দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী






পড়ন্ত বিকেলের এক মুঠো সোনালি রোদের উষ্ণ অনুভূতিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দুচোখ ভরে দেখছি অস্তমিত সূর্যকে ।  বাঘমুন্ডি পাহাড়ের মাথায় আজ ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা, বেলা শেষের রক্তিম আভা কৃষ্ণ বর্ণের সাথে মিলে গাড় বেগুনি রঙ ধারণ করেছে । তৃষা,আজ আমি বসে আছি একটা টিলার ওপর প্রহরীর মতন দাঁড়িয়ে থাকা এক শিমুল গাছের নিচে । গাছটার সাথে আমার বেশ মিল আছে জান !! আমি জানি তুমি ঠিক বুঝতে পারবে , তুমিই বুঝতে পারবে মিলটা ঠিক কোন জায়গায় । গাছটা শীতের নির্মম হিমেল হাওয়ার ধাক্কা আর নিতে পারেনি। ওর সব পাতা ঝড়ে গেছে। সে আজ প্রতীক্ষায় বসন্তের। বেলা শেষে এক বৃদ্ধের আত্মিক আকুতির সাথে এক গাছের অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে জেগে আছে আমার মাথার ওপর গজিয়ে ওঠা লাল শিমূল গুলোর মধ্যে ।

শিমূলের রক্তিম বর্ণ.....হুম....যাক সে কথা । আজ হাওয়াটা অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি,আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দিচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাষ । খাতার পাতা গুলো চটপট চটপট আওয়াজ করে উড়ছে । না আর লেখা যাবে না ।

পাহাড় থেকে নেমে আসতেই চোখ পড়ল পাহাড়ের নীচের অঞ্চলটা । গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়া,শিমুল,পলাশ ফুটে আছে। ফসল কাটার পর চাষের জমি গুলো ফাকা পরে আছে । তার ওপর বেলা শেষের আলোটা পরে মনে হচ্ছে প্রকৃতি আবির খেলায় মও । থোকা থোকা আবির পরে আছে চারিদিকে । বাঘ মুন্ডির মাথায় আজ কালো মেঘের ঘনঘটা ।  মহাকবি কালিদাসের লেখা কয়েকটি লাইন মনে পরে যাচ্ছে ...

"কোন যক্ষ অভিশপ্ত হয়ে কর্ম্মদোষে।
মহিমা বিগত একবর্ষ প্রভুরোষে।।
বিরহের গুরুভারে দয়িতের সনে।
মুহ্যমান হয়ে রয় রামগিরি বনে।।
হেথা তরুগণ তোষে স্নিগ্ধ ছায়া দানে।
জলধারা পুণ্যময়ী জানকীর স্নানে।"

নিজেকে আজ নির্বাসিত যক্ষ মনে হচ্ছে । সে কথা নাই বা লিখলাম তোমাকে । বেশ খানিকটা নামতে হবে, তবে পুরোটাই উঁচু নিচু পাথুরে পথ, একটু পা এদিক ওদিক ফেললে সর্বনাশ একেবারে যাকে বলে মায়ের ভোগে । বুঝেছ তৃষা,এই হচ্ছে আমার জীবনযাত্রার চালচিত্রে একটু ঝলক তোমাকে দিলাম। পুরুলিয়ার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও শহুরে হায়েনাদের থাবা না বসায় এখানে আরণ্যকের আদিম চিত্রটি এখনও অটুট । তাই এখনও এখানে পাহাড় কেটে রাস্তা কিংবা পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একখানি সঁপিসের মতন মন্দির কোনটাই তৈরি হয় নি । আজ অনেকটা পথ হাঁটলাম, টিলাকে পেছনে ফেলে এখন আমি রুপাই নদীর ধার দিয়ে হাঁটছি,এখান থেকে আমার পর্ণ কুটীর মিনিট দশেকের হাটা পথ। একটু দাঁড়াই বরং এখানে, রাত নেমে এলো প্রায়, অরণ্যের গাছপালা, রুপাইয়ের জল গাঁড় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে, প্রকৃতি দেবী আপন খেয়ালে গা ঢাকা দিয়েছেন অরণ্যের বুকে । রাধা আর কৃষ্ণের পরকীয়ার মতন এ এক অদ্ভুত খেলা । রুপাই কিন্তু থেমে নেই, কি অদ্ভুত নাম তাই না রুপাই,  তোমার প্রিয় কবি জসিমুদ্দিনের মানস পুত্র রুপাই ছুটে চলেছে তার বিরোহিনী সাজুর উদ্দেশ্যে । রুপাই এর কল কল শব্দ এই অন্ধকার আরণ্যক প্রকৃতির মাঝে রাগ আহীর ভৈরব এর মতন অন্দ্রীয় ইন্দ্রজালিক বাতাবরণ তৈরি করেছে । এই হাত দুটি আজ দুটো শাঁখা পলা পড়া হাতের স্নিগ্ধ স্পর্শের আকাঙ্ক্ষায় আকুল । ফেরা যাক, অন্ধকারে আজ চলাফেরা করতে একটু অসুবিধা হয় । বেলা শেষের এই মূহুর্তটা আমার কাছে খুব প্রিয় । এই সময় পোকা মাকড় গুলো নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করে । দূরে কোন এক শাল গাছের মাথায় বসে কোকিল দম্পতি ডাকছে,মনে হচ্ছে ওরা ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে। ঝগড়ার মধ্যেও লুকিয়ে আছে গভীর ভালোবাসা ।

