্গের দুবাহু। আর এই মিলনই দেশের শক্তি। জাতিকে হিন্দু মুসলমান সমান ভাবেই ধারণ করে আছে। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন হিন্দু মুসলমানের অন্য নানাবিধ পার্থক্যের সংগে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত অসাম্যজাত পার্থক্য। হিন্দু লেখাপড়া শিখেছে আগে থেকেই, সরকারী চাকুরী পেয়েছে, ফলত পার্থক্য জন্মেছে। তিনি মনে করলেন এই পার্থক্য দূরীভূত না হলে দুই সম্প্রদায়ের মনের মিল হবে না। তাই মুসলমানদের জন্যে অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত পার্থক্যের আশু বিলোপ কামনা করলেন। আর এক সময় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানেরা নিপীড়িত হত। হিন্দুরা মুসলমানদের এক মাত্র স্বার্থের তাগিদে আহ্বান করত , মনের তাগিদে মোটেই না। অপরদিকে মুসলমান রাজারাও অত্যাচারী ছিল। বলে রাখা ভাল হিন্দু কোন ধর্ম নয়, হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসেরএকটি জাতিগত পরিণাম বরং মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম।
আমাদের রবি ঠাকুর চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশের মানুষ হিন্দু মুসলমানের প্রভেদ ভুলে এক প্রাণে মিলিত হোক। কিন্তু দূর্ভাগ্যের কারণ ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়,আচারে প্রবল। অন্যদিকে ধর্মমতে মুসলমানেরা প্রবল কিন্তু আচারে নয়। রবীন্দ্রনাথের মতই কাজী আব্দুল মুসলমানদের সম্বন্ধে বলেছেন আচারে হিন্দু অনুদার হলেও অপরের ধর্মের প্রতি সে চিরদিন শ্রদ্ধাবান; কিন্তু আচারে যথেষ্ট উদার হয়েও ধর্মমতে মুসলমান অনেক বেশী গোঁড়া। বিধর্মীয় ভাষা, আচার, এসব সম্বন্ধে কৌতূহলী হওয়া তাঁর শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাইরে।
অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন এত সব বিরোধকে এড়াবার একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘ মনের পরিবর্তন, যুগের পরিবর্তন’, ‘সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তি’র এবং ইউরোপের মত উভয়ের মধ্য যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে আগমন। এ সকলের জন্যে প্রয়োজনবোধ করলেন শিক্ষার, সমস্যা সমাধানের জন্যে দরকারবোধ করলেন কালান্তরেরঃ সারসংক্ষেপে উনার কথা, ধর্মই পারস্পরিক মিলনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় । ফলে মানুষের সংগে মানুষের যে আত্মিকযোগ সরল রেখায় অবস্থান করে সেখান থেকে মানুষেরা বহু যোজন দূরে অবস্থান করছে।
আহমদ শরীফের মতে –দেশ-জাত-বর্ণ-ভাষা-নিবাস নির্বিশেষে মানুষের প্রথম ও শেষ পরিচয় যে সে মানুষ এবং স্বাধিকারে স্বপ্রতিষ্ঠ হওয়া ও থাকা তাঁর জন্মগত অধিকার ও দাবী, তা স্বীকার করতেই হবে নিঃশর্তে।
বহুল সমাদৃত পংতিটি বসন্ত উৎসবের বিশেষ বাণীর অবতারণা করছে বললে ভুল হবেনা , “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।‘ একমাত্র নারী পুরুষের নির্মল মিলনের ফলেই ঋতুর রাজা ফুলে ফলে কানায় কানায় ফলবান হয়ে ওঠে, অন্যথায় আমাদের দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হবে দহণের পবন মেখে, তবে আমাদের ফাগুনের সেই ফুল শুষ্কবনে ফুটবেই সেইপ্রত্যাশা আমাদের রইল।
Tags:
প্রবন্ধ