বাঙলা এবং বাঙালি কতোটা ভালবাসে তার ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে? কতোটা আপন মনে ক’রে তাকে আগলে নেয় বুকে? আদরে সোহাগে কতোটা ভরিয়ে দেয় ভাষার শরীর? এবংভাষার হৃদয় খুঁড়ে কতজন দেখে তারও রয়েছে ব্যথা, বেদনা,মান-অভিমান, আক্ষেপ,অনুযোগ,অভিযোগ? রয়েছে যে একটা নরম তুলতুলে মন তার;মায়ের মতোই,যার সাথে আমরা নিয়মিত বিনিময় করিনা আমাদের মনের;তাও বা কতজন দেখি,বুঝি? এতসব সব বিষয়ে আমার রয়েছে ঘোরতর সন্দেহ এবং আমি নিশ্চিত ভাষার সাথে এই যে অনাত্মীয় সম্পর্ক আমাদের তার পেছনে রয়েছে অবজ্ঞা অবহেলার মন-মানসিকতা এবং বিদেশী ভাষার আগ্রাসন!যদি আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এড়িয়ে চলি,দেখি খাটো ক’রে এবং দেখাইও তাহলে লুপ্ত হয় আত্মমর্যাদা, অনাদরে ঘুণে ধ’রে ধীরে ধীরে ভেঙে যায় তার কাঠামোটি!যেকোনো কিছুর কাঠামো ভেঙে গেলে থাকেনা আর কিছুই।দেখা দেয় কদর্যতা। ভাষা যে শাশ্বত সুন্দর, তার রূপটি ব’দলে যায়।তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়।চলার গতিও কমে আসে। খুব কাছের পথটিকে মনে হয় বড় দীর্ঘ, বড় ক্লান্তিকর! হাঁটবো যে এমন অবস্থায় পথে, সে পথটিতো সহজ হবার কথা নয়, হবার কথা নয় প্রসারিতও!নানা সব বাধা,পথে প’ড়ে থাকা কাঁটা, জ’মে থাকাধুলো সরিয়ে এবং পেরিয়ে যখন পৌঁছুবো নির্ধারিত স্থানটিতে তখন দেখব অনেক,অনেক দেরি হয়ে গেছে। সঙ্কীর্ণ মানসিকতা এসে ঘর বাঁধবে মগজে।
আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রয়েছে তার মধ্যে ভাষা প্রধান এবং অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। ভাষার মৃত্যু নেই, ভাষা বেঁচে থাকে ভাষার জোরেই । ভাষার মৌলিকতা ও তার সংহত অবস্থান এবং ভাষার যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তারা সম্মিলিত ভাবে মানুষের ভেতর জাগায় আত্মবিশ্বাস । আমাদের বাঙলা ভাষা এখন এমন এক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যা দেখে বুঝে নেয়া সম্ভব তার রয়েছে গভীর থেকে গভীরতর আবেদন যা আমাদেরকে সামনের দিকে টানে তার সংহত অবস্থানটির জন্যেই । মনকে আন্দোলিত এবং আনন্দিত করে তার সূক্ষ্ম মৌলিকতার জন্যেই । এই যে ভাষার বহুমুখিতা, বহুগামিতা তার থেকে যেমন মুখ ফিরিয়ে নেয়া কঠিন । ঠিক তেমনি কঠিন তাকে এড়িয়ে অন্য ভাষায় সুর তুলে গান গাওয়া !যার নমুনা আমরা আজকাল প্রায়ই দেখতে পাই । দেখতে পাই ঘরে ঘরে হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসন । কথ্যভাষায়ও এর সংযোজন বিচিত্র নয় । ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং স্বীকৃত সবদেশেই এটা যেমন আমাদের অজানা নয় ঠিক তেমনি অজানা নয়, কেউ কেউ আমাদের চারপাশেরই;এই ভাষাটির ব্যবহার করে থাকেন অপ্রয়োজনেও । অনেক কিছু আমরা হিন্দি আর ইংরেজি থেকে গ্রহণ করছি, যা না করলে কোন ক্ষতি নেই নিজের, অন্যেরএবং অবশ্যই বাঙলা ভাষার । আমরা ঠিক ততোটুকুই নেব বিদেশী সংস্কৃতি এবং ভাষা থেকে যতোটুকু উপকারি এবং গ্রহণযোগ্য ।শেখার আছে যতোটুকু ঠিক ততোটুকু নিতে হবে সবার আগে । যা এবং যেসব নেয়া দরকার তা নিলেও ক্ষতি নেই । যদি দেয়া নেয়ার প্রশ্ন থাকে তাহলে তার মাঝে থাকতে হবে মৌলিকতা । যদিও শেষপর্যন্ত মূলেই থাকতে হবে আমাদের । তাছাড়া কোন উপায় নেই ।
