তুষ্টি ভট্টাচার্য

tusti








   আজ ভোরে প্রথম দেখলাম পরিযায়ী পাখিদের। শীত এখনও এলো না, তবু ওরা এসে গেল শীতের ভূমিকা নিয়ে। আকাশে খুব মেঘ রয়েছে। সূর্যের মুখ দেখা গেল না। বৃষ্টি আসতে পারে ভেবে ওদের বললাম, আজ ভিজিস না যেন। ঠিক দুপুরে বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। আমি জানি ওরা আমার কথা শুনবে না। পাখিরা আমাদের কথা শোনে না। বরং ওদের কথা শুনেই, ওদের কিচিরমিচির ঝগড়া শুনেই আমাদের বেড়ে উঠতে হয়। ওরা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পায় না যে, আমরা ওদের কথা শুনতে পাই, বুঝতে পারি।

   এই যেমন আমি দেখতে পাচ্ছি, ওরা সবাই দল বেঁধে ভিজেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে যে ছোটটি, তার যেন আর আশ মিটছে না। বড়রা সবাই গাছের পাতার আশ্রয়ে গেছে, ওকেও ডাকছে ফেরার জন্য। কিন্তু এই মৌসুমী বৃষ্টির মজা ও এই প্রথম পাচ্ছে বলে একেবারে দিশেহারা হয়ে আছে। যথারীতি ডানা ভেরে গেলে ফিরেছে মায়ের কাছে। মায়ের বকুনি খায় নি অবশ্য। মাপাখি আজ একটু বেশি উদার। তারও মনে বৃষ্টির মাদক লেগে আছে। ছোটটিকে ঢেকে দিয়েছে তাই ডানার ছায়ায়। আমি জানি, কাল সকালেও সূর্য দেরী করে উঠবে আর একটু উত্তাপের খোঁজে বাচ্চাটা মাকে ছেড়ে যেতে গিয়েও যেতে পারবে না। ওর কি একটু একটু সর্দিকাশি হবে? পাখিদের কি সর্দি হয়? জ্বর? নাহ এটা আমার জানা নেই। আমি শুধু ওদের নিয়ে ভাবতে পারি। ওদের উড়ান আমাকে উড়তে শেখায়। দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ওড়ার বিদ্যেটা আমি শিখেছি ওদের থেকেই। আমিও যখন তখন ওদের ঝাঁকের সাথে মিশে গিয়ে উড়ে যাই। কেউ আমায় চিনতে পারে না ওই সময়ে। আমার এ জন্ম ভেসে গিয়ে গত জন্মের রূপে আমিও তখন পরিযায়ী।

    সেই ঝিলটার কথা মনে আছে তো? শীতকাল এলেই যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশী বক আর হাঁসেরা এসে বসে? চিনতে পারো ওদের মধ্যে থেকে আমাকে? পারবেই না। আমিও তখন লাল লম্বা গলা আর হলুদ কালো ডানা নিয়ে ঝিলে সাঁতার কাটছি। মাছ খাচ্ছি আর রোদ পোহাচ্ছি। শীতের দেশ থেকে ওরা এসেছে একটু উত্তাপের খোঁজে। আর আমি ওদের সাথে মিশে আছি একটু উড়ানের লোভে। মাত্রই তো দুটো মাস। ওরা ফিরে যাবে আর আমিও জল ছেড়ে, উঠে আসব আমার শুকনো ঘরে।

