পত্রিকা খুললেই আজকাল একটা বকাই চোখে পড়ে "অসহিষ্ণুতা"। ফেসবুকে কোন কিছু পোষ্ট করতে না করতেই সেই আবার মন্তব্যের ঝড় "অসহিষ্ণুতা"। কেউ কেউ তো আবার হুমকি দিতেও পিছু পা হন না । আমার কি মনে হয় জানেন ? আমার মনে হয় "অসহিষ্ণুতা" এই শব্দটি কিছু মানুষ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন । এতে তাঁদের লাভ হলেও আমাদের মতন মিশ্র ধর্মীয় দেশের পক্ষে এক ভয়ঙ্কর দিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে ।
বিচিত্র কারণ সাংসদ যাঁরা তাঁরা নিজেরা যে সব এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন সেই সেই কেন্দ্রের ভোটার তালিকা যদি আর একবার ঘাঁটতেন, তাহলে নিশ্চয় তাঁদের চোখে পড়ত যে ওই ওই কেন্দ্রে শুধু একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষই বাস করেন না, অন্য গোষ্ঠীর মানুষও কম, অতি কম হলেও কিছু আছে। এই সরল সত্য বিতর্কে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের অনেকেরই খেয়াল হয়নি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই কোনও একটি কেন্দ্রে সব ভোটারই বৌদ্ধ বা জৈন বা শিখ, এক–আধজন বাইরে থেকে আসা শিক্ষক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী পেশাগত কারণে থেকে গেছেন এবং ওই কেন্দ্রের ভোটার হয়েছেন, তাঁরা অন্য ধর্মের, কিন্তু সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর সাংসদ কিন্তু তাঁর কেন্দ্রের তাবৎ ভোটারের প্রতিনিধি। কোনও একটি ধর্মীয় সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর নন।
আর অসম কারণ এই সাংসদদের ধরে গোটা দেশের নিরাপত্তা যে সামরিক বাহিনী রক্ষা করছে তার ছবিটা কি একবারও কারও মনে পড়েনি? আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীই সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম বিস্ময়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক আশ্চর্য উদাহরণ। এই উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে পাওয়া যায় না। তাই অন্যদের সম নয়, ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী অনন্য। এই একটি বাহিনী সম্পূর্ণ অসম, কারণ এই বাহিনীতে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, জোরাসট্রিয়ান, ইহুদি প্রায় সব ধর্মেরই সদস্য আছেন। আর এই বাহিনীর মূল স্রষ্টা এক মুসলমান সম্রাট। তিনি স্বয়ং আকবর। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সময় পর্ব ১৫২৬ থেকে ১৮৫৮। ৩৩২ বছর। এর মধ্যে ১৫ বছর বাদ যাবে কারণ দ্বিতীয় মুঘল বাদশাহ হুমায়ুন আফগান শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে ওই সময় বাদশাহি খুইয়ে ইরানের শাহের আশ্রিত ছিলেন। ওই ১৫ বছর বাদ দিলে থাকে ৩১৭ বছর। এর মধ্যে প্রথম ১৮১ বছরে ৬ জন মুঘল সম্রাট— বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, শাজাহান ও ঔরঙ্গজেব— ইতিহাসে গ্রেট মুঘল বলে পরিচিত। ঐতিহাসিকরা এদের গ্রেট বা মহান বলেছেন এই কারণে যে ওই সময় চার চারটি সাম্রাজ্য পাশাপাশি রাজত্ব করছিল। তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাককে ধরে অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্য, যাদের অধীনস্থ ছিল বর্তমান পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। ঠিক তারই গা লাগোয়া ছিল পারস্য সাম্রাজ্য ইরানে। ম্যাপে এর ওপরেই দেখা যায় উজবেকদের সাম্রাজ্য। আর পূর্বে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য। ওই সময় পর্বে ধনে, জনে, মানে মুঘল সাম্রাজ্যের পাঙা নেওয়ার সাধ্য ছিল না বাকি তিনটি সাম্রাজ্যের। আর মুঘল সাম্রাজ্য এই খ্যাতি অর্জন করে তৃতীয় সম্রাট আকবরের আমলে। বাবর সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করলেও মাত্র চার বছর জীবিত ছিলেন। চৈতন্যদেবের সমসাময়িক মানুষটি ১৪৮৬–তে জন্মে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তখন মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল কাবুল থেকে দিল্লি পর্যন্ত। তাঁর ছেলে হুমায়ুনও সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত এবং সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করানোর আগেই গদিচ্যুত হন। গদি ফিরে পাওয়ার পর মাত্র সওয়া বছর জীবিত ও (১৫৫৫–৫৬খ্রিঃ) ক্ষমতায় ছিলেন।
ভিনসেন্ট স্মিথ, স্যর যদুনাথ সরকার, রমেশ মজুমদার এবং মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত এবং প্রাসাদ একাই তৈরি করেন আকবর। বাবুর জীবিত ছিলেন ৪৪ বছর। হুমায়ুন পঞ্চাশের কম। আকবর ৬৩ বছর। এর মধ্যে রাজত্ব করেছেন ৪৯ বছর। এই সময় পর্বে কাবুল থেকে ঢাকা, কাশ্মীর থেকে খান্দেশ, মোটামুটি উত্তর ভারত জয় করেন। আর এই জয় সম্ভব হয়েছিল তাঁর বাহিনীর প্রধান সেনাপতিদের ও সৈনিকদের বড় একটা অংশ হিন্দু ছিল বলে। যে আফগানরা তাঁর বাবাকে ভারত ছাড়া করেছিল, তিনি তাদের দুর্গ বলে খ্যাত অঙ্গ–বঙ্গ–কলিঙ্গ জয় করেন যে সেনাপতির সাহায্যে তাঁর নাম মান সিংহ। রাজপুতনার এক মেবার ছাড়া বাকি সব রাজ্যের সঙ্গেই হয় আত্মীয়তার বন্ধন, নয় পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। হিন্দু–মুসলমান, শিয়া–সুন্নি— ধর্মীয় বিভেদকে কুলোর বাতাস দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ওপর রাজসভার উলেমাদের একটা অত্যন্ত বড় ও প্রভাবশালী অংশ অ্যাতোই খাপ্পা ছিল, যে ১৫৮০ নাগাদ তাঁরা সম্রাটের বিরুদ্ধে ওমরাহদের তাতাতেও আরম্ভ করেছিল। আকবর তিলমাত্র বিচলিত হননি। বরং ওই ধর্ম–বিভেদী মোল্লাদের ঢিট করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। হিন্দুদের ওপর, অনেকটা আজকের মতো গুন্ডাদের প্রোটেকশন ট্যাক্সের আদলে, যে জিজিয়া কর দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল তাও তুলে দেন। তিনি গুণের কদর করতেন, ধর্মের নয়।
তাই তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী ১০২ বছর (১৬০৫ থেকে ১৭০৭) তাঁর ছেলে জাহাঙ্গির টানা ২২ বছর (১৬০৫–১৬২৭), নাতি শাজাহান ৩১ বছর (১৬২৭ থেকে ১৬৫৮) এবং পুতি ঔরঙ্গজেব ৪৯ বছর (১৬৫৮–১৭০৭) মোটামুটি নিরুপদ্রবে শাসন করতে পেরেছেন। সাম্রাজ্যের আয়তনও বেড়েছে এই পর্বে, বিশেষ করে ঔরঙ্গজেবের আমলে। সম্রাট অশোকের পর এত বড় ভারতীয় সাম্রাজ্য আগে আর কখনও হয়নি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, কান্দাহার থেকে কামরূপ।
