দোলনচাঁপা ধর







(১)

‘আমার ঘরের ভেতর ঢুকে দোর দিল ওই পুলিশ অফিসার। ওই পুলিশ অফিসার, পুলিশ পুলিশ ...’

ভবা পাগলার চিৎকার শুরু হয়েছে আবার, শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের আঘাটায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে সকলকে জানাচ্ছে আবারো। ঘটনাটা সকলের জানা, তাই পুকুরপাড়ে পাড়ার উঠতি দাদাদের সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীও কেঁপে উঠছে হাসি আর অশালীন ইশারায়। পাশের রায় গিন্নীও বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন, আমাকে দেখে বললেন ‘চৈত্র আসছে তো, মাথাটা আবার গরম হচ্ছে’ তারপর আফসোসের চুকচুক শব্দ করে ঘরে গেলেন।

পাড়ার ছেলেদের চাপে মেজবাবু বাধ্য হয়েছিলেন বিধায়কের বিরুদ্ধে পরিচারিকা নয়নতারার লিখিত অভিযোগ জমা নিতে, ধর্ষণের কেস কিছুটা হাল্কা করতেও রাজী ছিল না বিপক্ষ দলের লেলিয়ে দেওয়া হারামজাদীটা। অগত্যা আবার ওর খোলার ঘরে যেতে হয়েছিল ফারদার এনকোয়ারীর জন্য। কাজ সেরে থানায় ফিরে জানলেন গলায় দড়ি দিয়েছে ওই ছিনাল। বিধায়ক বাবু কাজে খুশি হলেও মাথা বিগড়নো ওর স্বামীটা ঢিল ছুড়ত দেখলেই, শেষে বদলী নিয়ে শান্তি। এ গল্প পুরনো হতে পারে না পুরনো হতে দেয় না এই বসন্ত। কৃষ্ণচূড়ার কুঁড়ি উন্মুখ হওয়ার আগেই ভবা জানিয়ে দেয় ‘ বসন্ত এসে গেছে ’।

(২)

মেয়েটা বরাবরের জ্বালানে, ডাক্তার ওর নাম দিয়েছে ‘মৌসম ভবন’। কোন মরসুমের রোগ বাকী নেই হতে, টাইফয়েড থেকে সদ্য উঠে এবার বুঝি পড়েছে বসন্তে। এবার ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে বাড়িময় হবে। পই পই করে বলে হেরে গেছেন সৌদামিনী যে ‘এই চৈত্রের দুপুরে রোদ্দুর লাগাস নে’ তা কে শোনে কার কথা। ও মেয়ে কি কম? সারা দুপুর হয় শানের ঘাটে নয় ছাদে... ভগবান জানে কি মধু সেখানে। 

তার নিজের দুটি ছেলে, সে তারা যেমন সভ্য তেমনই শান্ত, বাড়িতে আছে টেরটি পাওয়া যাবে না। আর এই এক মেয়ে, মেয়ে জনমের লজ্জা, এখন কিছুর থেকে কিছু হলে লোকের মুখ বন্ধ হবে? সবাই বলবে যে বাপ মা মরা দেওরঝি কিনা তাই আদর নেই কোন। পোড়ারমুখীকে সে কথা বুঝিয়েও ফল নেই, উলটে সাগু খাবে না বলে তার কত বায়না। ‘বলি তবে খাবি কি কালিয়া না পোলোয়া? মায়ের দয়া সারলে তখন রেঁধে দেব এখন’। তখন আবার আবদার ‘ছাদের থেকে মেহগিনির ফুল কুড়িয়ে এনে দাও গন্ধ শুঁকব’। 

বাটিতে জল দিয়ে তাতে বেশ কিছু মেহগনির ফুল দিতে গন্ধটা ছড়াল। ভারী চোখের পাতা দুটো না খুলেই ‘ কে রে চাঁপা নাকি? কাছে আসিস নি মা... আবার ছোঁয়াছুঁয়ি’ 

‘কথা কয়ো না বড়মা, এই আমি মশারির বাইরে বসে আছি। ছোঁয়াছুঁয়ি হবে না। তখন কত করে বললুম ও আমার তাত লেগে জ্বর, শুনলে না। সারা দুপুর শেতলা বাড়ি পড়ে পড়ে নিজে বসন্ত বাধালে তো? এখন কে সামলায়?’

দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে, সৌদামিনী তা দেখে মুখ ঘোরালেন, নোনতা জলে জ্বলছে তারও বসন্ত।



Previous Post Next Post