     আমি ঘরে ফিরলে আমার অদৃশ্য ডানা খসে পড়ে যায়। আসলে আমিই লুকিয়ে রেখে আসি ডানাদের ঝিলের ধারের ঝোপের ভেতরে। রাত হলে ওরা চুপিচুপি নিজেদের বদলে নেয়। ওদের তখন মাটির তারার মত লাগে। আর তোমরা ওদের জোনাকি বলে ডাকো। আমি ওদের মিটমিট দেখলেই চিনতে পারি, কোন দুটো আমার ছেড়ে আসা ডানা। তখনও ওই জোনাকিদের গায়ে ঝিলের গন্ধ লেগে আছে। তখনও ওদের গলায় হাঁস জন্মের গান। এই দুটো জোনাকি সবসময়ে একসাথে থাকে। ওরা অন্য জোনাকিদের দলে ভেড়ে না। ওরা জানে, ওরা অন্য জোনাকিদের থেকে আলাদা। অন্য জোনাকিরা বাবুইয়ের ঠোঁটে লেগে থাকা খড়কুটোর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ভাবে, পরের জন্মে যেন আমাদেরও ঘর হয়। আমাদের ঘরেও যেন কোন জোনাকি আলো হয়ে থাকে। এই পর্যন্ত ভাবাই ওদের নিয়তি। তারপরেই বাবুইয়ের ঘরে আলো দিতে থাকে আমৃত্যু। আমার ডানার জামা ছেড়ে রেখে এসে যে দুটো জোনাকি একসাথে ঘুরে বেড়ায়, তাদের কিন্তু বাবুই ছোঁয় না। ওরা ঝিলের গন্ধে চিনতে পেরে যায় জোনাকিরূপী হাঁসের ডানাদের। অস্পৃশ্য সেই দুটো জোনাকি তখন ভাবে কখন ভোরের আলো ফুটবে আর তারা ফিরে পাবে তাদের পরিযায়ী ডানা। তাদের রাতের মিটমিটে আলো জ্বালা বৃথা হয়।

   ভোর হলে ওরা কিন্তু ভুলে যায় ব্যর্থ জোনাকি জীবনের ব্যথা। পরিযায়ী সুখে ডানাদের বিভ্রম দেখি, আর আমাকেও সেই বিভ্রম পেয়ে বসে। আমারও ভুল হয়। ভুলে যাই মানুষ জন্মের কথা, রাতের জোনাকির কথা। আমি পাখি হয়ে উড়তে থাকি। আবার পরক্ষণেই নেমে আসি ঝিলে। সাঁতার দিতে দিতে পুরো ঝিল বড্ড চেনা হয়ে যায়। আবার উড়ি, উড়তে থাকি যতক্ষণ না ডানা ব্যথা হয়। এভাবেই উড়ান ও সাঁতারের মাঝে আমি একলা থাকি। পরিযায়ী জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে থাকি নিঃশেষে। আমি জানি এ জীবন মাত্র দুমাসের। সত্যি পরিযায়ী উড়ে যেতে জানে। এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে অনায়াসে উড়েও যায়। এই গ্রীষ্ম প্রধান দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া ওম ওদের কাজে লাগে কিনা জানা হয় না। ওদের উড়ে যাওয়া এতটাই আচম্বিতে ঘটে। একদিন ভোরে দেখা যায় শূন্য ঝিল পড়ে আছে। ঝিলের জলে ভাসছে কিছু ছেঁড়া পালক আর বিষ্ঠার সবুজ। সেইদিন আমি বুঝি- সত্তর পাকে জড়িয়ে যাওয়া আমি সামান্য মানুষ। আমার পরিযায়ী হওয়া হয় না। ময়ূরের মুখোশ পরে যেমন কাক ময়ূর হয় না, তেমনি আমারও পরিযায়ী হওয়া হয় না। আমি ঝিলের ধারের ঝোপ থেকে লুকনো ডানা দুটো নিয়ে পুড়িয়ে দিই। আর সেই ডান পোড়া ছাই ভাসিয়ে দিয়ে আসি ঝিলের জলে। এভাবেই আমার পরিযায়ী জীবনের শেষ হয়। 
    সামনের শীতে আমি কাশ্মীর বেড়াতে যাবো। রিটার্ন টিকিট কেটে রাখব। সেই বরফের দেশে পরিযায়ীদের প্রকৃত ঘর। ওই বরফের দেশে গিয়ে আমি ডাল লেকের জমাট বাঁধা পুরু বরফের ওপরে, বরফ দিয়েই পরিযায়ী পুতুল বানিয়ে রেখে আসব। সেই পুতুল দেখে কিনতে ছুটে আসবে কত সত্যিকারের পাখিওলা। ওগুলো তাদের আমি বেচব না অবশ্য। ফেরার আগে ওই পুতুল পাখিদের কানে কানে শিখিয়ে আসব, দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে ওড়ার রহস্য।    



Previous Post Next Post