ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী









৮ম পর্ব
সকালে ঘুম থেকে উঠেই
অয়নের ফোন ।
সুপ্রভাত শালু ।
সুপ্রভাত । এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন আমাকে অনেক দিন দেখনি !
সকাল সকাল আমাকে বকছ । 
তা কেন ! তবে এইতো মাত্র কয়েক ঘণ্টা কেটেছে ! সকাল সকাল ফোন করলে মা কি ভাববেন বলত ?
কি আবার ভাববেন ? আমাদের বিয়ে হবে তার আগে একটু ঘুর-বোনা ! আজ কোথায় যাবে বল ?
না আজ আমি কোথাও যাবো না ।
কেন ?
আমার কাজ আছে । দেখ অয়ন তুমি আমাকে ভালো করে যান আমি অহেতুক অকারণে কোথাও বেরুতে ভালো বাসিনা । আমার অন্য কাজ আছে ।
ওকে বাবা । টেক ইট ইজি ।
নো আই কান্ট টেক ইট ইজি । এইখানেই তোমার আমার মধ্যে পার্থক্য !
মানে?
মানে সিম্পল ...।
শালিনী যানে কথাগুলো অয়নের ভাল লাগবে না তাও ও বলতে বাধ্য হয়, “আজ  আমার বাবার মৃত্যু দিবস। আজ আমি একা থাকতে চাই অয়ন । আমাকে একা থাকতে দাও !”  
অয়ন বোঝে শালিনীর মনের অবস্থা । তাই আর কথা বাড়ায়না । “ও আচ্ছা আমি দুঃখিত । আমি জানতাম না । তুমি তোমার মত থাক ।  বলে ফোন কেটে দেয়”  
শালিনীর চোখের জল যেন শ্রাবণের ধারার মত অবিশ্রান্ত বয়ে যায় । কিছুতেই ভুলতে পারেনা বাবার সেই অকাল মৃত্যুর  দিনের কথা ।
একাকীত্বর মধ্যে  বাবার কথাগুলো মনে পড়ে ,“ মৃত্যু , ধ্রুব সত্য কিন্তু তাকে কেউ সহজ ভাবে নিতে পারেনা মা । আজ আমি রোগ শয্যায় পড়ে আছি কাল হয়তো থাকবোনা । তখন তোরা আমার ছবি টাঙিয়ে ফুলের মালা দিয়ে তিনটে ধুপ জ্বালিয়ে আমাকে স্মরণ করবি কিন্তু আমি নিজেও জানি না তোদের ডাক আমার কাছে পৌঁছবে কি না ! খুব আশ্চর্য লাগে আমার !”

বাবা তুমি কেন  এরকম বাজে কথা বলে আমাদের মনে দুঃখ দিচ্ছ ? আমাদের মনে কষ্ট হয় না তোমার এই কথা শুনলে ? তুমি কি চাও আমরা কষ্ট পাই?  
নারে মা । আমি চাইনা তোরা কষ্ট পাস ।  নিয়তির কাছে সকলেই বাঁধা । কি করি বল ? পেটের ব্যথাটা বেড়েছে । আমি বুঝতে পারছি আর বেশি দিন নয় ।
সেই দিন বেল ভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় বাবাকে ।  অর্কদা , আমরা সকলে শত চেষ্টা করেও বাবাকে বাঁচাতে পারিনা । ডাক্তার চক্রবর্তী অপারেশনের পর  বাবাকে দুদিন লাইফ সাপোর্টে রাখার পর বলেন পেসেন্ট কোমায় আছে । অবস্থা ক্রিটিকাল বাঁচানো সম্ভব নয় । আমাদের তখন টাকা জলের মত খর্চা হচ্ছে । মা রাত দিন ঠাকুরকে ডাকছেন আর চোখের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন । তবুও ঠাকুর শুনলেন না মায়ের ডাক । শেষে বাবা রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জুলাই ২ তারিখে । সারাজীবন আমার মনে থাকবে সেই  দিনটার কথা  । আমার চরম দুঃখের দিন সেই দিনটা ।  আমি ওই দিন একা থাকি ।
পরের দিন ঃ-  
জুলাই তিন তারিখে NISER এ জয়েন করার জন্য চিঠি আসে । শালিনী হার্ড কপি সফট কপি দুটোই পেয়ে অয়নকে জানায় । জুলাই ৭ তারিখে জয়েনিং ডেট ।
অয়ন বলে তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর । তোমার কেরিয়ারের ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করার কে?
তা নয় তবুও তোমাকে জানালাম ।
Advertisement for : Faculty Position in National Institute of Science Education and Research for  “Assiistant Professor, Physics , NISER Bhubaneswar, Odisha, India. Pay Band 3 15600 to 39100 INR Grade Pay 7600. Free Quarter within Institute Campus. 
এই বিজ্ঞাপনের অপেক্ষায় আমি ছিলাম । আমার গাইড আমাকে বলেছিলেন ওই বিজ্ঞাপন বেরুবে বলে ।  আমি এক মাস আগে বেঙ্গালুরু জাওয়ার আগে ইন্টার্ভিউ দিয়েছিলাম । ওটার জন্যই বেঙ্গালুরু জাই পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্চের জন্য। ৬ মাস ওখানে কাজ করি। ওই কাজের সুবাদেই  আজ এই এপএন্টমেন্ট লেটার পাই ।  
আমার স্বপ্ন অয়ন। ওই Institute এ কাজ করার সুযোগ পাব চিন্তা করতে পারিনি । আমি আজ খুব খুশি । আমি জানিনা তুমি কতটা খুশি !   

৯ম পর্ব
অয়নের সকালটা কেমন যাবে জানেনা। সকাল সকাল মেঘলা আকাশ। আকাশ ভারাক্রান্ত। ঘন মেঘে আচ্ছন্ন। শ্রাবণের বর্ষণমুখর দিনে, মনে মনে কবিতা রচনা করার প্রবল চেষ্টা। কলম  নিয়ে বসে পড়ে। নিজের ডাইরিতে লিখতে থাকে: 
শ্রাবণ ধারা
আজি শ্রাবণ ধারায় বসিয়া আছি তোমার পথ চাহিয়া
তুমি আসিবে বলিয়া মন আমার ওঠে গান গাহিয়া।
একি অবিশ্রান্ত ধারা চিত্তে জাগায় পুলক আমায় 
বর্যণ মুখর দিবসে বসিয়া আমার ই আঙ্গিনায়।।
একি ক্লান্ত বিষম দিবস রজনী যায় যে বোহিয়া
নাহি মানে কভু কোন বাধা কোন বাঁধনের হিয়া।
আঁকি তোমারি চিত্র নিত্য আমার মানস পটে
উত্থাল যৌবনের উন্মত্তো হৃদয় প্রেক্ষাপটে
নাহি কভু ভুলি জাতনা বিরহের বহ্নি শ্রোতে।
একি ঘন মেঘের আচ্ছাদনে আঁধার রাতে
গুনি মুহুর্ত প্রহরগুলি যায় অনিদ্রার রাতে।।
তুমি আসিবে বলিয়া মন আমার ওঠে গান গাহিয়া।
আজি শ্রাবন ধারায় বসিয়া আছি তোমার পথ চাহিয়া।।

অয়ন কাল ফিরে যাবে বেঙ্গালুরু। বাবা মাকে শালিনীর কথা বলেছে।
ওনারা কিছু উত্তর দেন নি।
মা বলেছেন তোমার যেখানে পছন্দ সেখানেই আমরা তোমার বিয়ের ঠিক করবো। তবে ওই মেয়ে খুব অহংকারী। ওইখানেই কি তুমি মন স্থির করেছ?
হ্যাঁ মা। ও একটু জেদি কিন্তু আজকাল ওর মত মেয়ে তোমরা খুঁজলে পাবে না। 

কেন পাবো না!
না মা পাবে না।
আমি বলে রাখছি,  ও যা  করেছে সেটার জন্য আমি দায়ি।
আসলে আমি ওকে বুঝতে ভুল করি। ও যে অন্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা সেটা আমার বোঝা উচিত ছিল।

শালিনীকে খুব খুশি খুশি লাগছিল।  হঠাৎ শালিনীর মুখেও রবীন্দ্র সঙ্গীতের এক গানের কলি ঃ-   
আজি ঝর ঝর শ্রাবণ দিনে 
জানিনে জানিনে কিছুতে কিছু যে মন মানে না
ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে ...।
পরে সুরু করে তার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত,  শ্রাবন্তি র কণ্ঠেঃ
শাও্বন গগনে ঘোর ঘনঘটা
       নিশীথ যামিনী রে ...।
কুঞ্জপথে সখি,  কৈসে যাওব
       অবলা কামিনী রে ...।।
মায়ের ডাকে শালিনীর গান থামে। স্নান সেরে খেয়ে নে। কাল জাওয়া। আবার ওই অচেনা অজানা জায়গা। 
তোমার কোন চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমি ত একাই সব জায়গায় যাই।  এবারে  আমাকে  অয়ন ভুবনেশ্বরে ছেড়ে নেক্সট ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু ফিরে যাবে। এর আগের বার ত আমি একা গিয়েছিলাম বেঙ্গালুরু তখন কোন অসুবিধে হয়েছিল  কি?
তা হয়নি। তা তোমরা যা ভাল বোঝ তাই কর। আমি আর কদিন মা! তোমার বিয়েটা ভালয় ভালয় হলে বাঁচি।
হ্যাঁ মা তা আর বলতে! তোমার গলা থেকে মাছের কাঁটা নামবে!! তাই না?
ওই আরম্ভ হল। একটু যদি মায়ের মনটা বুঝতিস শালু। উনি আমাকে একলা ফেলে চলে গেলেন এই জঞ্জালে আমি ছট পট করছি। ঠাকুর জানেন সে কথা। মা রান্না ঘরে চলে যান।