একটা মজার কথা বলি তোমায়,আজকাল খুব ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে । তুমি তো ভীষণ শান্ত , তোমার সঙ্গে তো ঝগড়াও করতে পারব না, তা শূন্যে ঢিল ছোড়ার মতন হবে । কি ঠিক বললাম তো ।  আজ মঙ্গল শহরে গেছে । মঙ্গলকে মাঝে মধ্যেই শহরে যেতে হয় এই বুড়ো মানুষটার রসনা তৃপ্ত করার আয়োজন এর জন্য । ও কাল ফিরবে । পুরুলিয়া শহর থেকে শিমলিবনি আসার পথটা খুব একটা নিরাপদ না । পাহাড়,শাল বনে ঘেরা এ পথ বসন্তে আরও রঙ্গিন হয়ে ওঠে । পথের দু পাশে শুঁকনো শাল পাতা সোনালি রং এর পার্শি কার্পেটের মতন বিছিয়ে থাকে । শুঁকনো পাতার ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম জঙ্গলি ফুলের গাছে নানান রং এর ফুল ফুটে থাকে,দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন কার্পেটের ওপর রঙ্গিন সুতার সূক্ষ্ম কাজ ।  কিছুটা যাবার পর পথের দুই ধারে যত দূর যায় শিমুল,পলাশ,কৃষ্ণচূড়া অগ্নি বর্না হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতুরাজের প্রতীক্ষায় ।এক এক জায়গায় এক এক রকম গন্ধ, কোথাও মহুয়ার মাতাল করা গন্ধ, কিছুটা দূর গেলে আবার কচি সজনে ফুলের গন্ধ, সকাল বেলার দিকে যখন সূর্য ওঠে সেই সময় আরেক রকমের গন্ধ, অনেকটা ভাজা তরকারির মতন ।এই অঞ্চলের মাটিতে খনিজের পরিমাণ অন্য অঞ্চলের চেয়ে একটু বেশি,সরা রাত শিশিরে সিক্ত মাটিতে যখন সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পরে,ঠিক তখন এই গন্ধটা বের হয় । যে কথাটা বলছিলাম, পথটা খুব একটা নিরাপদ নয় ।প্রকৃতির আদিম আরণ্যক সত্ত্বার মাঝে বাসা বেঁধেছে কিছু বিকৃত স্বার্থান্বেষী হায়নার দল,যারা  যারা শাসক গোষ্ঠীর অবহেলার শিকার বঞ্চিত,লাঞ্ছিত আরণ্যক মানুষদের তাঁদের হাতিয়ার বানিয়ে মুনাফা লুঠছে । জর্জ অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্মের মতন অনেকটা । আজকাল জঙ্গলের ভেতর থেকে বারুদের গন্ধ আসে ।

কাল পয়লা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন,শীতের রিক্ততা মুছে দিয়ে প্রকৃতি জুড়ে আজ সাজ সাজ রব রব । বিবর্ণ প্রকৃতিতে নবীন জীবনের ঢেউ । প্রকৃতি সাথে সাথে হৃদয়ও আজ আন্দোলিত। আমরা বলছি ," এতটুকু ছোঁয়া লাগে,এতটুকু  কথা শুনি "। মনে আজ দোলা লেগেছে , ফুল ফুটবার এই বসন্ত দিনে " ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল "। সবকিছুই বলছে আজ মিলনের দিন । এই আশ্বাসেই প্রণয়কাতর মন ব্যাকুল হয়ে আছে প্রিয়মুখের দু একটি কথা শোনার জন্য , একটু স্পর্শের জন্য ।" আহা সুখের বসন্ত , সুখে হয় সারা "।

মন আজ বড়ই উতলা । মহুয়ার নেশায় আবৃত শরীর বন্য হরীনীর স্পর্শে আন্দোলিত হতে চায় । তোমাকে আমি শিমলির কথা লিখেছি, শ্যামলা মেয়ে শিমলির শরীরের গঠনটা অনেকটা খাজুরাও এর মন্দিরের উত্থিত স্তন পূর্ণ লাস্যময়ী এক যুবতির মতন । ওর শরীরের খাঁজে খাঁজে বইছে মদিরা ।

