‘শব্দের মিছিল’ এর ‘এক মুঠো প্রলাপে’ আজ আমরা মুখোমুখি হয়েছি প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক শ্রী দেবেশ কান্তি চক্রবর্তীর । অসম্ভব প্রচার বিমূখ শক্তিশালী এই লেখকের কাছে জেনে নেওয়া কিছু বিষয় এবং পাঠককে জানান দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য ছিল । মিতভাষ লেখক অল্পকথায় হলেও অনেকটাই ছুঁইয়ে গেছেন নানা দিক অকপট । তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ । তাঁর প্রকাশ হোক সূর্যর মতন, আমাদের আলোকিত করুক , এই চাওয়া ।
আপনি কথাসাহিত্যিক , কবি , প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক হিসেবে যথেষ্ট সফল হলেও কখনো সেভাবে সম্পাদনা করেন না কেন ?

একক ভাবে লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদনা না করলেও বেশ কয়েকটা স্মরনিকা প্রকাশের দ্বায়িত্বে ছিলাম । সাহিত্য পত্রিকা না করলেও কিছু ভালো লাগা বাছাই গল্পের সংকলন করার ইচ্ছা আছে ।
আপনার প্রকাশিত উপন্যাস , ‘ষোলো ঘড়ি কথা’ র পটভূমিকা সম্পর্কে একটু যদি বলেন … বিষেশত এমন নামকরণ কেন ?

কাজের সূত্রেই নাগর নদীর পারে ছিলাম কয়েক বছর । সেখাঙ্কার কুমোর পাড়ার ‘কাদোখচা পাল’ সম্প্রদায়ের জীবনচর্যা আমাকে চঞ্চল করেছিল । ওদের ভাব- ভালোবাসা , মাটিছানা , মাটি মাখা জীবন , চাক পারাইল , হাঁড়ি পোড়া , বলী মাটি , নিবল মাটি , ঝাঁকা কাঁধে হাঁড়ি পাতিলের গাওয়াল আমাকে অন্য এক জীবনচর্যার মুখোমুখি এনে দেয় । ব্যক্তিসমীক্ষা আর ক্ষেত্রসমীক্ষা একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলতে সাহস যোগায় ! এখন ‘ষোলঘড়ি কথা’ নিয়ে আমার ভালোলাগা আর যন্ত্রনার শেষনেই । কোন একজন যখন বলেন , আর একটু ঘষামাজা করলে বাংলার একশো বছরের কয়েকটা এপিকের মধ্যে থাকতে পারতো । তখনকার মনোভাব আর আমার ক্ষুব্ধ প্রকাশক যখন বলেন আমার বইটা এমন বাজে নামকরণের জন্য বিক্রি হয় না । বইগুলো নাকি তাঁর শ্রাদ্ধে লাগবে তখন বুঝে নিতে পারি ওটা প্রকাশকের নয় আমাকে ঘুরিয়ে বলা , তখন সহ্যের সীমা ছাড়ায় । টানাটানির সংসারের টাকা থেকে নিজেই কিনে ফেলি যাবতীয় বই । ঘরে রেখে দিই , উঁইপোকা , ইঁদুরদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখি ।
আপনি অসম্ভব ভালো কবিতাও লেখেন । অগুন্তি লিটিল ম্যাগাজিনে সেগুলি প্রকাশিত । কখনো ভাবেন নি , এক জায়গায় সেগুলি গ্রণথিত করা দরকার ?

সব লেখকই তো শেষ পর্যন্ত কবিই হতে চায় । একটু আড়ের ভাষায় বলতে পারি সাহিত্য চর্চার চূড়ান্ত উত্তরণ সেখানে । অসামান্য সব লেখা , গদ্য , পদ্য , প্রবন্ধ সবকিছু শেষমেশ কবিতার মত অনির্বচনীয়তাতেই পৌঁছায় । আমি যা কবিতা হিসেবে লিখি সত্যিই তা কবিতা হয়ে ওঠে না
আপনার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রণথটি ১৯৭৭ সালে , তারপর নির্বাচিত গল্প ২০০০ এ। তারপরেও তো নিয়মিত লিখছেন , কিন্তু প্রকাশ করছেন না কেন সেভাবে ?