শালিনী নিজের ঘরে ওর  জিনিষগুলো ভাল ভাবে চেক করে নেয়। দুটো ট্রলি ব্যাগ,  কিছু বই একটা মেকআপ বক্স (অয়ন ওকে প্রে-সেন্ট করেছিল) আর অন্য টুকি টাকি জিনিস। বাকি যদি কিছু সেরকম প্রয়োজন হয় তবে সেগুল ওখানেই কিনে নেবে। ফ্লাইটে কম লাগেজ ভাল এখন ত ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে ২৫ কেজির বেশি নিতে দেয়না।  এক্সট্রা লাগেজের জন্য $ 100  চার্জ করে। তবু ডোমেস্টিক ফ্লাইটে অতটা রেস্ট্রিক্সন নেই।  কাল সন্ধ্যা ৭ টার  ফ্লাইট। সন্ধ্যা ৫ টায় চেক ইন। সিকুরিটি চেকের পর সন্ধ্যায়  INDIGO র ফ্লাইট  No  6E447 CCA to BBA Dep. Time 19.05 hrs।  অয়ন বিকেল ৫ টার  সময় নেতাজী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ডোমেস্টিক টার্মিনালের কাছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে।
মা দক্ষিণেশ্বরের কালী ঠাকুরের ফুল দিয়ে মাথায় আশীর্বাদ করে শালিনীকে রওনা করেন ওর মা ।  শালিনী বিকেল ৪.৩০ টের সময় ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মা দুর্গা দুর্গা বলে।      

নেতাজী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট :
সন্ধ্যা ৫ টায় চেক ইন। সিক্যুরিটি চেকের পর ১৯টা ০৫ এ  ইন্ডিগো র ফ্লাইট। অয়ন বিকেল ৫ টার  সময় নেতাজী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক টার্মিনালে  আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।  
এয়ারপোর্টে পৌঁছেই অয়নকে দেখে ধাতস্থ হয়। অয়ন ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এর কাছেই ছিল। শালিনীকে দেখে কাছে চলে আসে। লাগেজ গুল সঙ্গে নিয়ে অয়ন ওয়েটিং লাউঞ্জে চলে যায়। দুজনে এই-প্রথম এক সঙ্গে ফ্লাইটে যাত্রা করবে তাও মাত্র এক ঘণ্টার। সিকুরিটি চেকের পর কন-ভয়রে লাগেজ চলে যায়। ইন্ডিগোর ফ্লাইট নাম্বার 6E447 Dep. Time 19.05 hrs. From CCA to BBI মানে কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর। ভুবনেশ্বরে ১৯।৫৫ অর্থাৎ  ৮ টায় পৌঁছবে। Indigo Airlines এর বাস যাত্রীদের নিয়ে প্লেনের কাছে পৌঁছে দেয়। দুজনে পাশা পাশী উইন্ডোর পাসের দুটো সিটে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন টেক অফ করে। উইন্ডোর সার্সি দিয়ে বঙ্গপ সাগরের দৃশ্য। নিচে সুন্দর বনের কিছুটা দৃশ্য দেখা জায়। আকাশ পরিষ্কার তাই দেখতে অসুবিধে নেই। এর পর খণ্ড খণ্ড মেঘের মধ্যে দিয়ে প্লেন এগিয়ে চলে নিচে নীল জল রাশি। সব মিলিয়ে মনোরম দৃশ্য।
অয়নঃ-  কফি খাবে শালু।
শালিনীঃ- না ওই হাড় মাগ্যি কফি খাওয়ার আমার কোন ইচ্ছে নেই।
এই ফ্লাইটে কিছু কমপ্লিমেন্টরই নেই। কিং ফিশারে তাও কিছু স্ন্যাক্স দিত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই  ভুবনেশ্বর এসে-গেল। ধউলি শান্তি স্তূপ দেখা গেল। আকাশ থেকে ভুবনেশ্বরের এরিয়াল সার্ভে করে-ফেললাম দুজনে। ওটা লিঙ্গরাজ মন্দির বোধ হয়। বেশ সহর ভুবনেশ্বর।

বিজু পট্টনায়ক ইন্টারন্যাশনাল এয়ার পোর্টঃ
ছোট এয়ারপোর্ট হলেও বেশ সুন্দর ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট। রাতের আলো ঝলমলে শহর। রাস্তা সুন্দর পরিষ্কার। এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেক আউটের পর অয়নকে সঙ্গে নিয়ে কারে উঠি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করি,  কত সময় লাগবে,  ওখানে কাছে হোটেল আছে কিনা,  ইন্সটিট্যুটে থাকার ব্যবস্থা আছে কিনা ইত্যাদি। ড্রাইভারের কাছে শুনি  গেস্ট রুম আছে এবং ক্যান্টিনে বলা আছে আমাদের জন্য রাতের ডিনার এর জন্য।  আমরা শুনে ধাতস্থ হই। আমাদের দুজনকে NISER Institute থেকে কার রিসিভ করে নিয়ে যায়।  এয়ারপোর্ট থেকে সোজা রাস্তা সচিবালয় মার্গ ধরে ডানদিকে ঘুরে আবার সৈনিক স্কুল পেরিয়ে আবার ডান দিকে ঘুরলেই একটু পরে  National Institute of Science Education and Research,  Bhubaneswar.

খুব সুন্দর ইন্সটিট্যুট। ছিম ছাম পরিষ্কার ক্যাম্পাস। আমাদের দুজনকেই রিসিভ করার জন্য ডঃ জয়দীপ ভট্টাচার্য,  রিডার আসেন। অমায়িক ভদ্রলোক।  উনি  Jawaharlal Neheru Centre for Advance Scientific Research, Bangalore থেকে Ph.D করেছেন শুনে শালিনী খুব আগ্রহের সঙ্গে ওনার সঙ্গে বাক্যালাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখানকার পরিবেশ এবং রিসার্চের স্কোপ অনেক বলে উনি বলেন। শালিনী  ওনার সঙ্গে কথা বলতে এতই মসগুল ছিল যে অয়নের কথা একদম  ভুলে যায়। পরের দিন বিকেল বেলা ৫ টায় অয়নের  Indigo  Airlines  এর 6E265 ফ্লাইট বেঙ্গালুরু যাওয়ার।  19.05 এ ছাড়বে রাত 22.20 পৌঁছবে।

অয়ন শালিনী এবং ডঃ ভট্টাচার্য র কথার মধ্যে শালিনীর উদ্দেশ্যে বলে শালিনী তাহলে আমি যাই!   
ও মা সেকি? আপনার ত এখানেই থাকার ব্যবস্থা আছে। বাই দি বাই আমি জয়দীপ ভট্টাচার্য এখানে ছোট খাট একটা  পোষ্টে  আছি।
শালিনী খুব অপরাধী মনে করে নিজেকে। অয়নের দিকে তাকিয়ে বলে সরি অয়ন আমার পরিচয় করান উচিত ছিল। আসলে...।
আসলে তুমি এখানে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। হ্যাঁ ডঃ ভট্টাচার্য আমি ‘অয়ন’। বাকিটা শালিনীর কাছ থেকে জেনে নেবেন। আমার তাড়া আছে। বাই! বলে গট গট করে নিজের লাগেজ নিয়ে চলে জায়।

শালিনী এই পরিস্থিতি কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। অয়ন! অয়ন!! দাঁড়াও লক্ষ্মীটি,  আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। 
অয়ন পিছু ফেরে না। এগিয়ে চলে। সে খুব অপমানিত বোধ করেছে। হবু বৌয়ের কাছথেকে এরকম উদাসীনতা আশা করেনি।


১০ম পর্ব 
এখানে শালিনী ভালোই আছে । সকাল ৯ টা থেকে ক্লাস । গেস্ট হাউস থেকেই ক্লাস করছে । নিজের পড়াশুনোর জন্য লাইব্রেরী তে বইয়ের অভাব নেই । রেফারেন্স বইগুল লাইব্রেরিয়ানের কাছথেকে একে একে নিচ্ছিল । কার্ডে ৬ টা বই পায় তাই সেগুল বেছে নিতে নিতে হঠাৎ ডঃ ভট্টাচার্য র সঙ্গে দেখা।
গুড মর্নিং ।  কেমন লাগছে আমাদের ইন্সটিটিউট ?
ভেরি গুড মর্নিং সার । হ্যাঁ ভালোই লাগছে । আমি এইরকম পরিবেশ ই খুঁজছিলাম । আপনাদের ল্যাব দারুণ। আমার খুব ভালো লাগছে এখানে ।
কোন অসুবিধে হলে বলবেন। এখানকার  একটা প্লাস পয়েন্ট কি জানেন এখানে ছেলে মেয়েরা ওয়েল ডিসিপ্লিন্ড তারা নিজের পড়াশুনো আর কেরিয়ারের কথাই শুধু ভাবে ; অন্যদিকে মন দেওয়ার সময় পায়না   । আসলে সকলেই ভাল মেরিটের ছেলে মেয়ে তাই ওদের পড়াতে অসুবিধে হয় না। আপনি কি বলেন?
হ্যাঁ নিশ্চই । স্টুডেন্ট লাইফে ডিসিপ্লিনটা র গুরুত্ব অনেক । যারা সেটা মেনে চলে তাদের জীবনে উন্নতির সোপান আপনা হতে আসে । ঠিক এস্কেলেটরের মতন তর তর করে এগিয়ে যাবে কোন বাধা থাকবেনা।
ঠিক বলেছেন । আমি একটু আসছি পরে দেখা হবে কেমন !
হ্যাঁ সার ।
আজ শালিনীর কোয়ার্টার এলটমেন্ট এর চিঠি আসে । খুব সুন্দর ছিম ছাম পরিবেশের মধ্যে কোয়ার্টার গুলো । ওর স্কেল অনুযায়ী  কোয়ার্টার এলট করা হয়েছে । ‘বি’ ব্লকের সেকেন্ড ফ্লোরে ‘ডি-৫’  । সামনে ফুলের  বাগান । ছোট্ট লন আছে । বিকেলে অনেকেই ওখানে সময় কাটান। ‘বি’ ব্লকে প্রায় সবাই ব্যাচেলার । একজন ম্যারেড এখানকার একাউন্টস অফিসার । উনি সদ্য বিয়ে করেছেন। ভদ্রলোক সাউথ ইন্ডিয়ান মনে হচ্ছে । আলাপ হয় নি । কাল রবিবার কোয়ার্টারে শিফট করবে । আজ দেখে-গেল । অফিস থেকে চাবি আর রেজিস্টার নিয়ে একজন কেরানী এসে শালিনীকে চাবি দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে গেল ।
সারাদিনের ক্লাসের পর টুকি টাকি জিনিষ কিনতে কাছেই মার্কেটে যায় বিকেলে । সব প্রয়োজনীয় জিনিষ একে একে গুছিয় কিনে একটা অটো নিয়ে ফেরে । এখানকার রাস্তাগুলো খুব পরিষ্কার , কলকাতার মতন খানা ডোবায় ভর্তি রাস্তা নয় এখানে । এখন ও কোথাও যাওয়া হয়নি । মাইনে পেলে মা বলেছেন লিঙ্গরাজ  মহাপ্রভুর মন্দিরে গিয়ে পূজো দিতে । 
  