ভাষা যদি বেদখল হয়ে যাবার উপক্রম হয়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে অন্য ভাষার চাপে, কিংবা ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে; তা’হলে তাকে উদ্ধার করা, তাকে মুক্ত করা অত্যন্ত কঠিন; তবে অসাধ্য নয়। তার জন্য দরকার রয়েছে সমষ্টিগত ঐক্যের । একাত্তরপূর্ব বাংলাদেশ যার জলন্ত উদাহরণ ।কিন্তু ভাষাকে তার পূর্বের অবস্থান ফিরে পেতে যা কিছু প্রয়োজন তা সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আদায় করে নেয়া এবং জাগ্রত মনোভাব বুকে লালন করা করাও খুব সহজ নয় । তার প্রধান কারণ হলো এই,পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্খা মানুষের, পরিবর্তনের দ্রুতগামীতা সময়ের । তবে এমন কথাতো বলতে পারিনা যে, কখনো কোনদিন কোন দেশ এবং জাতির ক্ষেত্রে এমন উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেনা ।
কথা যখন ভাষা নিয়ে তখন সেখানে কোন আপস নয় দাসত্ব নয় । ভাষা নিজেই চায় উন্মুক্ততা । মুক্তির প্রবল স্রোতে সে ভেসে বেড়াতে চায় । আনন্দে উদ্বেলিত হতে চায় গান গেয়ে, সুর তুলে ।
বন্দিত্ব তার শত্রু; যদিও তার ঘরেই রয়েছে অজস্র শত্রু যে এবং যারা বাঙলা ভাষাকে আপন মনে করলেও হৃদয়ে জায়গা দেয় অন্য ভাষাকে । এই দেশে আজো সর্বস্তরে বাঙলা ভাষার ব্যবহার একটি স্বপ্নই রয়ে গেছে । স্বপ্ন যাদের তাঁদের ঘোষণা নয়, আবার অন্যদিক দিয়ে ঘোষণা যাদের তাঁদের স্বপ্ন নয় । যদি ভিন্নভাবে বলি তাহলে কথাটি এমন-যাদের স্বপ্ন আছে ভাষাকে নিয়ে তাঁদের ক্ষমতা নেই বাস্তবায়নের তাই ঘোষণাটি তাঁরা দিতে পারেনা আর যাদের ক্ষমতা আছে তাঁরা স্বপ্ন দেখেনা ভাষা নিয়ে, কিন্তু ক্ষমতা আছে বাস্তবায়নের; কিন্তু করেনা কোনভাবেই ! ক্ষমতাবানরা স্বপ্ন দেখে যা এবং যেখান থেকে, সেখান থেকে ভাষার প্রবাহিত স্রোত ধারাটি তাঁদের মনটিকে আন্দোলিত করেনা । ভাষার সৌন্দর্য এবং রূপটি আকর্ষণ করেনা তাঁদের,যা করে অন্যকিছুতে ।
ভাষা দাসত্বের পর্ব গুলো বাঙালিদের জীবনে নিয়ে এসেছিল চরম দুর্ভোগ,দেখা দিয়েছিল বিপর্যয়, অস্তিত্বের । দেখা দিয়েছিল সঙ্কট মুক্ত মানসিকতার! সেই সময়টা বাঙালিরা পেরিয়ে এসেছে নানা ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে; এক সময় ঘুরে দাঁড়াবে বলেই । যদিও শেষপর্যন্ত ভাষা সেই দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছিল একসময় তার নিজস্ব ক্ষমতাবলেই । এবং এই যে মুক্তি এবং মুক্তির পথে রক্তাক্ত প্রান্তরে মানুষের অবিরাম সংগ্রাম তার পেছনে রয়েছে দাসত্ব না করবার সুতীব্র বাসনা,ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং অবশ্যই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকল্প । যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছিলো একের পর এক আন্দোলন । ৫২’র ভাষা