দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী














বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য নামে পরিচিত। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোঁহা-সংকলন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দুধর্ম, ইসলাম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলি এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলা সাহিত্যও দুটি ধারায় বিভক্ত হয়: কলকাতা-কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও ঢাকা-কেন্দ্রিক পূর্ব পাকিস্তান-দেশের সাহিত্য। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বিশ্বের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

বাংলা পৃথিবীর জীবন্ত ৭১০৬ টি ভাষার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এই ভাষার কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দও এর মত অসাধারন সাহিত্যিক রয়েছে এই বাংলা ভাষায় ; রয়েছে ১০০০ বছরের পুরানো সাহিত্য ভাণ্ডার। 

ইংরেজি এর প্রতি অতি-উন্মাদনা তৈরির পেছনে বড় দায়ী আমাদের সুশীল সমাজ এর একটি অংশ এবং কিছু প্রভাবশালী গণমাধ্যম। এরা বাইরে খুব ভালো কথা বলেন বাংলা এবং বাঙালীত্বের পক্ষে। তবে দিনশেষে তারাই নানাভাবে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেন। এইসব সুশীল ব্যক্তি, টিভি ষ্টেশন এবং এফএম রেডিও এর উপস্থাপকগন বিভিন্ন অনুষ্ঠান ক্রমাগত বিকৃত বাংলা উচ্চারণ করছেন, কথা বলার সময় অযাচিত ভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এরাই ইংরেজি মাধ্যম নামে দেশে ব্রিটিশ এবং অ্যামেরিকান স্কুল চালু করেছেন। এর মাধ্যমে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছেন। এই স্কুলগুলোকে এখন দেশে আভিজাত্যের প্রতীক মনে কারা হয়। দেশের বেশির ভাগ উচ্চবিও এবং উচ্চ-মধ্য বিও পরিবারের ছেলে মেয়ে এইসব স্কুলগুলোতেই পড়াশোনা করছে। এই স্কুলগুলোর গেট থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত কোথাও বাংলাভাষার কোন স্থান নেই। এরা কৌশলে বিশ্বায়নের কথা খুব জোরে সোরে প্রচার করছে । তারা বলছেন - বাংলা দিয়ে আর কি হবে ; বাংলা কতদিনই বা থাকবে - এখনতো পৃথিবীতে এক ভাষাই হয়ে যাবে ইংরেজি; ফলে সবাইকে ইংরেজির দিকে যাওয়া উচিত । এ রকমভাবে নানান কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচার করা হচ্ছে । 

ইংরেজি এবং হিন্দির প্রতি উন্মাদনা বৃদ্ধির আর একটি কারন দেশের সংস্কৃতি তথা গান, চলচিএ, নাটক এর দৈন্যদশা। এজন্য মানুষ হিন্দি এবং ইংরেজি গান, চলচিএ, নাটক এর দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দি এবং ইংরেজির প্রতি তাদের একটি প্রীতি তৈরি হচ্ছে যার অনিবার্য প্রভাব পড়ছে বাংলার উপর। আরও একটি বিষয় যা সব ভাষাকেই বিকৃত করছে তবে প্রভাবটা বেশি পড়ছে অ-ইংরেজি ভাষায় তা হল ইন্টারনেট। বর্তমানে শহরতো বটেই গ্রাম গুলোতেও সামাজিক যোযগাযোগের সাইটগুলো তুমুল জনপ্রিয়। তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষও ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইভার, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করছে। এখানে তারা ভাষা ব্যবহারে এত বেশি বিকৃতি করছে যে বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিট ক্রিস্টাল Internet Linguistics নামে ভাষাবিজ্ঞানে নতুন একটি শৃঙ্খল (discipline) প্রস্তাব করেছেন যা নিয়ে এখন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা হচ্ছে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে দেশে উচ্চশ্রেণী এবং মধ্যশ্রেণী এমনকি নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরও ইংরেজির প্রতি বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। যা মারাত্নক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে আমাদের ভাষা এবং একই সাথে সংস্কৃতিকে। 