শালিনী  রবিবার সকালে ১৫ মিনিট ধ্যানে বসে । মেডিটেশন বা ধ্যান একটি বিশেষ ধরনের একাগ্রতা  যাদ্বারা যে কোন  কাজ খুব সহজেই করা যায় । মানুষের মনকে স্থির করতে সাহায্য করে । প্রত্যেক মানুষের দিনে ১৫ – ২০ মিনিট মেডিটেশন করা প্রয়োজন । ও এটা বহুদিন ধরে চালিয়ে আসছে । 
শালিনী তার প্রথম ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের উদ্দেশে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু তথ্য এবং এই বিষয় পাঠের আবশ্যকতা সম্পর্কে বক্তব্য রাখে । ছাত্র ছাত্রীরা ওর লেকচার মন দিয়ে শোনে । ওর  অধ্যাপনা এবং গবেষণার অভিজ্ঞতার কিছু বিষয় বস্তুর কথা ছাত্র ছাত্রীদের  সামনে তুলে ধরে ,  তাদের  বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য । সব  ছেলে মেয়েরা ধৈর্য নিয়ে সম্পূর্ণ লেকচার শোনে । এটা যেহেতু ইন্ট্রোডাক্টারি লেকচার সেটাকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করতে পেরেছে বলে শালিনী মনে করে কারন সব ছাত্র ছাত্রীরা এক স্বরে ওর কথাগুলোর গুরুত্ব এবং আবশ্যকতা উপলব্ধি করে ওকে ধন্যবাদ দেয় ক্লাসের শেষে । এটাই ওর কাছে চরম পাওনা শিক্ষিকা হিসেবে। প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতার কথা অয়ন কে রাতে ফোনে বলে । যদিও অয়ন এ বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দেয়না। তা এই কথোপকথন থেকে স্পষ্ট  ।
শালিনী: আজ আমি ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের কাছথেকে খুব ভালো রেসপন্স পেয়েছি । আমি আজ খুব স্যাটিস্ফায়েড ।
অয়নঃ তুমি ত ভালো টিচার ।আগেও পড়িয়েছ স্কটিশে । রিসার্চ ও করেছ ।এ আর বেশি কি কথা !
না অয়ন এখানে পড়ানোর আলাদা মর্যাদা আছে সেটা তুমি বুঝবেনা ।
তা হয়তো ঠিক । তবে ...!
তবে !! তবে কি ?
না মানে আমি বেঙ্গালুরুথেকে বদলি হতে পারবোনা । কারন আমার বর্তমান কোম্পানি র প্যাকেজ ভালো এবং এখানে আমার ফিউচার যথেষ্ট ভাল ।
আমি ত তোমায় তা বলিনি । তুমি তোমার কাজে থাক আমি আমার কাজে থাকি ।
শালু সেটাতে কি আমাদের বিবাহিত জীবন সুখীর হবে ? তুমি বল !
কিন্তু অয়ন আমি এই কাজে এত মসগুল এবং সন্তুষ্ট তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছিনা ।
এত ছাত্র ছাত্রী পড়াও তাদের বোঝাতে পার কিন্তু আমার বেলায় তোমার সব অভিজ্ঞতা চুপসে যায় । কি হয় তোমার বলত ?
ওরা ছাত্র ওদের কথা আলাদা । তুমি কি আমার ছাত্র হতে চাও ?
এবার বোধ হয় তাই হতে হবে । তাতে তোমার সান্নিধ্য পাব তোমার সঙ্গে এক বিছানায়...!
ও ছাড়া কি আর কিছু চিন্তা কর না তুমি ?
কি ছাড়া ?
আমি জানিনা যাঃ তুমি খুব ...!  
আমি কি ?
বলবনা ।
তবে রাখি !
না না প্লিজ রেখোনা । আমি এই সময় টুকু পাই তোমার সঙ্গে কথা বলার । একটু কথা বলনা ।
সুধু কথায় কি হবে ? কিছু কাজে কর । এক কাজ কর তুমি কম্প্যুটারে এস স্কাই-পিতে । আস্তে পারবে ?
না আমার স্কাই পি একাউন্ট নেই ।
খুলে নাও । এখন রিসেন্ট ভার্সন আছে । চ্যাট করবো তোমার সঙ্গে । তোমায় একটু দেখতে পাব অন্তত বল ।
দেখে কি করবে ?
এসেই দেখ্বেঃ-
কাল চেষ্টা করবো । বাই ।
শালিনী যানে অয়ন অধৈর্য হচ্ছে ওকে পাওয়ার জন্য । সেটাই স্বাভাবিক ছেলেদের ক্ষেত্রে । শুধু ছেলেরা কেন মেয়েদের ক্ষেত্রেও ওটাই স্বাভাবিক কিন্তু ও কেন আলাদা ও নিজেই জানেনা ।
রাতে খাওয়ার পর বিছানায় গিয়ে সারাদিনের ক্লান্তিটা আরামে কাটাতে চাইল ।  অয়নের ফোন দেখে  আশ্চর্য  না হয়ে পারলোনা ।
হ্যালো ! এখন শুতে যাওনি ?
না ঘুম পাচ্ছেনা । তোমার মুখটা মনে পড়ছে ।
তুমি ছুটি নিয়ে চলে এস ।
কি বলছ তুমি ? তোমার মাথাটি খারাপ হয়েছে ?
হ্যাঁ তাই হয়েছে । আমার তোমাকে চাই ।
কিন্তু বিয়ের আগে সেটা সম্ভব না । তা ছাড়া আমার নতুন চাকরিতে কে আমায় ছুটি দেবে ?
আমি কিছু জানিনা । আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে ।
তাই ! যদি না শুনি !!
হ্যাঁ তাই ।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা । আমার একটা বেগালুরুতে ট্রেনিং আছে এক মাসের । সেটা বোধ হয় পরের মাসের ১০ তারিখ নাগাদ । এখন কিছু ঠিক হয়নি । তবে যেতেই হবে।
তা ১০ তারিখ অব্ধি আমি কি করব ?
আঙ্গুল চোষ ।  কথাগুলো বলে ফোন কেটে দেয় ।

১১শ পর্ব 
এখানে বেশ খাটুনি আছে । সকাল ৮টা থেকে ক্লাস । প্রাক্টিকাল ক্লাস । প্রায় সেমিনার, সিম্পোসিয়াম তাছাড়া কুইজ ,আওয়ার্লি, মান্থলি টেস্ট , প্রশ্ন পত্র করা ছাত্র ছাত্রীদের প্রপারলি গাইড করা ইত্যাদি। নিজেকে তৈরি করতে হয় তার জন্য লাইব্রেরিতে রিসার্চ টপিক পড়া । রেফারেন্সের জন্য বিভিন্ন বই পড়ে তবেই ক্লাসে জাওয়া । এখানকার পড়াশুনোর ধরন সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। স্টুডেন্ট টিচার রেলেসনশিপ কিছুটা পরিবারের মতন। প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীকে প্রপারলি গাইড করা অধ্যাপক অধ্যাপিকার দায়িত্ব যেটা সচর আচর অন্য সাধারণ শিক্ষানুষ্ঠানে দেখা যায়না । তাই এখানে শুধু থিওরি নয় প্রাক্টিকাল সেমিনার , সিম্পসিয়াম কি করে কন্ডাক্ট করতে হয়  এবং বিষয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞানের বিকাশের মূল বীজমন্ত্র দেওয়া হয় জাতে  এখান-থেকে সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র ছাত্রী পাস করে বেরিয়ে সেই বিষয়ে সম্পুর্ণ জ্ঞান আরোহণ করে  আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে পারে ।

