আমাকে তোমরা হত্যা করেছো,' নিশা প্রথমবার বলেছিলো তার বাবা-মা কে । তোমরা নির্ধারণ করে দিয়েছো, আমি কি করবো? কোথায় যাবো? কি পড়বো! ম্যানার শেখাতে শেখাতে ভুলে গেছো, আমি রক্ত মাংশে তৈরি! আমার স্বাধীনতা নেই, বেছে নেয়ার ক্ষমতা নেই, জড় পুতুল বানিয়ে রেখেছো এতদিন! আর, এখন বলছো, পাত্রপক্ষের সামনে জরদগব হয়ে ভদ্রভাবে বসে থাকতে! তারপর নিশা নদীর ডাক শুনলো, একদিন ছুটে গেলো । সেখানে সুন্দর বসে ছিলো ভয়ংকর হয়ে। নিশা সুদর্শন শিকারীর রূপে মুগ্ধ হলো । তারপর অগুণতি ঢেউ তীরের সবটাই প্লাবিত করে নিয়ে গেলো একদিন ।
রেবা ছিলো জন্মযোদ্ধা। জমজ ছিলো তার, রেবতী আর নবনী । লাংস ভর্তি পানি নিয়ে জন্মেছিলো দু'জন । নবনী একমাস দশদিন বয়সে ঝরে গেলো, রেবতী টিকে গেলো ধুকপুক করে । যুদ্ধটা গেলো না । অতনু মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরেনি, তবে একটা সংবাদ এসেছিলো; মরণপন ক্ষেত্র থেকে লড়ে ফিরতে না পারার সংবাদ । তিনটে সন্তান কে নিয়ে ঝি-গিরি থেকে দেহব্যবসা সবই করেছে রেবা । এই মূহুর্তে সে অবশ্য কোনো গূরুত্বপূর্ণ সংবাদ নয় । রেবতি বিশ্বাস, বয়স পঁচাশি, আশ্রয় বৃদ্ধনিবাস ।
আলেয়া অভাব দেখেনি, কোনোদিনও না । মফস্বলের মেয়েরা যখন একটু ঢেকেঢুকে চলতো, আলেয়া পরতো চোলি-ঘাঘরা, জিন্স-টপস কিংবা হাল ফ্যাশনের যে কোনো পোষাক । মেয়েরা তাকে এড়িয়ে চলতো, মহিলারা নোংরা কথা ছড়াতো আর ছেলেরা ভয়ে পালাতো । এসব কিছু অতিক্রম করে একদিন এক সন্ন্যাসীর ধ্যান ভাঙাতে আগ্রহী হয়ে উঠলো সে। জীবনে প্রথমবারের মতন ফাদার ক্যানজেল টমাস তার ক্যাথলিক আদর্শ ভুলে কৌমার্জ বিসর্জন দিলেন আলেয়ার কাছে । পরবর্তী সংবাদ ছিলো, ফাদার টমাস গির্জা থেকে চলে গেছেন । এর পরে জানা গেছে, আলেয়া এবং টমাস কেউই এই ছোট শহরে নেই । পরবর্তী কোনো সংবাদ আমাদের এই নিস্তরঙ্গ শহরে আর আসেনি ।
দিনার বাবার সবচেয়ে অপছন্দের ভাষা বাংলা । তার কথায় উর্দুর পরিমাণ বেশি । তিন ছেলে অবশ্য আমেরিকা এবং কানাডায় থাকে । মেয়েকে পড়িয়েছেন মাদ্রাসায়, দাখিল পাশের পর ঘরের কাজে মগ্ন হয়েছে সে । সামনেই দিনার আব্বাজান তাবলিগে যাবেন, পাত্র পছন্দ করাই আছে । তাবলিগ থেকে ফিরেই দিনার বিবাহ সম্পন্ন করবেন তিনি । পিতার তাবলিগে যাওয়ার পরদিন এলো তার বড় ভাইজানের চিঠি । ভাইজান বিয়ে করেছেন এক শ্বেতাঙ্গিনী কে। কি অপরূপা, সুভানাল্লাহ! স্কিনটাইট জিন্স আর শার্ট পরে ভাইয়ের বগলদাবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! দিনা মুখ খুলতে চাইলো, মা এসে ছোঁ মেরে চিঠিটা নিয়ে বললেন, 'নালায়েক, তুমহারা আব্বাজানের ইজাজাত ছাড়া খত খুলেছো?' দশ বছর পর দিনার কথা বলেছিলো জাহেদা । সাত সন্তান এবং বোরখাবন্দী জীবনে দিনা এমনভাবেই হারিয়ে গেছে যে, তার চোখদুটিও আর দেখা যায় না...
রেমিজার ঘুম কম, তারওপর, এই ভাদ্র মাসে টিনের বেড়া দেওয়া বস্তিঘর! তিনটে ছেলেমেয়ে নিয়ে সে সারারাত ছটফট করে, স্বামী কুদ্দুস চোকদারের এইসব অনুভূতি নাই, প্রতিরাতেই আকন্ঠ বাংলা মদ পান করার পর নাক ডেকে ঘুমায় সে । মাঝে মাঝে, গরিবী এন্টারটেইনমেন্ট হেতু রেমিজা কে ছানাছানি করে, তিন বছরে তিনটে ছেলেমেয়ে । ছোপ ছোপ অন্ধকারে বাচ্চা তিনটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের বাপ মায়ের কথা মনে পড়েl অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ঘর, দুইজন সুখি মুখ, পাঁচ ভাইবোন । সবকিছু ছেড়ে এই নেশাখোরের সঙ্গে কেনো পালিয়ে এলো সে? যদি বাড়ি বাড়ি কাজ করেই খেতে হয়, তাহলে এই মরদ কোন কাজের! পরদিন সকালের আলো ফোটার আগেই দেখা গেলো, রেমিজা এবং তার সন্তানদের শয্যা শূন্য । মাতাল শুয়োরটার টাকা পাওয়ার উৎস পালিয়েছে ।
ঋষভ বিয়ে করছে, খবরটা শুনে যতটা না ধাক্কা খেলো নিবেদিতা, তারচে’ অনেকবেশি আঘাত পেলো। সপ্তাহ পার না হওয়া সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে । খুব যত্ন নিয়ে ঋষভ বলেছিলো, সময়টা ছিলো মুসুল্লিদের নামাজের, সেই প্রহরে মানুষটা বলেছিলো, মাত্র একটা মাস অপেক্ষা করো যাদু । আমি একটু স্বাবলম্বী হয়েই তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো । এই ধূর্ত মিথ্যে কেনো? সে তো সরাসরিই বলতে পারতো, সহজ করে বলতে পারতো, তার মা রাজি না! অপমান আর ক্রোধ নিবেদিতাকে হত্যা করলো, হৃদয় নিহত হলো; তার তখন চারমাসের গর্ভকাল। বাঁচা মরার দোলাচল… স্যাভলন ফিনাইলের অসহ্য গন্ধ… একটি জীবন শুরুর অনেক আগেই চূর্ণ বিচূর্ণ । নিবেদিতা বুড়ো হয়েছে, দাদি এবং নানীও । কিন্তু সেই অপরাধবোধ একদিনের জন্যও তার সঙ্গত্যাগ করেনি ।
Tags:
গল্প