আন্দোলন, যেটি বাঙলা ভাষার মুক্তির সনদ, চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে শুধু মাত্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও বাঙালির কোন স্বপ্ন ছিল না । অন্তত ভাষা মুক্তির । তাঁরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মূলত তখন যখন পশ্চিম পাকিস্তান উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানেও প্রতিষ্ঠিত করার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার আগে সাধারণ বাঙালিরা কেন স্বপ্ন দেখেনি তার দায় তাঁদের উপর চাপানো যাবেনা । যাবে সেইসব বাঙালিদের উপরই যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তো বটেই এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত এবং সুপরিচিত ছিলেন নানা কারণেই ।
প্রশ্ন হলো কেন তাঁরা দেখেনি শুধু মাত্র বাঙলা’র স্বপ্ন ? অনেক প্রশ্ন, উত্তরও অবগুণ্ঠিত নয় । বাইরে থেকে নয় ঢুকে যেতে হবে ভেতরে এবং সরাসরি এবং গিয়ে জেনে নিতে হবে বাঙালির ভাষার অধিকার পেতে এত সময় লাগলো কেন । কেন-ইবা আমাদের অপেক্ষা করতে হল বায়ান্ন পর্যন্ত । কেন অপরিহার্য ছিল একটি ৬৯’র, একটি ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলনের, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের এবং শেষপর্যন্ত ৭১’র মুক্তি যুদ্ধের । বাঙলা ভাষা নিয়ে কথা বললে অবধারিত ভাবেই এসে যায় সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এবং বায়ান্ন পরবর্তী বছর গুলো এবং অবশ্যই একাত্তর। কারণ এই,একটার সাথে একটার আন্তঃসংযোগ । যেখানে রয়েছে ঘৃণা, ভালোবাসা, বন্দি, মুক্তির মতো ছোটো বড়ো অসামান্য ঘটনা । এই বিষয় গুলো আজ আলোচনায় মুখ্য না হলেও অগ্রহণযোগ্যও নয় কোনভাবেই । প্রতিটি ঘটনাকে স্মরণ এবং গ্রহণ করেই এগোতে হবে আমাদের । বহু ঘটনার পর স্থিত হওয়া বাঙলা ভাষার যেসব কাঠামো দাঁড়িয়েছে স্বদেশে এবং সম্মান অর্জন করেছে বহির্বিশ্বে সে যতটুকুই হোক তাকে পরিচর্যা যদি আমরা না করি তাহলে ভাষার শরীর আচ্ছাদিত হবে অনাবশ্যক লতা-পাতায় । তার গতি রুদ্ধ হবে;তার পরিধির ব্যাপক বিস্তৃত রূপটি যা আপাতত দেখতে পাচ্ছি তা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসবে । বাঙলা ভাষার জন্যে যা গৌরবের নয় । আমরা অবশ্যই আমাদের ভাষায় গান গাইবো সুরটিও হবে ঠিক একই ভাষাতেই । না ভাষার সুরে গান গাইলে সামনে বসে থাকা স্রোতার দল হারিয়ে যাবে পলকেই । কারণ সামনে বসে থাকা স্রোতার দল অতি সাধারণ, খাঁটি বাঙালি । বাঙালির স্বভাব চরিত্র এমনিতেই নকল প্রবণ । নিজের দেখে চলিনা অন্যেরটা দেখেই চলতে অভ্যস্ত আমরা ! চলমান আচরণ পরিবর্তন না করলে ভাষা একদিন না একদিন বিদ্রোহ করবেই । যেমন করেছিল বায়ান্নপূর্ব সময়টাতে । ভাষা চলে তার নিজস্ব স্বভাবে, আপন গতি নিয়ে । কোন বাধা সহ্য না করে সে প্রকাশ করে তার নিজস্ব আচরণ, প্রকাশ ভঙ্গি । দেখায় ক্ষমতা । আমরা কী পারি সে ক্ষমতা হরণ করতে ? করলেই সামনে সমূহ বিপদ । যে বিপদে প’ড়ে একদিন পাকিস্তান লুকিয়েছিল গর্তে ।
Tags:
প্রবন্ধ