শালিনী একদম সময় পায়না । কোনমতে সকালে দুটো পাউরুটির টোষ্ট এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে । সকাল ৮ টা থেকে প্রাক্টিকাল  বেলা ১.৩০ টায় ক্যান্টিনে লাঞ্চ খায় । বেলা  ২.০০ থেকে আবার ক্লাস । সারাদিন কি করে সময়গুলো চলে যায় বোঝা যায়না । কাউকে বেশি ফোন করতে পারেনা । রাতে যা মায়ের সঙ্গে আর অয়নের সঙ্গে দুটো কথা হয় ।

সারাদিনের খাটা খাটুনিতে রাতের ডিনারের জন্য দুটো রুটি একটু তরকারি আনিয়ে নেয় কাছের হোটেল থেকে । খাওয়ার এক কাপ গরম দুধ খেয়ে সোজা বিছানায় । চোখ বুজলেই গভীর নিদ্রা ।

 সারাদিনের এই ব্যস্তময় জীবন , মানুষকে অন্য কিছু ভাববার সময় দেয়না ।  তাই অয়নের কথা ভাববার অবকাশ নেই। অয়ন কিন্তু রেগে যায় বারে বারে। ও শালিনীকে চাকরি ছাড়তে বলেছে । শালিনীর সাফ কথা ,“আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে অসম্ভব ।” কথাটা শুনে অয়ন চুপসে যায় । কিছু করার নেই । নারী স্বধীনতার যুগে ওর কথা কে শোনে আর শুনবেই-বা কেন !  
শালিনী ডঃ ভট্টাচার্যর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ কারন উনি সমস্ত সময় সব বিষয়ে  ওকে গাইড করে যান । সব সেমিনারে ডঃ ভট্টাচার্য শালিনীর পাসেই থাকেন । এই ডঃ ভট্টাচার্য লোকটি খুব অমায়িক । উনি কেন অবিবাহিত জানতে ইচ্ছে করে শালিনীর । কিন্তু কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপারে জিগ্যেস করা ওর রুচিতে বাধে ।

একদিন রবিবারে সকালে মর্নিং ওয়াকে শালিনীর সঙ্গে দেখা ডঃ ভট্টাচার্য ।
ডঃ ভট্টাচার্যঃ-  গুড মর্নিং ।
শালিনীঃ-    মর্নিং সার ।
আমাকে সার বলেন কেন ? আমি আপনার কলিগ ।
না তা হয়না সার । আপনি সিনিয়ার । তা ছাড়া আপনি প্রফেসার আমি আপনার ছাত্রীর মতন । আমি অনেক জুনিয়ার । আপনাকে সার না বললে ছাত্র ছাত্রীরা কি শিখবে আমাদের কাছ থেকে !
কিন্তু আমরা বন্ধু ত হতে পারি ।
বন্ধু ! না সার বন্ধু !! ও সব ফেস বুকে চলে প্রাক্টিকাল লাইফে নয় ।
বন্ধুর কোন বয়েস হয়না । আমি আপনার কলিগ্ , বন্ধু হতে আপত্তি কোথায় ?
না আপত্তি নেই তবে সহমতিও নেই ... আমার বন্ধু আছে । আমি এনগেজড    বলে শালিনী একটু এগিয়ে যায় । আমার একটু পার্সোনাল কাজ আছে , আমি আসি সার । নমস্কার ।  বলে এগিয়ে যায় ।
ক্ষিপ্র গতিতে পা চালিয়ে নিজের ঘরে পৌঁছে এক গ্লাস জল খায় । অয়নকে ফোন করে । অয়ন তুমি আমাদের বিয়ের দিন ঠিক কর । আমাদের বিয়ে হওয়া উচিৎ ।
শালুর কথা শুনে অয়ন হচ কচিয়ে যায় । কি হল শালু ? কিছু হয়েছে ?
না কিছু হয়নি! তবে বিয়ে যখন করব বলে স্থির করেছি তখন আর দেরি করে লাভ নেই। তোমার মা বাবা কে বলে দিন স্থির কর আমি আমার মাকে ফোন করে সব বলছি । এই মাসেই কোন দিন ঠিক কর ।
আ-মিকি যাবো শালু ?
না তার দরকার নেই । তুমি এলেই  হ্যাঁলাম করবে হয়ত সকলের সামনেই ... । 
না করব না । প্রমিস্ । আমি নেক্সট ফ্লাইটে যাচ্ছি । কোম্পানির কাজ আছে  কলকাতাতে । এমনি যেতাম । না হয় তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব । কি বল ?
তোমাকে কিছু বলার উপায় নেই । আমার ছুটি নেই । কি করে তোমার সঙ্গে যাব ? বি প্রাক্টিকাল অয়ন সব বিষয় ছেলে মানুষী করা তোমার স্বভাব ।
আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে । একটু হামি খাব ।
আমি কিন্তু ফোন কেটে দেব ।
না না কেট না প্লিজ ।
তবে ওসব কথা বলছ কেন ?
কি সব কথা ডার্লিং !
জানিনা । তোমরা সব এক গোয়ালের ষাঁড় ।
তোমরা ! মানে !!  আর কেউ জুটেছে বুঝি !!! ওই চশমা পরা লোকটা নিশ্চয় ঘুর ঘুর করছে ? আমি জানতাম ওর মতলব ভালোনা ।
কি জাতা বলছ ! উনি আমার সিনিয়ার প্রফেসার । আমার গাইড । ওনার বিষয় এসব বলতে তোমার লজ্জা করছে না । সকলকে তোমার দাঁড়ি পাল্লায় ওজন করনা অয়ন।
তাহলে আমি তোমার কাছে জাবনা । তুমি আমাকে সব সময় বাজে কথা  শোনাও কিন্তু শালু । আমি সহ্য করি তোমাকে ভালবাসি বলে ।
আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি বলে আজ তোমাকেই সন্মান দিয়ে বলছি বিয়ের প্রস্তুতি কর । আর দেরি করা ভালনয় ।
 শালুর মুখে আজ ভালবাসার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে যায় । শালু সত্যি তুমি আমাকে ভালবাস ?
হ্যাঁ ! না বাসার কি আছে ? মেয়েরা একবার ই ভালবাসে মশাই । তোমাকেই ভালবাসি অন্য কাউকে নয় । এটা তুমি জানতে না!
কি করে জানব । মুখ ফুটে বলনি কোন দিন আজ বললে । সর্বদাই কলেজ , রিসার্চ , স্টুডেন্ট এই তোমার মুখে শুনেছি ।  প্রেম , ভালবাসা এসব তোমার মুখে দুর্লভ ।
আমিও মানুষ , আমি অন্যদের থেকে কি করে আলাদা হব বল।
তা ঠিক তবে তুমি বড্ড রুক্ষ । অন্যদের মত নও । আবার অন্য মেয়েদের মত শস্তাও নও যেটা আমাকে সবচেয়ে  বেশি আকৃষ্ট করে তোমার প্রতি।
তাই ! যানতাম-না । যেনে খুশি হলাম ।
আমিও যেনে খুশি হলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো বলে ।
তবে তোমার মা বাবাকে বল প্রস্তাব নিয়ে যেতে আমাদের বাড়ী ।
বলে দেখব । বাবা কি রাজি হবেন ? মাকে আমি রাজি করিয়ে নেব ।
শালু একটা মিষ্টি হামি দেবে ?
‘দিলাম’ বলে ফোন  ছেড়ে দেয় শালু । লজ্জায় মুখ লালা হয়ে যায় তার । একি ছেলে মানুষী করছে সে !  এটা ছাত্র ছাত্রীরা করে থাকে । না: এবার সংযত হতে হবে তাকে । 

১২শ পর্ব
ডঃ ভট্টাচার্য কেন শালিনীর প্রতি ঘনিষ্ঠ হতে চাইছিলেন সেটা ওর জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তবুও কেন যেন মনে হল ওনার থেকে আপাতত দূরে  থাকা শ্রেয়। কিন্তু শালিনী যা ভাবছে সেটা নাও হতে পারে। উনি হয়ত নেহাত বন্ধুত্বের খাতিরেই ওর কাছে বন্ধুত্বর হাত বাড়িয়েছিলেন। শালিনীর কি ওইরকম ব্যাবহার করা কি উচিৎ হল! বোধ হয় না। 
ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। কি সব আজে বাজে চিন্তা তার মাথায় আসছে!
যথারীতি ক্লাসে গিয়ে ক্লাস আরম্ভ করল। সকলকে বারে বারে জিজ্ঞাসা ,“আর ইউ ক্লিয়ার। শ্যাল আই রিপিট এগেন। ডোন্ট হেজিটেট টু টেল মি ইফ ইউ  কান্ট আন্ডারস্তেন্ড। ওকে ” এটা বলা ওর স্কটিশে পড়ানো থেকেই অভ্যাস।   
ক্লাসের পর কমন রুমে যায় লাইব্রেরী থেকে এক গাদা বই নিয়ে। কমন রুমে ঢ়ুকতেই একটা বই পড়েযায় হাত থেকে। খুব অপ্রস্তুত বোধ করে , কারন ডঃ ভট্টাচার্য বইটা নিঃশব্দে তুলে দেন শালুর হাতে।  
 ডঃ ভট্টাচার্য:- আপনি এত রেফারেন্স বই পড়ার সময় পান?
শালিনী:- হ্যাঁ সার। সময় করে নিতে হবেই। আপনারা সিনিয়ার, আপনাদের কথা আলাদা , তাছাড়া আপনি কত ছেলে মেয়েকে তাদের রিসার্চে গাইড করেছেন তারা আপনার আন্ডারে ডক্টরেট করেছে। আমিত নতুন সার। আমি  না পড়লে নিজে বিষয়টার প্রতি ক্লিয়ার কনসেপ্ট না থাকলে ছাত্র ছাত্রীদের পড়াব কি করে? আমার পড়াশুনো বিশেষ প্রয়োজন। তাই ক্লাসের পর কমন রুমে এসে রেফারেন্স বইগুলো পড়েনি। নিজের নোট নিজে তৈরি করি।  
ঠিক বলেছেন। এটা অনেকেই করে না। ছাত্র ছাত্রীকে লাইব্রেরী-থেকে বই  নিয়ে পড়তে বলেন। কিছু রেফারেন্স ও দিয়ে দেন। তবে আমাদের এখানে  সকলে সম্পূর্ণ প্রস্তুতির পর ক্লাসে যান। এটা এখানকার সিস্টেম। আমার দেখে ভাল লাগল আপনি এখানকার সিস্টেম ফলো করছেন। ডার্টস গুড।  কিপ ইট আপ। ইফ  ইউ নিড এনি রেফারেন্স প্লিজ টেল মি। ওকে। আসি তাহলে। 