বাংলাভাষার উদ্ভব থেকে আজ পর্য্যন্ত সময়কাল অব্দি শতাব্দীর পর শতাব্দী অনেক ভাষার প্রভাব এই ভাষার উপর পড়েছে তবু বাংলা ভাষা নিজের পায়ের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজও! ফলে একথা বলাই যেতে পারে বাংলাভাষা সহজে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না! সত্যি! কিন্তু তবু এই ভাষার ভবিষ্যত কতটা উজ্জ্বল? অনেকেই হয়তো এই প্রশ্নকে অপ্রাসঙ্গিগ বলে হেসে উড়িয়ে দেবেন! কিন্তু বর্তমান আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির রূপরেখায় এই প্রসঙ্গটি কতটা প্রসঙ্গিক সেটা বুঝে নেবার সময় এসেছে আমাদের!

যে কোনো ভাষার গতি প্রকৃতি নির্ভর করে মূলত সেই দেশের দেশবাসির মতিগতির উপর! সেই দেশের আবহমান ঐতিহ্যের সাথে বিশ্বের সমকালীন আধুনিকতার নিরন্তর দেওয়া নেওয়ার উপর! বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থাটা এবারে একটু ভালো করে দেখা যাক!

বাংলার দূর্ভাগ্য আজ ছয় দশকের উপর বাঙলাভাষী অঞ্চলটি চারটি ভাগে বিভক্ত! স্বাধীন দেশ ও ভারতের অংশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম এর বরাক উপত্যাকা! দেশের মুখ্য সরকারী ভাষা অবশ্যই বাংলা! সেখানে বাংলাভাষা জাতীয় গৌরবে অধিষ্ঠিত! সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে! কিন্তু ভারতের অংশ হিসেবে বাকি তিনটি অঞ্চলে বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থানটি ঠিক কি! আগে সেটি দেখা যাক! ভারতবর্ষের হিন্দীবলয়ের চাপে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দীভাষার ব্যাপক প্রসার এই তিন অঞ্চলের উপরেই প্রবল প্রভাব বিস্তার করে চলেছে ক্রামান্বয়ে! সমাজের সর্বস্তরেই হিন্দী আদৃত! এবং সম্মানিত!

এই অঞ্চল তিনটিতে হিন্দীভাষার প্রভাব এতটা সমাদৃত হওয়ার কয়েকটি কারণ বিদ্যমান!

প্রথমতঃ জাতি হিসেবে বাঙালির নিজস্ব একটি প্রকৃতিই হলো, আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি ক্ষমতাধর বিত্তশালী ও ধনৈশ্বর্য্যে উন্নত জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি খুব সহজেই অনুরক্ত হয়ে পড়ি!

বাঙালির ইতিহাসে বরাবরই একথা প্রমাণিত সত্য! এবং আমরা সবসময়ই রাজভাষার পৃষ্ঠপোষোক! সেই কারণে বাংলাভাষায় এত বিদেশী শব্দের ছড়াছড়ি! আজকে দিল্লীর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের রাজভাষা হিন্দী তাই আমাদের হৃদয়ের এত কাছে স্থান পেয়েছে! এরই সূত্র ধরে হিন্দুস্থানী সংস্কৃতিকে আমরা আপনার বলে গ্রহণ করেছি সাদরে! বাংলার প্রেক্ষিতে হিন্দী যে ভিনদেশী ভাষা সে আমরা ভুলেছি!

দ্বিতীয়তঃ এই ধরণের মানসিকতার সূত্র ধরেই অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ব্যাপী সারা বাংলার সমস্ত অঞ্চলেই বোম্বাইয়ের হিন্দী সিনেমা এত জনপ্রিয়! প্রায় প্রতিটি শহরে নগরে মফঃস্বলে নব্বই শতাংশ হলেই হিন্দী সিনেমা চলে রমরমিয়ে! এই চিত্র চলে আসছে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে! হিন্দী সিনেমার এই বিপুল জনপ্রিয়তার হাত ধরেই সারা বাংলার সকল অঞ্চলেই হিন্দী এখন বাঙালির মুখের ভাষা! এর সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দীভাষী টিভিগুলির বিপুল জনপ্রিয়তো! বহু বাঙালিই বাংলা ছেড়ে সারাদিন হিন্দী খবর শোনেন! টিভিতে বাংলা অনুষ্ঠানের নাম শুনলে নাক সিঁটকান অনেকেই! এবং হিন্দী গান, আপামর বাঙালির মননে অন্তরের পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছে এই বাংলায়!