আমার লেখালেখির শুরু চল্লিশ বছর আগে । বই বেরিয়েছে মাত্র তিনটি । একটাও সুসম্পাদিত নয় । এমন দুরবস্থা ইচ্ছে করে নয় , নিরুপায় তাই ! প্রথমে লেখার জোর লাগে , না হয় টাকার জোর । আমার কোনোটাই নেই । আরও তিনটা উপন্যাস তৈরী হয়ে আছে । কিন্তু সেজেগুজে তৈরী হয়ে থাকলেও কে তাদের হাত ধরে মেলায় নিয়ে যাবে ! ওদের সাজ নষ্ট হচ্ছে , বিরক্তিতে ওরা ভরে উঠছে ।
আপনার কর্মজীবন অতিবাহিত হয়েছে গ্রণথাগারিক হিসেবে । এই জীবিকা কি কোনোভাবে সাহায্য করেছে আপনার সাহিত্য জীবনকে ?

পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একটা ভাঙ্গা টিনের ঘরে সেলাই মেশিন নিয়ে বসেছিলাম । চাকরি পাওয়ার আশাই ছিল না । সেইসময় কয়েকজন সত্যিকারের বন্ধু আমার জীবন্টা একটু অন্যরকম করে দিতে সাহায্য করেছে । বাড়ির মানুষজনের সহানুভূতি পেয়েছি । আরও কিছু সুহৃদ সুজন আমাকে সংস্কৃতির জগতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে । এখনও করে । মাঝেমধ্যে অনেক উল্টোপাল্টা কাজ করে ফেলি । সেই আমি একজন ভালমানুষ হতে চাই ।
আপনি উত্তরবঙ্গের ভূমিপূত্র । এটা কি প্রতিবন্ধক হয়েছে কোনোভাবে ? আর যদি সহায়তা করে থাকে , তবে কিভাবে ?

আমার জন্ম উদয়পুরেই । এলাকা ভাগাভাগির প্রয়োজনীয়তা ও নিষ্ঠুরতা আমাদের দিকে তর্জনী তুলে ভূমি চিহ্নিত করে দিয়েছে । সেই নিরিখে আমি একজন ভূমিপূত্র । তবে ভূমিপূত্র হওয়া না হওয়ার সঙ্গে সৃজনশীলতার খুব বেশি একটা যোগ নেই । যে জন্মালো সে কতটা বাঁকা চোখ আর ভেতরের বোবা কান্না নিয়ে জন্মালো সেটাই বড় কথা । উত্তর মালদার এক গ্রামে প্রায় বারো বছরের বসবাস আমার সাদামাটা কলমে অনেকটা অন্যরং ঢেলে দিয়েছে । জালালপুর না গেলে কোনোদিনই ‘নোনা নদীর বাঁকে’ লেখা হোত না । নাগর পারে থাকতে না হলে লেখাই হোত না ‘ষোলঘড়ি কথা’।
আপনি তো বর্তমানে ‘উত্তরের সারাদিন’ এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন । এই কাজটা কি অনেকটাই সময় নিয়ে নিচ্ছে না আপনার লেখালেখির ? নাকি এটা একপ্রকারের সংযোগ স্থাপন করছে আপনার লেখার চরিত্রদের সাথে ?

লাইব্রেরির কর্মজীবন থেকে অবসরের পর একটা দৈনিক কাগজে কিছু কিছু সাংবাদিকতার কাজ করছি । খুব পুরোদস্তুর না । খবরের কাগজে স্টোরি বলতে যা বোঝায় ছোটগল্প ঠিক তা নয় । নির্মিতিটা একেবারে উলটো । খবরের ‘স্টোরি’ তে মোদ্দাকথাটা দিতে হবে আগে । এমনকি ব্রেকিং নিউজের শিরোনামটাই মোদ্দাকথা হতে পারে । ছোটোগল্পের মোদ্দাকথা সবার শেষে । ছোটোগল্পের শিরোনাম থাকে আড়ের ভাষায় । স্পষ্টকথাটা গল্পের শেষলাইন পর্যন্ত না পড়লে জানতে পারা যায় না । ব্যক্তকথার দৃষ্টিভঙ্গি দুটো আলাদা ।
সাহিত্য জগতে কিভাবে এলেন ? বিশেষ কারুর অনুপ্রেরণায় নাকি আত্মোপোলব্ধি প্রকাশের তাগিদ ?