হ্যাঁ সার। শালুর ঘাম ছুটছিল কথা বলতে বলতে।  তা ছাড়া  সকালের ব্যবহারে ও খুব লজ্জিত কিন্তু সার কিছু মনে করেন নি মনে হচ্ছে। এখানে ও ছাড়া মৌসুমি মিশ্র নামে আরেকজন মহিলা আছেন উনিও নতুন। কিন্তু উনি এখানকার বাসিন্দা তাই ওঁর সঙ্গে প্রায় দেখা হয়না। ওনার ফ্যাকাল্টি আলাদা। 
সারাদিনের ক্লাস সেরে সন্ধ্যাতে ফেরে।  সন্ধ্যার সময় খুব টায়ার্ড থাকে। মা থাকলে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতেন মুখের সামনে। এই সময় চায়ের বিশেষ প্রয়োজন। মাকে খুব মিস করছে শালু। কিন্তু কিছু করার নেই নিজেকে কষ্ট করতে হবে মা ত চিরদিন থাকবেন না ওর মুখে মুখে জোগাতে। 
মায়ের কথ ভাবতেই মায়ের ফোন। এটা কি টেলিপ্যাথি না কি?  
হ্যালো! হ্যালো!! শালু মা। কেমন আছিস? তোর কোন খবর না পেয়ে ফোন করছি। 
আমি ভাল আছি মা। এখুনি তোমার কথা মনে করছিলাম। তোমাকে আরেকটু পরেই ফোন করতাম। তোমরা কেমন আছ মা? টুকাই , দিদি , জিজু সব কেমন আছে? তোমাদের কথা সব সময় মনে করি মা।  একটা কথা তোমাকে বলি। অয়নের বাবা মা তোমার ওখানে যাবেন। ওরা গেলে সব যানতে পারবে। আমি এখন স্নান সেরে একটু পড়াশুনো করব। এখন রাখি।  
আমার কথা না শুনে , “অমনি রাখি”। তুই কি রে? তোর হৃদয় বলে কি কিছু নেই! আমার কথা কি মনে পড়ে না!!   ওনারা কেন আসবেন বল ত মা?  
হৃদয় আছে মা। তোমার কথা ভাবি। সকলের কথা ভাবি।  আমি কি করে বলব বল ওনারা কেন আসছেন? 
তুই সব জানিস। কি হয়েছে শালু বলনা?
আমার বলতে লজ্জা করে। তুমি সব জানবে। বললাম ত ওনারা আসবেন। আমি রাখি এবার।  
আচ্ছা বাবা আচ্ছা। মেয়ে আমার এতদিন পর কথা বলবে ...তাও  সব পেটে রেখে কথা বলে। কিছু খুলে বলতে পারে না। কি হয়েছে তোর?  
কি আবার হবে? ভালই আছি। আমার ঘুম পাচ্ছে মা।
এই বললি পড়বি আবার এখন ঘুম পাচ্ছে। কি হয়েছে তোর বলত? 
বললাম ত অয়নের মা বলবেন বলে।
কেন তোমার মুখ থেকে শুন-বোনা কেন? 
আমি জানিনা। তুমি বিরক্ত করো নাতো?
ও বুঝেছি! তা ভাল। ঠিক আছে কবে আসবে তারা? 
আমি কি করে বলব এসবের উত্তর। ওই জন্য আমি কিছু বলতে চাইনা তোমাদের। আমি রাখছি মা। ভাল থেকো। নিজের দিকে নজর দিও। আমার কথা ভেবনা। 
না তোমার কথা ভাববোনা! ঠিক আছে খেয়ে ঘুমিয়ে  পড়। ও হ্যাঁ ভাল কথা , অয়ন ফোন করে তোকে? 
হ্যাঁ অয়ন ফোন করে , বারে বারে করে। ফোন ধরলে তোমার মত ছাড়তে চায়না। সব সমান তোমরা। কথাগুলো একটু জোরেই বলল। তারপর ভাবল পাশের ঘরে  লোক শুনলে কি ভাববে? রাখছি মা। ভাল থেক।

১৩শ পর্ব 
শালিনী মন স্থির করতে পারছেনা বিয়ের ব্যাপারে। অথচ বয়েস থাকতে , বিশেষ করে মায়ের মণ  রাখতে বিয়েটা সেরে ফেলতেই হবে। এত দিন এড়িয়ে চলেছে এখন না করে উপায় নেই। মায়ের বয়েস হচ্ছে। ওনার দিকটাও ভাবা প্রয়োজন।
আজ রবিবার। সারাদিন বিশ্রাম। ঘর গুছতে গুছতে মায়ের কথা ভাবছিল। আজ মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলবে সে। সেদিন মা নিশ্চয় খারাপ কিছু ভেবেছেন। ওর ব্যাবহার টা অনেক সময় রুক্ষ হয়েযায়। ও নিজেও বোঝেনা সে কথা। লোকে খারাপ ভাবে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো ....... কে?
আমি ডঃ ভট্টাচার্য।
ও! হ্যাঁ সার .... দরজা খুলে গুড মর্নিং সার। আপনি কষ্ট করে এলেন কেন? আমাকে ডাকলেই আমি চলে যেতাম পার্কে! আসুন আসুন সার বসুন। 
ভেরি গুড মর্নিং। আজ আপনি মর্নিং ওয়াকে যান নি? আসলে  আপনি ঘর দোর কেমন সাজিয়েছেন দেখতে এলাম। আপনার অসুবিধে হবে না ত!
না না অসুবিধের কি আছে সার?  আপনি বসুন আমি চা করে আনি।
ডঃ ভট্টাচার্য শালিনীর ঘর গোছানোর সুখ্যাতি না করে থাকতে পারলেন না ... (শালিনী চা বিস্কুট হাতে ঢ়ুকছিল ঘরে) ... আপনি সুন্দর গুছিয়েছেন ঘরটা। আপনার ‘টেস্ট’ এর  প্রশংসা না করে থাকতে   পারছিনা। 
(চা দিতে দিতে) ... এটা বাড়িয়ে বললেন সার।  কি এমন গুছিয়েছি। কিছুই ত নেই গোছানর মত।  কিছু বই, রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎ রচনাবলী, মাদার টেরেসার ছবি, পরম পুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের যুগল ছবি। এ ছাড়া একটা এলসিডি-টিভি আর পাশে একটা ল্যাপ্ টপ।  পাসের ঘরে একটা  সিঙ্গিল বেডের খাট। ওটা গেস্ট রুম থেকে এনেছে। নতুন খাট এলে ফিরিয়ে দেবে।
চা খেতে খেতে সার চায়ের সুখ্যাতি করলেন। এটা ত বাগানের চা (দার্জিলিং টি)। বাঃ কি ফ্লেভার! একটা কবিতা মনে পড়ছে।

সকালের চা
ভরা পেয়ালায় তৃপ্ত মনে শেষ চুমুকেই মহা শূন্যতা
ধূমায়িত উষ্ণ শিহরন ক্ষণে মনের কাটায় বিষণ্ণতা।  
উদ্বুদ্ধ হলাম খানিক ক্ষণে কাটিয়ে দিলাম নীরবতা,
যত আলস্য নেই অবশ্য সকালের এই স্তব্ধতা।
এক পেয়ালা চা অবশ্য পুলক অনুভবের পূর্ণতা,
এর অন্যথা জীবন ব্যর্থ নেই তাতে কোন পূর্ণতা।