তৃতীয়তঃ বৃটিশ আমল থেকেই শিল্পায়ণের হাত ধরে কলকারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের সাথে প্রচুর পরিমাণে হিন্দুস্থানী বাংলায় চলে আসেন স্থায়ী ভাবে! এবং এই প্রবণতা এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে! পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহরেই প্রচুর পরিমাণে অবাঙালি, এখন স্থায়ী অধিবাসী হয়ে গিয়েছেন! ফলে হিন্দীভাষী স্কুল কলেজের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান! এবং পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসাবাণিজ্য বহুকাল থেকেই তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন! ফলে বাঙালী চাকুরী থেকে ব্যবসায় শিল্পের শ্রমিক থেকে প্রশাসনে সর্বত্রই হিন্দীভাষীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হিন্দীকেই ব্যবহার করে সানন্দে! ফলে এরাজ্যের সর্বত্র হিন্দীই এখন বাংলার সহদোর হয়ে উঠেছে!

তিন শতকের বৃটিশ শাসনের ফলে সুস্থ সুন্দর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত জীবনযাপন ও জীবিকা নির্বাহের সাথে ইংরেজী ভাষাটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে! ইংরেজী জানা বাঙালি আর ইংরেজী না জানা বাঙালির মধ্যে সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজন তৈরী হয়েছে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে! ফলে সমাজে উন্নততর জীবন যাপনের প্রধানতম শর্তই হলো ভালোভাবে ইংরেজী শিক্ষা!

যে কারণে সারা বাংলার সর্বত্রই ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনোর জন্য এত স্কুল কলেজ গড়ে উঠেছে! এবং যা অত্যন্ত ব্যায় বহুল! যার ফলে আর একবার বংশ পরম্পরায় অর্থনৈতিক শ্রেণী সৃষ্টির ধারা চালু হয়ে গেল! যেখানে ইংরেজী ছাড়া উচ্চশিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত আজও গড়ে ওঠে নি, সেখানে এটাই নিদারুণ বাস্তব!

কোনো ভাষা তখনই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যখন সেই ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা যায়, সেই ভাষা স্বদেশবাসীর জীবনজীবিকায় নির্ভরতা দেয় এবং সেই ভাষায় সৃষ্টি হওয়া উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি স্বদেশবাসীর পুষ্টি নিশ্চিত করে বিশ্বমানবকেও পুষ্টি যোগাতে সক্ষম হয়!

দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার অবদান প্রথম দুইটির ক্ষেত্রে একেবারে শূন্য! এবং শেষেরটির ক্ষেত্রে আমরা যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করি, বিশ্ব সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি আজও ততটা বিখ্যাত তো নয়ই বরং বেশ পিছনের সারিতেই তার অবস্থান! ফলে এই বাস্তব পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলাভাষা! বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিশেষ প্রসঙ্গিক নয় আর!

অর্থাৎ বর্তমানে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বাংলাভাষী অঞ্চলে বঙ্গ জীবনে ইংরেজী ও হিন্দীর ব্যাপক প্রয়োগ ও নিরন্তর ব্যবহারে দৈন্দিন বেঁচে থাকার কাজ থেকে জীবন গড়ে তোলা ও উন্নততর জীবন যাপনের জন্য বাংলা ভাষার কোনই উপযোগিতা অবশিষ্ট নেই আর! অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের দুই প্রান্তে হয় হিন্দী নয় ইংরেজী জানতেই হবে জীবিকা নির্বাহের জন্য!

উচ্চশিক্ষা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা; চিকিৎসা বিজ্ঞান ও সুস্বাস্থ পরিসেবা; আইন আদালত থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম সবই ইংরেজী ভাষা নির্ভর! আর কলকারখানায় শ্রমজীবী বাঙালির কাছে হিন্দীবাসী সহকর্মীদের বলয়ে থেকে হিন্দী খুবই কার্যকরি ভাষা দৈনন্দিন জীবনের পরিসরে! দুই ক্ষেত্রই ব্রাত্য বাংলাভাষা!