আঠারো উনিশ বছর বয়স থেকে গল্প প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার ঝোঁক থেকে গল্প লেখার শুরু । বাড়ির মানুষ আমার অন্য সব বিষয়ে সচেতন থাকলেও কখনোই আমার লেখালেখিকে এতটা গুরুত্ব দেন নি । কখনো সময় নষ্ট করছি ভাবা হোত । অর্থাৎ আমার সময় নষ্ট করাটা বাধ্যতামূলক সয়ে নিতে হয়েছে সবাইকে । আমার নষ্ট সময়ের ফসল সম্বন্ধে তেমন কৌতূহল না থাকলে সয়ে নেওয়া ছাড়া আর কি বলা যায় ? তবে শুরু থেকেই আমার কিছু বন্ধু , মহাবিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক , অধ্যাপিকা উৎসাহিত করেছেন । ক্লাসের লাস্টবেঞ্চের ছাত্র ছোটগল্পে পুরস্কার পেয়ে দেহভঙ্গি পালটে গেছে । কিন্তু আমার ভেতরে গল্প শোনা আর গল্প বলার আজব ক্ষিদেটা তৈরী করে দিয়ে গেছেন আমার মা । আমি কোনোদিন গল্প লিখবো সেজন্য নয় , ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো সেজন্য । অসম্ভব সুন্দর করে গল্প বলতে পারতেন আমার মা । তাঁর বেশিরভাগ গল্পের ধরতাই শুরু হত এভাবে- ‘শিব দুর্গা যায় কৈলাশে…’।
আপনি অনেকবার সম্বর্ধিত হয়েছেন , সাহিত্য পুরস্কার ও আছে তিনটি , কিন্তু তিন্টেই উত্তরবঙ্গের । কখনো মনে হয়না, দক্ষিণ আপনার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে দেরী করছে , আপনি সেভাবে প্রচারের আলোয় আসতে চান না বলেই ?

আমি খুব অল্পে তুষ্ট মানুষ। এই অল্পে তুষ্ট থাকতে শিখিয়েছেন আমার মা । এতাই আমার সুখি থাকার কারণ। পুরস্কার পেতে ভালোই লাগে । নেব না এমন গোঁড়ামি নেই । তবে , পরে মনে হয় আদৌ কি আমি এইসব সম্মানের যোগ্য ছিলাম? আমার মত এত দোষে ভরা মানুষ যদি পুরস্কার ও সম্বর্ধনার জন্য বিবেচিত হয় তবে দুনিয়াতে পুরস্কার নেবার মানুষেরই আকাল পড়েছে বলে মনে হয় । উত্তরবঙ্গের কোচবিহার , দার্জিলিং ( শিলিগুড়ি ) , মালদা এবং নিজের জেলায় পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছি । আমি খুশি । অনেক পাওয়া হয়েছে । পুরস্কার যেমন ভাল আবার ভারী বোঝাও । অল্প – স্বল্পই ভাল , বোঝা কম !
এতটা বয়সে আমার বিশ্বাস জন্মায় গল্প আসলে দুজনের ব্যাপার । শিব গল্প বলেন , শোনেন একমাত্র শিবানী । গল্প একজনই বলেন , একজনই শোনেন , একজনই দাতা একজনই গ্রহীতা । এই দান – গ্রহণের তন্ময়তার মধ্যে তৃতীয় জন কি করে সম্ভব ? বই কিন্তু এই অসামান্য কাজটা করতে পারে । যেখানে কথক শিব শ্রোতা শিবানী । অন্য কেউ থাকে না ।
আপনি যত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখে অপ্রকাশিত ফেলে রেখেছেন , ধরুণ কোনো কারণে সেগুলি নষ্ট হয়ে গেল । তখন আফসোস হবে না ?

ছয় সাতটা ছোট বড় উপন্যাস । ছোট বড় তিন চারশো গল্প যদি গ্রন্থাকারে প্রকাশ না হয় তবে বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমার একারই খারাপ লাগবে । আমার একারই বুক পুড়বে । কারো কিছু যাবে আসবে না । সাহিত্য পাঠের প্রাপ্তিটার যেহেতু শরীর নেই তাই অন্য কারো মনে আমার লেখা পড়তে না পারার জন্য বঞ্চিত বোধ করার অনুভূতি কখনোই জাগতে পারে না । যে কারো একটা ভালো লেখা পড়ার পরই মনে হয় না পড়লে বঞ্চিত হতাম । যে লেখা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই কারও তৈরী হল না সে লেখা সম্বন্ধে কারও কৌতূহল থাকতেই পারে না । দুটি অর্থেই অপ্রকাশের বেদনা লেখকের একার । মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই বেদনারও শেষ । ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ বা ‘কালের মন্দিরা’ না পড়লে আমি ভীষন ‘মিস’ করতাম । অথবা ‘রেজারেকশান’ না পড়লে জীবন বৃথা হোত । একথা কিন্তু পড়ে ফেলার পর ভাবছি । যারা পড়েননি তারা জীবন বৃথা বলে ভাবতে যাবেন কেন ? এরকম কত অসংখ্য ভালো কিছু আছে যেগুলি পড়া হয়না বলেই আমাদের ভাল-মন্দ যে কোন অনুভূতির বাইরেই সেগুলো রয়ে যায় ।