বধূয়া আমার সারা দিনের কাজকর্ম দেখাশুনা করলেও আমার রাতের খাওয়ারটা শিমলির হাতেই তৈরি চাই, না হলে প্রেমময় বোসের রসনা তৃপ্ত হয় না । মঙ্গলের বৌ এর এটুকু সেবা তো আমার প্রাপ্য,কি বলো তৃষা ? এর জন্য মোটা টাকা আমি ওকে দিই । দিনের বেলা আমি এদের দাদু,কিন্তু রাতের মায়াবী আরণ্যক অনুভূতি আমাকে আদিম খেলায় লিপ্ত হওয়ার প্রেরণা  দেয় ।

আজ আমার  নেশাটা একটু বেশি হয়ে গেছে । শুঁকনো পাতায় খসখস শব্দ হচ্ছে । মহুয়ার গন্ধ আরো তীব্র ভাবে আসছে,শিমলির স্তনের ভাজে একটা কালো তিল আছে,ওখান থেকে এই গন্ধটা ভেসে আসে, আদিবাসী মেয়ের ঘামের গন্ধ ।  আজ এটুকু , কাল আবার লিখব ।

লেখা রেখে প্রমময় বোস উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে,তারপর খুলে দিলেন দ্বার । আজ জঙ্গলে বৃষ্টি নেমেছে, অনেকদিন পর আজ জঙ্গলে বৃষ্টি নেমেছে,চারিদিক থেকে অদ্ভুত সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে নাকে । ঝম ঝম করে বৃষ্টি পরছে, বর্ষণ সিক্তা লাস্যময়ী পূর্ণ যৌবনা সিমলি ঘরে প্রবেশ করল ।  প্রেমময় বোস দ্বার দিলেন ।

পুলিশ আসতে একটু দেড়ি হল আজ । জঙ্গল মহলে এ নতুন কিছু না । তাও বেলা বারোটা বেজে গেছে । কাজের মেয়েটা বারান্দায় বসে কাঁদছে । দারগা বাবু এসে প্রথমে ওকেই পাকড়াও করলেন,"কিরে তুই তো থাকতিস বাবুর সাথে, সত্যি কথা বল ।"

- সত্যি বাবু, আমি কিচ্ছু জানি না ।  সকালে বাবু নিজেই ঘুম থেকে উঠেন নি ।
- তুই ভেতরে ছিলি নাকি ? দরজা তো খোলাই ছিল ।

বধূয়া ছুটে এসে বলল, বাবু, ও সত্যি কিছু জানে না, দাদুর বয়েস হয়েছিল, তাই রাতে আমরা  দাদুর সাথে শুই । কখন কি হয়,এই জন্য দাদুই আমাদের থাকতে বলেছিলেন । সিমলির সবার আগে ঘুম ভাঙ্গে, তাই অন্য দিনের মতন ও আজও দাদুকে ঘুম ভাঙ্গাচ্ছিলো ।

একটা কনস্টেবল এসে বলল, গন্ধ বেরিয়ে গেছে ।  দারোগা বাবুর আদেশে কয়েকজন থানার স্টাফ এসে মৃত প্রেমময় বোসকে গাড়িতে তুললেন । বেরিয়ে যাবার সময় দারোগা বাবু সিমলিকে একবার ডেকে দৃষ্টি খিদে মিটিয়ে থানায় দেখা করতে বললেন ।  মঙ্গল একটু আগে ফিরেছে শহর থেকে, সে বাবুর সাথে মরকে গেছে ।

পরেরদিন জঙ্গল দর্পণে একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হল, দীর্ঘ ৩০ বছরের আরণ্যক জীবন অতিবাহিত করে আজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন  জঙ্গল দরদি ৭২ বছরের প্রেমময় বোস ।

প্রকৃতি  আজ সেজেছে তার নতুন রূপে। গাছে গাছে ফুল ফুটুক আর নাই-বা ফুটুক, বসন্ত তার নিজস্ব রূপ মেলে ধরেছে। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে প্রেমময় শায়িত আজ নিমতলা শ্মশানে,পুত্রের মুখাগ্নি শেষে প্রজ্বলিত রক্তিম অগ্নি বর্ণ আজ ধারণ করল বেলা শেষের বসন্তের শিমুল পলাশে আর পরে থাকল প্রেমময়ের প্রেমপঞ্জী যা সে নিবেদন করে গেছেন তার শেষ বেলার তৃষাকে ।




Previous Post Next Post