তাহলে বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করার উপায় নেই! উপায় নেই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কোনো কার্যকরি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার! কারিগরি শিক্ষায় এই ভাষা নেহাতই মূক ও বধির! শিল্পবাণিজ্যে বাংলাভাষার কোনোই কার্যকারিতা গড়ে ওঠেনি কোনোদিনই! বর্তমানের তথ্য প্রযুক্তির বিশাল অঙ্গনে বাংলা ব্রাত্য!

জীবিকা নির্বাহে বাংলা কোনো সহায়তা দিতে নিতান্তই অপারগ! এইভাবে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়েন যে ভাষার কোনো ভূমিকাই নেই সেই ভাষার ভবিষ্যত অভিমুখ যে দিকেই হোক, তা যে খুব উজ্জ্বল নয় তা বলাই বাহুল্য! এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভোগবাদী দুনিয়ার বিশ্বায়নের মোহ! যে মোহর বাস্তবায়নে ইংরেজী ভাষাই একমাত্র চাবি কাঠি! ফলে আরমরি বাংলাভাষা আজ মর মর!

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার এই পরিস্থিতির সাথে বরাক উপত্যাকা ও ত্রিপুরার যে খুব বেশি ফারাক আছে তা বলা যায় না! কিন্তু দেশের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন! ভিন্ন এই কারণে যে বাংলা দেশের রাষ্ট্রভাষা! রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসভায় সেই ভাষায় কথা বলা যেতে পারে! তা বিশ্বসভা স্বীকৃত! দেশের সর্বত্র মাতৃভাষা জাতীয় আবেগের মূল অনুষঙ্গ! মুক্তিযুদ্ধ মুলত বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরিণত রূপ! ফলে দেশের স্বাধীনতার ভিত্তিই হল বাংলাভাষা! এবং সেই সূত্রেই আবিশ্ব তার স্বাধীন সার্বভৌম পরিচিতি! কিন্তু এতো হল প্রদীপের শিখা! তার তলায় কতটা আলো অন্ধকারের খেলা সেটা বুঝতে গেলে পৌঁছাতে হবে রোজকার জীবন বাস্তবতার গভীরে!

দেশের আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রেও আধুনিক যুগের উপোযোগী বিত্তশালী হয়ে ওঠার অন্যতম প্রধান শর্ত ইংরেজী জানা! উচ্চশিক্ষার্জন ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ইংরেজী বিনা অসম্ভব! চিকিৎসা ও স্বাস্থ পরিসেবা ইংরেজী নির্ভর! তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা সেখানেও অসহায় আজও! তবু প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলার প্রচলন থাকাতে বাংলার ব্যবহার অনেকটাই বিস্তৃত! কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যে সেই ইংরেজী নির্ভরতা থাকায় ইংরেজী ছাড়া গতিও নেই! এবং আবিশ্ব বিশ্বায়নের ঢেউতে দেশের সর্বত্রই ইংরেজীর গুরুত্ব বেড়ে গেছে ব্যাপক ভাবে! ফলে সেখানেও যত্র তত্র ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি!

অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনে ইংরেজীর ভূমিকাই সমধিক!

অর্থনৈতিক এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও বোম্বাই সিনেমা ও টিভির দাপটে হিন্দীভাষা ঘরে ঘরেই আদৃত! হিন্দীবলয়ের জৌলুশে সেখানেও বিমুগ্ধ বাঙালি! এবং হিন্দীগানের প্রভাব সুগভীর! এরসাথে ধর্মীয় কারণে আরবীর প্রভাব তো আছেই! ফলে বাংলাভাষাকে সেখানেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে ভিনদেশী ভাষার বহুল ব্যবহারের সাথে! বঙ্গভাষা কেবল সাহিত্য সংস্কৃতির হাত ধরেই বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠ থাকবে এরকম একটা আবেগপ্রবণ মনোভাব বাংলাদেশে সক্রিয়! আর এরই ফাঁক গলে প্রতিনিয়ত ইংরেজীর উপর নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে নজর এড়িয়ে! ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবেই সঙ্কুচিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাভাষার নিজস্ব জমি!