আকবর ৪৯ বছর রাজ্যশাসনকালে শাসনের যে ছকটি তৈরি করেছিলেন, সেই হিন্দু–মুসলমান ঐক্য, সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভিত ও প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হল ঔরঙ্গজেবের ৪৯ বছরে। প্রথম ২০ বছর যখন রাজ সিংহ, জয় সিংহরা জীবিত ছিলেন ঔরঙ্গজেব স্বমূর্তি ধারণ করেননি। কিন্তু বন্ধু, সাম্রাজ্যের হিতাকাঙ্ক্ষী রাজপুত রাজাদের মৃত্যুর পর তাঁর চেহারা বদলে যায়। ফের জিজিয়া কর চাপান। শিখদের খেপিয়ে দেন। বুন্দেলখণ্ডের বুন্দেলা রাজাদেরও বিরুদ্ধবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য করেন। জাঠদের সঙ্গে বাধে তীব্র সঙ্ঘর্ষ। আর রাজপুতরা হয়ে ওঠেন তাঁর চোখের বিষ। সর্বোপরি মারাঠাদের করে তোলেন চিরশত্রু। মৃত্যুর দু’বছর আগে হাহাকার করে এক চিঠিতে লেখেন, সারাজীবন ধরে শুধু ভুলই করে গেলাম। এরকম নিখাদ আপশোসের কান্না যে তিনি কাঁদতে পারেন তা তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচররাও সেদিন জানতে পারেননি।
১৭০৭–তে মারা যান ঔরঙ্গজেব। তাঁর মৃত্যুর ৩২ বছরের মাথায় ইরানের সম্রাট নাদির শাহ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাণ, দিল্লি শুধু লুট করেননি, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে যান। তখন দিল্লির গদিতে ছিলেন চতুর্দশ মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ। ১৫২৬ থেকে ১৭০৭, একশো একাশি বছরে মাত্র ৬ জন মুঘল বাদশা। আর ১৭০৭ থেকে ১৭৩৯, এই ৩২ বছরে গুনে গুনে ৮ জন। এর মধ্যে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে, একই বছরে পাঁচ পাঁচজন— ফারুখশিয়র, রফিউদ্দিন দরাজাৎ, রফিউদ্দিন দৌলত, নেকুশিয়ার ও ইব্রাহিম। নাদির শাহ ৩০ হাজার দিল্লির বাসিন্দাকে খুন করে, বাদশাহি কোষাগার থেকে ৩০ কোটি টাকা, হীরে জহরত, মুক্তা, কোহিনুর, ময়ূর সিংহাসনের সঙ্গে মুঘল হারেমের তাবৎ সুন্দরীদের নিয়ে গিয়েছিলেন দেশে। দিল্লি লুট করে এত আয় করেন যে ঘরে ফিরে ইরানে তিন বছর প্রজাদের সব খাজনা মকুব করে দেন। এর পর মুঘল সাম্রাজ্য চিরশত্রু মারাঠাদের সাহায্যে, পেশোয়াদের দাক্ষিণ্যে ভর করে আরও ২২ বছর টিকে ছিল। কিন্তু তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলমের আমলে আফগান লুটেরা আহমদ শাহ আবদালির কাছে মারাঠারা গোহারান হারার পর বাকি ৯৭ বছর মুঘল সাম্রাজ্য সীমাবদ্ধ ছিল দিল্লি শহরে। দ্বিতীয় শাহ আলম, দ্বিতীয় আকবর ও শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ প্রকৃতপক্ষে মারাঠা ও পরে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পেনশন পেতেন।
এ তো এই দেশের, আমাদের ইতিহাস। যে ইতিহাসে বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে সহিষ্ণুতার জয়, অসহিষ্ণুতার পরাজয়। ইতিহাসই পথ দেখায় বর্তমানকে ভবিষ্যতের পথ চিনে নিতে। তাই ইতিহাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যারা সাময়িক জয়ের উল্লাসে ‘ফতোয়া’ জারি করে চলেছে, কে কী খাবে, কে কী পরবে, কাকে আপ্যায়ন করা যাবে, আর কার মুখে কালি লেপাটাই যাদের কাছে বীরত্ব, যারা কথায় কথায় বিশিষ্টজনদের ‘পছন্দ না হলে’ দেশত্যাগের নির্দেশ দিচ্ছে তারা অচিরেই বাধ্য হবে ঔরঙ্গজেবের মতো হাহাকার করতে। বাধ্য হবে বলতে, ক্ষমতায় থাকার সময় শুধু ভুলই করে গেলাম। তখন কিন্তু সংশোধনের সময় ও সুযোগ আর নাও আসতে পারে। তাই সময় থাকতে বলব, সাধু সাবধান, সামনে গভীর খাদ।।
Tags:
সোজা সাপটা