বাঃ। খুব সুন্দর। এটা কি আপনার লেখা।
না না। এটা যিনি লিখেছেন তিনি নেপথ্যে থাকেন। মানে থাকতে ভাল বাসেন। 
ও তাই।  হ্যাঁ আমার মামা এনেছেন এই চা। উনি ডুয়ার্ষে চা বাগানের ম্যানেজার। উনি মাঝে মাঝে   নিয়ে আসেন আসার সময়। আমাদের বাড়ীতে তাই ওই দার্জিলিং এর চায়ের চলন। বাবা ওই চা খেতে খুব ভাল বাসতেন ... চুপ করে যায় শালিনী।
কি হল? চুপ করে গেলেন যে!
আপনার কথা শুনব বলে। হেঁসে জবাব দেয় শালিনী ।
আমার কথা! ও না শোনাই ভাল!!  ছোট বেলায় বাবাকে হারাই। মা স্কুলের টিচারই করতেন। অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি। কঠিন অর্থের অভাবে দিন কাটিয়েছি। টিউশনি করে লেখা পড়া করেছি। ধার দেনা করে এক বোনের বিয়ে দিয়েছি। এখন মা একা। রিটায়ার করেছেন। একাই থাকেন। আমি মাসে একবার যেতে চেষ্টা করি। নানান কাজে হয়ে ওঠে না। ওই ফোনে যা কথা হয়।
শালিনীকে একটু অন্য মনস্ক দেখাচ্ছিল। কি এক চিন্তায় মসগুল মনে হচ্ছিল। হঠাৎ বলে ,হ্যাঁ সার তারপর?
বোনের বিয়ের জন্য নিজের কথা ভাববার সময় পাইনি। 
এই সময় মায়ের ফোন এল। সাইলেন্ট মোডে ছিল তাই আওয়াজ হয়নি।  সরি সার কিছু মনে করবেন না। মায়ের ফোন। একটু কথা বলি!
 হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। আমি আসি তাহলে।
হ্যাঁ সার আপনি আসুন। (আসলে শালিনী এটাই চাইছিল। এর মধ্যে সারের অজান্তে মাকে একটা মিস কল দেয় সাইলেন্ট মোডে , তাই মা কল ব্যাক করেন)। 
ওপার থেকে .... শালু মা তোর শাশুড়ি একা এসেছিলেন।
শাশুড়ি! আকাশ থেকে  পড়ে!! কি বলছ তুমি? আমার আবার  শাশুড়ি??
হবু শাশুড়ি ... মেয়ের আমার সব কথায় খুঁত ধরা! পারিনা!! শোন মা।
বল। তা কি বলেছেন? এখানে তোমার আরেক জামাই আমার পেছনে লেগেছেন। ভাবছি তোমায় নিয়ে আসবো।
কে শুনি? ভাল ছেলে? অয়নের চেয়ে ভাল??
তোমার কি মনে হয় মা! তুমি বড্ড লোভী!!  ভাল ছেলে হলেই অয়নকে ছেড়ে তাকে ধরতে হবে? অয়নকে আমি কথা দিয়েছি মা।  আমি আমার কথার মূল্য হারাতে পারি না।
তা ঠিক বলেছিস মা। হ্যাঁরে ওরা ত কিছুই দাবি দাবা করছে না। ওদের শুধু ১০০ জন বরযাত্রী আসবে। তাদের আদর যত্ন করতে হবে।
ও বাবা! এত দুর কথা গড়িয়েছে! ‘মা’ আমার করিত কর্মা। তা তুমি কি বললে? 
কি আবার বলব। তোর দিদি জামাই বাবু ছিলেন। ওরা দফা করেছেন ৫০ জনের জন্য। আজকালকার বাজারে ১০০ জনের আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা! তা ছাড়া আমাদের আত্মীয় স্বজন আছেন না!!
তারপর। এত বিশাল আয়োজন! তা তুমি আমায় ঘাড় ধাক্কা দেওয়ার জন্য আর কি কি আয়োজন করেছ বল-দেখি!! 
তোর সবেতে ঠেস দিয়ে কথা বলা। এই স্বভাব টা ছাড় শালু। শ্বশুর বাড়ী গেলে কি করবি শুনি?
আমি ওখানে যাব বলে কি করে জানলে? আমি আমার কাজের যায়গায় ফিরে আসবো। ওই সব বৌ সেজে আদিখ্যেতা আমার পোষাবে না। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে চলে আসবো। ও সব আয়োজন বন্দ কর। আমার সময় নেই টাকাও নেই। তাতে বিয়ে হয় ত হবে নাহলে নাই। টাকার শ্রাধ্য আমি করতে পারবোনা । কে দেবে অত টাকা শুনি? বাবা গত হওয়ার  পর যা টাকা আছে সে তোমার কিছু ভাল মন্দ হলে তখন! কে দেখবে? আমি তোমায় নিয়ে আসবো আমার কাছে। যত সব বুজরুকি ..১০০ জন বরযাত্রী .. মগের মুলুক!! দেশের লোক খেতে পাচ্ছেনা ওদের ১০০ জনের খাওয়ানোর জন্য আয়োজন দরকার। কি সব সেকেলে চিন্তা ধারা।
ঠিক আছে আমি সব শুনলাম। তুমি এখানে আমার কাছে আসার জন্য তৈরি হও। আমি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসবো। এখানে একা থাকতে অসুবিধে আছে।
রক্ষে কর মা।  তোমার রাত দিন কট কটানি কে শুনবে?
তবে যে বল আমার জন্য তোমার চিন্তায় ঘুম হয়না!
সেতো হয় না। আমি ‘মা’। তুমি ত ‘মা’ হও নি কি করে বুঝবে মা?
তাহলে তুমি আসবে না! আমার এখানে অসুবিধে হচ্ছে। আমার প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে।
প্রাইভেসি! কেন কে আবার তোর ‘প্রাইভেসি’ নষ্ট করছে শুনি। 
তুমি চিনবে না। তুমি আসবে কিনা বল? আমি তোমাকে শনিবার আনতে যাব। দু দিনের ছুটি আছে। তা ছাড়া আমার কাছে কিছু দিন থেকেই দেখ না।
ঠিক আছে তাই হবে। শনিবার কখন আসবি?
এখান-থেকে জন শতাব্দী তে যাব। পরের দিন ফিরে আসব। ওখানে ওই ট্রেনটা দেড়টা নাগাদ পৌঁছয়। মানে বাড়ীতে ঢ়ুকতে ৩ টে ত বটেই। গিয়ে ভাত খাব। তোমার হাতের রান্না অনেক দিন খাইনি।
মেয়ের আদিখ্যেতা দেখ! আজ বাদে কাল বিয়ে হলে তোর মা থাকবে? তখন কি করবি শুনি?
হোটেল থেকে আনিয়ে খাব। এখন ত তাই করছি মা। রান্নার সময় কোথায়?
অয়নের ফোন এল বোধ হয় ; এখন রাখি মা। ভাল থেক। ওইসব বিয়ের আয়োজন করতে হবে না। অয়নের সঙ্গে আমি কথা বলব তারপর ও যা বলবে তাই হবে। রাখি।
আচ্ছা। তাই হবে। আমি জানি সবেতেই তোমার খবরদারি। সে ছেলেটাকে তুমি ই বলবে সে কি আমার জানতে বাকি আছে! গোবিন্দের ইচ্ছা মা আমি কে!!
আবার কে কলিং বেল বাজায়? দরজার কাছে গিয়ে আই পিসে দ্যাখে অয়ন সঙ্গে সিকুরিটি !
দরজা খুলে অয়নকে দেখে হচ কচিয়ে যায়  ... ওমা তুমি! কিছু না জানিয়ে এলে যে!!  সিকুরিটির দিকে তাকিয়ে বলে তুমি এস।  উনি আমার পরিচিত।
কেন আমার ত আজ ই  আশার কথা। তুমি যান না? সেদিন ই ত কথা হল। তুমি আমাকে হোটেলে উঠতে বললে। মনে নেই।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ!! তা কোন হোটেলে উঠেছ শুনি?
 খুব নামজাদা হোটেল “হটেল মে ফেয়ার লাগুন” ৩ স্টার হোটেল। একটা সুট নিয়েছি ।  আমাকে বসতে বলবে না।  ফ্লাইটে কিছু খাইনি। চল বাইরে খেয়ে আসি।
৩ষ্টার হোটেলে সুট নিয়েছে শুনে শালিনীর মনে খটকা লাগে। কিন্তু কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বলে ,  “ওমা সেকি? আমি আনিয়ে দিচ্ছি। তবে তোমার ওই হোটেলে আমি জেতে পারবোনা। একদিন ছুটি পাই সেটা বাড়ীতেই থেকে কাটাই। তাছাড়া এখানে আমি কোথায় বেরোই না। খুব প্রয়োজন হলে সিকুরিটি কিম্বা অন্য কাউকে দিয়ে আনিয়ে নি।”
কিন্তু আমি যে তোমার জন্য সুট বুক করলাম।  ঠিক আছে। আমার সময় কম। নেক্সট ফ্লাইট ৫ টায়। এই ক ঘণ্টা একটু তোমার সঙ্গে কাটাব। 
অসভ্যতা-মি করবে না কিন্তু। লক্ষ্মী ছেলের মত যা বলব তাই করবে। এখানে দেওয়ালের ও চোখ কান  আছে। আমি একা মহিলা বুঝতেই পারছ। এখন ও আমাদের বিয়ে হয়নি। 
হ্যাঁ তাই করব। বলে ত দেখ। আগে বাথ রুমে যাব। বাথ রুমটা কোথায়?
শালিনী, অয়ন কে  বাথ রুম দেখিয়ে সিকুরিটির কাছে গেল হোটেল থেকে ওদের দুজনের জন্য খাবার আনাতে।  তারপর মিসেস নায়ারের বাড়ী গিয়ে ওনার সঙ্গে কিছু কথা বলে  কোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতে  মিনিট কুড়ি ত্রিশ সময় লেগেছে । কোয়ার্টারে এসে দ্যাখে দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে কেউ নেই। অয়নের একটা চিরকুট দ্যাখে কম্পুটার টেবিলে ওপর,  তাতে লেখা- “সরি ডিয়ার আমি এসেছিলাম   তোমার সান্নিধ্য পেতে , তোমার হোটেল থেকে আনান খাবার খেতে নয়। আমাকে তুমি এভাবে অপমান করতে পার না। আমি তোমার জন্য দামি হোটেলের স্যুট বুক করেছিলাম। আমরা দুজনে সময় কাটাব বলে কিন্তু তুমি শুনলে না।  তুমি নিজেকে কি মনে কর? আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য কি এতই পাগল? আমার বাবা মায়ের কাছে আমি অনেক স্নেহ পেয়ে বড় হয়েছি। তোমার আমাকে এতই সন্দেহ যে তুমি আমাকে একা ফেলে চলে গেলে বাইরে! এটা কি ধরনের ভদ্রতা! ফর ইওর ইনফরমেশন আমি আর কোন দিন কোন সম্পর্ক রাখবো না তোমার সঙ্গে। গুডবাই!”
শালিনী থর থর করে কাঁপে চিঠিটা হাতে ধরে। দু চোখ বেয়ে জল বোয়ে যায়। অয়নকে ও সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে। এখন তার মূল্য ওকে দিতে হবে। ওর বিষয় ভ্রান্ত ধারনা অয়নের। সেটা ওকে বোঝাতে হবে। কোন পর পুরুষের সঙ্গে হোটেলে সময় কাটান ওর মতন মেয়ের রুচিতে বাধে। কিন্তু কি করে বোঝাবে ও ...!