ফলত এই সকল কারণে সার্বিক ভাবে বাংলাভাষার জমিটি খুব সুদৃঢ় নয়! এবং প্রতিনিয়ত বাংলাভাষা ইংরেজী ও হিন্দীর দাপটে কোনঠাসা হয়ে চলেছে! একদিকে বাংলা কথ্যভাষার মধ্যে ইংরেজী ও হিন্দী শব্দের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং অন্যদিকে বক্তব্য প্রকাশে বাংলার উপর ক্রমহ্রাসমান নির্ভরশীলতা; এই দুই সাঁড়াশী আক্রমনে বাংলাভাষার বাঙালিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত! বিশেষ করে বাংলা বাগধারা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে! আর একটা বড় প্রভাব পড়ছে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দীভাষী অধিবাসীদের বিপুল সংখ্যাধ্যিক্যের জন্য! এর সাথে বাংলা পঠন পাঠন যত কমছে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার তত বিকৃতির দিকে ঝুঁকছে! এই রকম পরিবেশে বাংলাভাষার ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল নয়!


শৈশব থেকে শিক্ষিত পরিবারে ছেলে মেয়েদের ইংরেজী শিক্ষার উপরই জোর দেওয়া হয়! যত্ন নেওয়া হয় না বাংলা শেখায়! যার ফলে মাতৃভাষার উপর বিশেষ কোনো ভালোবাসা গড়ে ওঠে না!ফলে তারা তাদের কর্মজীবনে বাংলাভাষার উন্নতিতে কোনোই সদর্থক ভূমিকা নিতে পারে না! অন্যদিকে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত শ্রেণীর শিশুরা সামাজিক পরিবেশ থেকেই হিন্দীর প্রভাবে হিন্দী ঘেঁষা বিচিত্র এক বাংলাভাষার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে! এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের পরিসরে বাংলাভাষার যে চর্চা হয় এবং বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে বাংলাভাষার যে নিরন্তর চর্চা হয় সেই পরিসরের বাইরেই কিন্তু পড়ে থাকে বৃহত্তর বাংলা! সেই বাংলায় বাংলার অবস্থা অনাথ শিশুর মতোই!

দেশের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও এখনো ইংরেজীর দাপটের কাছে পুরোপুরি মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি! বিশ্বায়নের প্রবল ঢেউতে আদৌ তা সম্ভব হবে কিনা নিঃসন্দেহে বলা যায় না!

প্রত্যেক উন্নত ভাষায় প্রামাণ্য অভিধানের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে! এবং সময়ের সাথে সাথে তার পরিমার্জন ও পরিশোধন করে ব্যবহারিক ভাবে তার প্রয়োগ করা হয় সামগ্রিক ভাবে! দুঃখের বিষয় চার খণ্ড বাংলায় এই সুবিধেটি না থাকায় বাংলা ভাষার অবস্থা প্রায় অভিভাবকহীন! বিভিন্ন খণ্ডের মধ্যে এই ব্যাপারে সংযোগ সাধন খুবই জরুরী! বাংলাদেশে বাংলাভাষার প্রতি আবেগটিকে আরও সদর্থক ভাবে ভাষার প্রসার ও উন্নতিতে কাজে লাগাতে হবে! এবং সেই আলোটুকু এসে পড়ুক এপাড়ে!

অনেকেই হয়ত বলবেন বাংলাভাষার ভবিষ্যত নিয়ে এখনই চিন্তার কিছু হয়নি! এত কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা আপন শক্তিতেই টিকে যাবে! কিন্তু কথা টিকে যাওয়া নিয়ে নয়! বিষয়টা ভাষার সমৃদ্ধ সনির্ভরতা নিয়ে! প্রত্যেক ভাষায় অন্যান্য ভাষার প্রভাব পড়ে! সেই প্রভাবে কালের নিয়মে ভাষার গতিপথ বদলাতে থাকে! কিন্তু সেই বদল ঘটে ভাষার নিজস্ব নিয়মে ওপরের সজ্জায়! অন্যদিকে সেই বদল ভাষার প্রকৃতির মধ্যে ঘটলেই সর্বনাশ! সেই কারণে সব উন্নত জাতি তার মাতৃভাষাকে সযত্নে রক্ষা করে চলে! আর বাংলাভাষার সমস্যা আরও জটিল! বাংলাভাষাকে আমরা আজও পরনির্ভর করে রেখেছি! পরনির্ভরতার এই অভিমুখ থেকে আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে না পারল ভবিয্যত ভয়াবহ!

ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা চর্চার দুরবস্থা নিয়ে এখন শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের অনেক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। বৈদ্যুতিক মাধ্যমে আলোচনা থেকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে যেসব কথাবার্তা ও লেখালেখি হচ্ছে, তার মধ্যে একটি ‘হায় হায়’ অবস্থা এ বছর বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা দেখে-শুনে মনে হচ্ছে যেন এ বিষয়ে এদেশের শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের কুম্ভকর্ণ নিদ্রা পুরোপুরি ভঙ্গ না হলেও একটা সংঘর্ষের চেতনা তাদের মধ্যে দানা বাঁধছে। এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদির যে বিকাশ এবং উত্কর্ষ সাধন এতদিনে হওয়ার কথা ছিল সেটা তো হয়ই নি, উপরন্তু ভাষার অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যা সৃষ্টিশীল সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়েছে। 

উনিশ শতকে সাহিত্যের যে স্বর্ণযুগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার আগে হয়েছিল সেই সাহিত্যের উপযোগী ভাষা নির্মাণ। সেই নির্মাণের ক্ষেত্রে রামমোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ থেকে নিয়ে তত্কালীন বিদ্বান ব্যক্তি ও সাহিত্যিকদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। সে ভূমিকা ছাড়া এবং বাংলা ভাষার উত্কর্ষতা একটা পর্যায়ে উন্নত না হওয়া পর্যন্ত সাহিত্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করা সম্ভব ছিল না। অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও সৃষ্টি করেছিলেন উচ্চ মানের সাহিত্য। মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন, তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণের মাধ্যমে। ভাষার এই আধুনিকীকরণ এবং উন্নতি না হলে উনিশ শতকে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল তা একেবারেই অসম্ভব ছিল। রবীন্দ্রনাথ একথা উনিশ শতকের ভাষা ও সাহিত্য চর্চা প্রসঙ্গে বার বার উল্লেখ করেছেন। 

এখানে উনিশ শতকের ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, ভাষার উন্নতি ছাড়া কাব্যসাহিত্য, ইতিহাস চর্চা ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই উত্কর্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। বাংলা কাব্যসাহিত্য ক্ষেত্রে এখন যে দুর্দিন দেখা যাচ্ছে, এর কারণও এর মধ্যেই সন্ধান করতে হবে। 

কোনো দেশের ভাষার অবস্থাই সে দেশের সমাজ ও সাধারণ অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কাজেই ভাষার বিকাশ, উন্নতি এবং উত্কর্ষতা পুরোপুরি নির্ভর করে একটি দেশের সামাজিক অবস্থার ওপর। দেশও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। 

বাংলাকে শুধু রাষ্ট্রভাষা নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির মাধ্যম করাও ছিল ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, বাংলা শিক্ষা-সংস্কৃতির মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বস্তুত দেখা যাচ্ছে, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাতারাতি চালু করে দেয়ার ফলে এদেশে শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা ক্ষেত্রে তখন মহাদুর্যোগ নেমে আসে। বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করা ও সেই সঙ্গে ইংরেজি তুলে দেয়ার কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে এক চীনের প্রাচীর হঠাত্ করেই তৈরি করা হয়। যে ভাষায় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সে ভাষায় বইপত্র না থাকায় শিক্ষার অবস্থা কী হতে পারে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। বাংলাদেশে ইংরেজি বইপত্র পাঠে অক্ষমতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানকে এত নিচে নামিয়ে আনে যাতে তার দ্বারা খোদ বাংলা ভাষা চর্চাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলা ভাষায় এখন বানানসহ অন্যান্য যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তাতে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার লোকের, বিশেষত নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কমে এসেছে। এটা এমনভাবে কমে এসেছে, যা দেখে শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও লেখকদেরও এখন টনক নড়েছে। তারা যেন হঠাত্ করেই এই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে বিলাপ করছেন, এমনটাই তাদের টেলিভিশন টকশো’র বক্তব্য ও লেখালেখি থেকে মনে হয়। 

