আজ পূর্ণিমা। সমুদ্রের পাগলপারা রূপ দেখতে দেখতে বুকের আরও কাছে নিখিল জড়িয়ে নিল তৃণার নরম শরীরটাকে। তৃণা ফিসফিসিয়ে বলল, " ছাড়ো!"- তারপর সব নিঃস্তব্ধ..
রাত এখন প্রায় ৯টা। সমুদ্রের পাড় আস্তে আস্তে খালি হয়ে যাচ্ছে। পুরীতে এই নিয়ে অনেকবার এসেছে তৃণা, কিন্তু এবারটা যেন হঠাৎ করে নিখিলের আচমকা পাগলামিতে চলে আসা..
তন্ময় ওদের একমাত্র সন্তান। সর্বস্ব দিয়ে বড় করে তোলা একমাত্র বুকের পাঁজর। এখন মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশে বাস।প্রতিবছর এই সময়টা অপেক্ষায় থাকে তৃণা আসবে ছেলে - কি যে অপেক্ষা - ছ'মাস আগে থেকে ক্যালেন্ডারে দাগ দিতে থাকে। ফোন করলেই ওই এক কথা, ' আসছিস তো বাবু?'-
স্বদেশের মেয়ে মনে ধরে নি তন্ময়ের। ওখানেই সংসার।বিয়ে করে যাকে বলে 'সেটেল্ড'। একসাথে একই অফিসে কাজ করত তন্ময় আর লিসা। সেই থেকেই বন্ধুত্ব, পরিণতি বিয়ে। তৃণা বা নিখিল কেউই অবশ্য খুব কনজারভেটিভ নয় কোনোকালেই। তবে লিসার এই কলকাতায় আসার আপত্তিটা বড় কষ্ট দেয় ওদের, বিশেষ করে তৃণাকে। গত বছরও আসে নি ছেলেটা। নানা অজুহাত দেয় - কাজের অজুহাত, শরীরের অজুহাত...
তৃণার শরীরটা আজকাল বিশেষ ভাল যায় না। কেমন মনমরা হয়ে থাকে সবসময়। কিই বা কাজ- দুজনের সংসার। এবারেও খুব চুপচাপ ছিল তৃণা। মনে মনে জানতই ছেলেটাকে এবারেও দেখতে পাবে না সে। ভিডিও কলে যতোটুকু দেখেছে লিসাকে - তন্ময়কে। ' বাবু ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করিস- খুব রোগা হয়ে গেছিস'...বলতে বলতেই ডিসকানেক্টেড হয়ে যায় কল- তারপর নীরবে তৃণার চোখের জলের সাক্ষী থাকে বালিশের কোণ আর রাতের অন্ধকার। নিখিলকে একদম বুঝতে দেয় না তৃণা, এই তো ক'মাস হল মানুষটার হার্ট- সার্জারী হয়েছে। এসব মানসিক উত্তেজনা একদম ঠিক নয় ওর জন্য।
" চল, এবার উঠি, ঠাণ্ডা লাগবে"- বলতে বলতে গায়ের চাদরটা আস্তে করে জড়িয়ে দিল তৃণা নিখিলের বুকের ওপর। নিখিল আরও কাছে, আরও কাছে টেনে নিল তৃণাকে- নিখিলের হৃৎপিন্ডের শব্দ আজ যেন বড় স্পষ্ট করে শুনছে তৃণা.. আস্তে করে চিবুকটা নিখিলের বুকের ওপর রেখে তৃণা এবার চাইল নিখিলের মুখের দিকে..কাঁচা-পাকা চুলে আর সরু ফ্রেমের চশমায় তার প্রেমিক স্বামীটি আজও কাঁপিয়ে দিয়ে যায় তার বুক।
নিখিলের হাতে একটা হার্ট- শেপের তুলোর টুকরো - হঠাৎ এগিয়ে দিল তৃণার দিকে - তৃণা কিশোরীবেলার মতো গালে টোল ফেলে বলল, " ইস্, বুড়োর তুলতুলে হৃদয়! "... হাওয়ায় গুঁড়ো চুলগুলো কপালে এসে পড়ছে তৃণার - নিখিল খুব আদুরে সুরে বলল, " ওহে বধূ, বুঝলে না, বুঝলে না".. তৃণা আরও জোরে হেসে বলল, " কি ছেলেমানুষি হচ্ছে? চলো ফিরি"...
হঠাৎ একলাফে ছিটকে একটু দূরে পড়ে থাকা একটা ছোট বোতল কুড়িয়ে আনল নিখিল- তৃণা একটু ধমকে বলল," এই এটা আবার কি? নোংরা ঘাঁটছো কেন বলো তো!"- নিখিল হার্ট- শেপের তুলোটা স্বযত্নে ভরল বোতলের ভেতর তারপর ছিপিটা বোতলের মুখে শক্ত করে আটকাতে আটকাতে তৃণার মাথায় নিজের থুতনিটা ঘষতে ঘষতে বলল, " চলো, ভাসাই"..
তৃণা এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিখিলের দিকে - লোকটাকে সেই ১৭ বছর বয়স থেকে চেনে সে- কি অসম্ভব দামাল,মেজাজী মানুষ আর কতোটা পাগলামিতে ভরা সবই তার জানা - নিখিলের চোখে চোখ রেখে আদুরে হয়ে বলল, "কি ভাসাবে শুনি?"..নিখিল এবার তৃণার কানের কাছে মুখটা নিয়ে এলো " ওই যে রাতের অন্ধকারে তোমার যে মনটা শুধু 'ছেলে-ছেলে' করে - ভুলে যাও, তুমি একা নয়, তোমার কান্না আমার বুকে ধাক্কা মারে - তোলপাড় করে আমায় - সেই মনটাকে চলো আজ ভাসাই দুজনে"....
তৃণার চোখ ঝাপসা - সত্যিই তো, কখন যে প্রেমিকা - স্ত্রী সব পেরিয়ে সে শুধুই মা হয়ে গেছে - নিখিলের বুকে নিজের মুখটা গুঁজে চুপ করে রইল তৃণা -নিখিল তৃণার কপালে নিজের ঠোঁট আলতো করে বোলাতে বোলাতে বলতে লাগল, " তুমি একা নয় সোনা, আমি যে এখনও আছি "- বলতে বলতে ছুঁড়ে দিল বোতলটা সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ এর ওপর..
তারপর শুধু ঢেউ আর ঢেউ - ভেসে যাচ্ছে মনমরা মনের যতো কান্না আর বয়ে আনছে এক তৃপ্তি, শান্তি - চিরশান্তির আশ্রয় - বাতাসে এখন শুধুই গুনগুন - 'আছি-ছিলাম-থাকব'.......
পরিচিতি
পরিচিতি
Tags:
গল্প