১৪শ পর্ব 
শালিনী সত্যি খুব দুঃখ পেয়েছে অয়নের ওই ব্যাবহারে। তার প্রাণে হয়ত সঙ্গীতের মুর্ছনা নেই কিন্তু কিছু শব্দ বেরিয়ে আসে সেগুল জুড়লে বোধ হয় একটা গান লেখা হয়ে যাবে। মনে ব্যাথা পেলে বোধ হয় আপনা হতে বেদনার গান লেখনির মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। শালিনী তার ব্যতিক্রম নয় কথাগুল ভাবতে ভাবতে ওর চোখে জল আসে।

আজ শ্রাবণের ধারার মত অশ্রু ঝরে
তোমার বিরহের বেদনা তে রক্ত ঝরে
মুখে নেই ভাষা আছে সুধু ভালোবাসা
বুঝি আমি তোমার চোখের যে ভাষা (১)
অশনি সঙ্কেত ওই আকাশে গুরু গম্ভীর নাদে
মেঘের পরশে আজ বাতাস যে কাঁদে
তবু ঝরে মোর আঁখি হতে অবিশ্রান্ত ধারা
কম্পিল যে আজ মৃদু তালে ধরণী ধরা (২)
তোমারি ছবি দেখি মনের আঙ্গিনায়
ভুলিনিগো তোমারে ভুলিনি যে হায়
বিরহ যাতনা যে আর নাহি সয়
স্মৃতিটুকু রেখেছি মনে এই ভরসায়
ফিরিয়া আসিবে তুমি সেই ভরসায় (৩)
আজ শ্রাবণের ধারার মত অশ্রু ঝরে
তোমার বিরহের বেদনা তে রক্ত ঝরে
.
এই বিশাল পৃথিবীতে একলা মহিলা নিজের সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে তার সমস্ত কাজ সুচারু রূপে করা এক কঠিন পরীক্ষার মত। তাতে উত্তীর্ণ হওয়া শক্ত। তার মনকে শক্ত করতে হবে। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। অয়ন বুঝতে পারলোনা যে এটা এমন এক প্রতিষ্ঠান যেখানে কোন রকম অশালীনতা বরদাস্তর বাইরে। সামান্য কিছু ঘটলে শালিনীর ক্যারিয়ারের ওপর আঁচ পড়বে সেটা সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবে না। কারুর কাছে মুখ দেখাতে পারবে না সেটা কি অয়ন বোঝেনা!!

অয়নকে বোঝানর জন্য ফোন করে কিন্তু ও কেটে দেয়। বাড়ীতে কাউকে বোঝাতে পারবেনা। মা তাকেই দুসবে বারে বারে। এটাই বোধ হয় মেয়েদের প্রধান সমস্যা। অগত্যা বাড়ী যাওয়ার কথা ভুলে নিজের কাজে মন দেয়। ডঃ ভট্টাচার্য সত্যি ভদ্র লোক। উনি কিন্তু শালিনীর অনেক খারাপ ব্যাবহার সহ্য করেছেন। কিছু কখন মুখ ফুটে বলেন নি। বেশ কিছুদিন এরকম চলে। শালিনী বেঙ্গালুরুর ট্রেনিং টা পরে যেতে চায়। ওর মন একদম ভালো-না কদিন ধরে। মেয়েদের মনে প্রথম বসন্তে কোন পুরুষের আগমন হলে সাধারণত সেই আঁচড়টা থেকেযায়। সেটা ভুলতে পারে না ওরা। ওটাই অনাবিল প্রেমের নিদর্শন। ওতে কিছু খামতি থাকে না। এটাই বোধ হয় প্রকৃতির নিয়ম। তাই শালিনীর জীবনের প্রথম প্রেম তার মনে দাগ রেখে গেল। ও সেটা শত চেষ্টা করেও মুছতে পারছেনা।

এক রবিবারে মা ; জিজু, দিদি, টুকাইকে সঙ্গে করে হাজির হলেন ভুবনেশ্বর। শালিনী ওদের দেখে আশ্চর্য হয়। বলে কিগো তোমরা কিছু না বলে চলে এলে যে। আমাকে খবর দেবে ত! 
মা বলেন:- সবাই তোকে সারপ্রাইজ দেব ভাবলাম। কোই অয়নদের বাড়ীথেকে ত কেউ এলেন না। 
শালিনী:- আমি কি করে বলব মা এখানে বসে? ওরা আসবে কি না আসবে ওদের ব্যাপার। ওরা বড়লোক ওদের খেয়াল খুশী অনুজাই চলে। খেয়াল হয়েছিল আমাকে বিয়ে করবে বলে এখন সে খেয়াল মাথা-থেকে চলে গিয়েছে। ব্যাস। আমি দিব্বি আছি। আমাকে আর কেউ আর বিরক্ত করবেনা বিয়ের ব্যাপারে। তোমরা সব একে একে ফ্রেশ হয়ে নাও। দুটো বাথ রুম আছে। 
একটা বন্দ থাকে। তোমরা এলে ভালই হল। আজ চল সকলে মিলে পুরী যাই। 
টুকাইকে পেয়ে শালু খুব খুশি।

একটা টয়টা ইনো-ভা ভাড়া করে সকলে পুরী বেড়াতে গেল বেলা ১২ টা নাগাদ। ওখানে, “হলিডে রিসোর্ট হোটেলে” জিজু .. দুটো রুম বুক করেছিল। জিজু, দিদি দুজনে ব্যাঙ্কের থেকে এল টি সি পায় তাই ওরা প্রত্যেক বছর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়। শালিনীকে অনেকবার বলেছে ওরা ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য কিন্তু ওত অন্য ধাতের মেয়ে। ওসব বেড়াতে যাওয়া ওর ভালো লাগে না। কিন্তু এবারে মা সঙ্গে তাই মানা করলনা। তাছাড়া এমনিতেই ওর কেমন দম বন্দ লাগছিল। 
পুরী বেড়ানটা ভালই লাগছিল। সমুদ্র, নুলিয়া, জগন্নাথ ঠাকুর দর্শন এর বিশেষ আকর্ষণ। মা মানত করেছেন শালুর বিয়ে হলে পূজো দেবেন। মা সত্যি উতলা হচ্ছেন ওর জন্য। তার-পরদিন শালুর ক্লাস ও সকাল সকাল মাকে নিয়ে ট্রেনে ফিরে আসে ভুবনেশ্বর। দিদিরা ওখানে আরও দুদিন থাকবে। 
অনেক দিন পর মাকে পেয়ে শালু খুব খুশি।
অনেক দিন বাদে মায়ের হাতের রান্না খাবে। সত্যি মা না-থাকলে ওর খুব বাজে লাগে।তাই নিজে বাজার থেকে সব গুছিয়ে কিনে এনেছে। বাজার থেকে ফেরার সময় মা’কে ওর কোয়ার্টারের সামনে ডঃ ভট্টাচার্য র সঙ্গে কথা বলতে দেখে আশ্চর্য হয়। কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই সারকে “গুড মর্নিং সার বলে উইশ করে”। 
আপনার মা এসেছেন বলেন-নিত মিস সান্যাল!
হ্যাঁ সার, মা আজ আমার সঙ্গে এসেছেন। 
বাঃ এত আনন্দের কথা। আমার কথা বলার লোক এসে-গিয়েছেন। আমার একটু সময় কাটবে। কোন আপত্তি নেইত আপনার! 
মা বলেন, “ওমা সে কি কথা! এত আনন্দের কথা। আমাদের ও সময় কাটবে”। আপনার মা বাবা কি দেশে? 
না মাসিমা ছোট বেলা থেকেই আমি পিতৃ হারা। মা স্কুলের টিচার ছিলেন। তিনি অনেক কষ্টে আমাকে মানুষ করেন। এখন উনি কলকাতায় আছেন মামার বাড়ীতে। 
মাকে নিয়ে আসেন না কেন? 
মায়ের বয়েস হয়েছে তাই উনি ওখানেই থাকতে ভাল বাসেন। 
ও তাই বুঝি। তুমি বাছা একদিন আমার এখানে আমার হাতের রান্না খেও। আমি গুছিয়ে নি তারপর তোমায় খবর দেব কেমন! 
শালিনী ও ঘর-থেকে সব শুনছিল। মায়ের আক্কেল দেখে অর গা রি রি করে উঠলো। একদম সেকেলে। হুট করে সকলকে আপন করে ফেলে। আগু পিছু ভাবে না কি হতে পারে! 
তোমার বিয়ে হয়েছে বাবা? সার লজ্জায় বলেন না মাসিমা হয়নি। আমি পরে আসবো একদিন। এখন জাই। কাল ক্লাসের জন্য পড়াশুনো করতে হবে। 
সার জাওয়ার পর শালু মায়ের ওপর খড়গ হস্ত। কি দরকার তোমার ওনার সঙ্গে এত কথার শুনি? তুমি এখানেও ওই এক কান্ড করবে দেখছি। সকলকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করবে তার বিয়ে হয়েছে কিনা! কি তুমি মা! কেন বোঝ না এসব বলতে নেই। আমি পারব না তোমাকে বোঝাতে। শালু খুব আস্তে তার মা’কে বিদ্রূপের সঙ্গে বলে, “তা তোমার নতুন জামাইকে কবে খাওয়াচ্ছ শুনি?” 
মা হতবাক হয়ে-জান ওর কথা শুনে। ওই ছেলেটি খুব ভাল শালু। ওর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল তাই বললাম। তুই রাগ করছিস কেন মা? ওত তোদের এখানেই পড়ায়। পাত্র হিসেবে-ত ভালই। 
মা .. মা .. তোমাকে নিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে জাবে। গর্জে ওঠে শালু। যাকেই দেখবে ওমনি পাত্র হিসেবে তাকে গ্রহণ করবে। আমি কি এতই ফেলনা তোমার কাছে। আমার কোন মতা মত নেওয়ার প্রয়োজন হয় না দেখি তোমার! কি ভাবো মেয়েদের তোমরা! মেয়ে হয়ে জন্মান কি এতই পাপ! 
মা চুপসে জান। জানেন মেয়ের রাগের কথা। 
পরের দিন শালু যথারীতি কলেজে চলে জায়। 
ডঃ ভট্টাচার্য র সঙ্গে দেখা হয়নি কিম্বা কোন কথা হয়নি। ডাইরেক্টারের অফিস থেকে শালিনীর ডাক আসে। সেখানে গিয়ে ও বেঙ্গালুরুর ট্রেনিং এর চিঠি পায় এক মাসের ট্রেনিং আই আই এস সি 
তে .ওখানে প্রফেসার অনুরাগ কুমার, ডাইরেক্টর আছেন। টিকিট সমেত জার্নি এক্সপেন্সেস এবং এক মাসের আগাম মাইনে একটা খামে ভরে অফিসে দিয়ে দেয় শালিনীর হাতে। আর তিন দিন সময় আছে রওনা হওয়ার। 
জিজু, দিদি, টুকাই আজই এসে পৌঁছয়। মাকে ওদের সঙ্গে যেতে হয় কারন এখানে মা একলা থাকা সম্ভব না। শালিনী IIST তে থাকা কালীন ওখানে চেষ্টা করবে কোন জবের জন্য। অয়নের কাছে থাকতে পারবে। অয়ন ও ওর ওপর রাগ করবে না।
অয়নকে ওর মেল আই ডি তে একটা মেল পাঠায় বেঙ্গালুরু যাওয়ার আগের দিন। তাছাড়া ওকে এস এম এস করে স্টেশনে থাকতে বলে। শালিনী যানে, অয়ন কখনই না এসে থাকতে পারবে না। ৩২ ঘণ্টা ট্রেন জার্নির পর ওর খুব টায়ার্ড লাগছিল। স্টেশনে অয়ন আসবে কিনা জানেনা কিন্তু ওর দৃঢ় বিশ্বাস অয়ন আসবেই। সত্যি অয়ন এসেছিল। খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। অয়নকে দেখে শালু ধাতস্থ হল।ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল বিগত ঘটনার জন্য দুঃখিত কিন্তু ও নিরুপায় ছিল। অয়ন ও এক গুঁয়ে ছেলে। ও কিছুতেই ওটাকে সহজ ভাবে নিতে পারলোনা।