ইংরেজ আমলের আগে মুঘল যুগে ফার্সি ছিল আইন-আদালত ও শিক্ষার ভাষা। ফার্সির মাধ্যমেই সব ক্ষেত্রে কাজ পরিচালনা করা হতো। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করার পরই রাতারাতি এদেশে ফার্সি ভাষা বাদ দিয়ে তারা ইংরেজি চালু করার চেষ্টা করেনি। কারণ তারা ছিল শিক্ষিত, ইতিহাস ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন। কাজেই তারা রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি প্রবর্তন করতে প্রয়োজনীয় সময় নিয়েছিল। ১৮৩৭ সালে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল, কিন্তু তার পরও অনেক বছর লেগেছিল ফার্সি থেকে ইংরেজি সব ক্ষেত্রে চালু করতে। কিন্তু এসব বিষয়ে চিন্তার ক্ষমতা ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন দেশের মূর্খ, ইতিহাসজ্ঞানহীন ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের ছিল না। কাজেই রাতারাতি তারা বাংলাদেশে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করে, ইংরেজি উঠিয়ে দিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যার বিষময় ফল এখন শিক্ষা-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।

দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ বাংলা মাধ্যমে যে শিক্ষা দেয়া যায় তাতে কার্যক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হয় না। তাছাড়া দুনিয়ায় কাজ-কারবার করতে হলে ইংরেজি ভাষা জানা প্রয়োজন। কিন্তু এই বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে ইংরেজি স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচলিত হয়ে দেশে অন্য ধরনের এক বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করেছে। প্রথমত, এগুলোতে যারা পড়াশোনা করে তারা আগের মতো ভালো ইংরেজি শেখে না। সেভাবে লেখালেখি ও কথাবার্তা অল্প সংখ্যকের পক্ষেই সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত, এরা সবাই বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে সাংস্কৃতিকভাবে এক ধরনের শঙ্কর গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এরা বাংলা লিখতে তো পারেই না, বাংলা ভাষায় শুদ্ধ উচ্চারণ এবং কথাবার্তাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই নতুন ভাষা চর্চার প্রভাব যারা বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করে তাদের মধ্যেও আজ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা বানানের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যাতে বানান ভুল বলে কিছু আর নেই। যার যেভাবে ইচ্ছে বানান লিখছে। বানানের বিষয়টি আকাশ থেকে পড়েনি। বানান রীতি ধ্বনিতাত্ত্বিকসহ অন্য বিবেচনা থেকে রচিত হয়েছিল। বাংলা বানানের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা বরাবরই থেকেছে। কিন্তু এখন প্রচলিত বাংলা বানান রীতি পরিহার করে এক ধরনের নৈরাজ্য বানানের জগতে তৈরি হয়েছে। ভাষার এই অবস্থা হলে তার প্রভাব সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। বাংলা আজ যেভাবে চর্চা হচ্ছে, ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাতে নৈরাজ্য আছে। সমাজের সর্বত্র আজ যে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে, তার থেকে ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রের ওই নৈরাজ্যকে বিচ্ছিন্ন মনে করার কারণ নেই। সমাজে ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি কোনো দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন জিনিস নয়। শুধু তাই নয়, এ সবই হলো সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই সমাজের পরিবর্তন ছাড়া ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পরিবর্তন ঘটানো সহজ নয়। যারা আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্কট নিয়ে নড়াচড়া করছেন, উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সঙ্কট থেকে উদ্ধার লাভের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন; তারা যদি পরিস্থিতির এ দিকটির প্রতি দৃষ্টিপাত না করেন এবং সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত না করেন তাহলে ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনা, উদ্বেগ ইত্যাদি সবকিছুই দাঁড়ায় মায়াকান্নার মতো। একে অরণ্যে রোদনও বলা চলে। 



Previous Post Next Post