কালকে IIST তে জএন করতে হবে। তাই আজ কোথাউ রেস্ট নেবে শালু। Krishinton Suites হোটেল IIST র কাছে। তাই ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল শালিনী।
ও নিজে সব ফর্মালিটির পর নিজের নামে রুম নিলো PAN কার্ড দেখিয়ে। অয়ন বারুণ করলনা কারন ও যানে শালিনী কারুর অনুগ্রহ পছন্দ করে না। দুজনের মধ্যে সেরকম কোন কথা হলনা। 
শালিনী রুমে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয় পরে কিছু জলখাবার খায়। এখানে ইডলীর চল বেশি। তাই খেল দুজনে। তারপর সব ঘটনা অয়নকে একে একে বলল। অয়ন শুনে সেরকম খুশি হলনা। কিন্তু অখুশিও হলনা কারন ও সত্যি শালুকে ভালবাসে। শালু কিন্তু বিশাল বিয়ের আয়োজনের পক্ষে নয়। খুব কম লোকের আয়োজনের মধ্যে বিয়ে সারতে চায়। মায়ের ইচ্ছে দিদির বিয়ের মতন ওর বিয়ের ও আয়োজন করবেন এক ই ভাবে কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। এসব খর্চা বিলাসিতা মনে করে শালিনী তাই ও অয়নের মতা মত নিলো। 
অয়ন হ্যাঁ না কিছুই বললনা। শুধু বললো, আমি বাবা মায়ের একটাই ছেলে, তাঁদের ইচ্ছার বিরুধ্যে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। 
শালুর নিজের কেরিয়ার আছে। ও এখন এই সব টাকা নয় ছয় করতে পারবে না সেটাও অয়নকে জানিয়ে দিল। 
দুজনের মধ্যে কেউ ই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলোনা। যে যার যুক্তিতে অনড়। 
শালু খুব ক্লান্ত ছিল। ও হোটেলে গিয়ে রেষ্ট নিল। অয়ন চলেগেল ওর অফিসে। রাতে মার ফোন এল শালুর কাছে। অয়নের মা এসেছিলে শালুদের বাড়ী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ছেলের কথায় ৫০ জন বর যাত্রীতে ওনারা রাজি হলেন কারন ছেলে বলেছে শালুকে ছাড়া আর কাউকে ও বিয়ে করবে না। বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গিয়েছে ১৫ ই বৈশাখ। ভাল দিন আছে। প্রায় এক মাসের ওপর বাকি। এর মধ্যে সব প্রস্তুতি। 
শালু সব শুনল। কিছুই মন্তব্য করলনা। হুঁ হাঁ তে কথা সারল মায়ের সঙ্গে।
এর মধ্যে শালুর ট্রেনিং শেষ হতে চলেছে। 
অয়নের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ওর কাজের চাপ বেড়েছে। রাতে ফোন করে। শালু এখানে প্রচুর ব্যস্ত থাকে। বাইরে যাওয়ার সময় পায়না। আজকাল অয়ন খুব চুপ চাপ হয়ে গিয়েছে আগের চেয়ে অনেক পাল্টে গিয়েছে এই কদিনে। রবিবার আসে শালুকে নিতে। কেনা কাটা করে। বেঙ্গালুরুর ইস্কনের মন্দীরে যায় দুজনে। যায়গাটা ওদের দুজনের ই ভাল লাগে। শালু মায়ের জন্য চন্দন কাঠ নিয়েছে। দিদির জন্য স্যান্ডেল উড সেন্ট ইত্যাদি। 
এবার ফেরার প্রস্তুতি। ওদের বিয়ের কার্ড ছাপান হয়ে গিয়েছে। আর মাত্র ৭ দিন বাকি। 

শেষ পর্ব
বিয়ের মোটে সাত দিন বাকি। ওখানে নিশ্চই সকলে ব্যাস্ত। শালু এখান থেকেই ছুটির জন্য দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। ছুটি মঞ্জুরও হয়ে গিয়েছে। তাই ওরা দুজনে সোজা কোলকাতা যাবে। অয়ন ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছে। ওরা তিন দিন আগে পৌঁচেচ্ছে। অয়নের আজ সারাদিন কোন কাজ ছিল না। আজ শনিবার এমনিতেই ওদের ছুটি। খোশ মেজাজে আছে সে। একটা নতুন গান শুনছিল এবারের পূজোর গান বোধ হয়। নতুন গানটা। ভালোই সুর হয়েছে। গানটা মন দিয়ে শুনছিল অয়ন। হঠাৎ শালুর ফোন এল ...। 
তোমার সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হলাম,
তোমার সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হলাম, 
সুরের আকাশে তোমায় যে দেখলাম, 
হেরিলে আমার মন উদাস হলাম, 
মেঘের পরশে যে শীতল হলাম।... (১)
তোমাকে না দেখে উদাস হলাম, 
তবুও বোঝে না মন কেন যে আমার, 
কেন বসে আছি ...বল এক বার, 
যেওনা তুমি গো প্রিয়া শোন একবার ... (২)
তোমা বিনা লাগে না যে ভালো আমার, 
বসে আছি পথ চেয়ে তোমার আসার, 
প্রহর গুনি সুধু তোমার আশায়, 
মন দেওয়া নেওয়া হবে সেই আশায়, 
মাতাল হব আমি তোমার ই নেশায়। ... (৩) 
তোমার সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হলাম, 
সুরের আকাশে তোমায় যে দেখলাম, 
হেরিলে আমার মন উদাস হলাম, 
মেঘের পরশে যে শীতল হলাম।... (১) 
তোমাকে না দেখে উদাস হলাম, 
তবুও বোঝে না মন কেন যে আমার, 
কেন বসে আছি ...বল এক বার, 
যেওনা তুমি গো প্রিয়া শোন একবার ... (২) 
তোমার সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ যে তাই, 
সুরের আকাশে তোমাকে দেখি যে তাই, 
আমি কত যে তোমাকে ভালোবাসি, 
আকাশের চাঁদ তারা... তারাও খুসি, 
মেঘের পরশে যে শীতল হলাম, 
এবার বলনা ... তোমার, দেখা কি পেলাম। ... (৪) 

গানটা মোবাইলে আপলোড করে সেভ করে রাখলো পরে শুনবে। 
শালুঃ কি হল গান শুনছো যে, আমার ফোন বেজেই যাচ্ছে ...! 
অয়নঃ বল তোমার কথাই ভাবছিলাম। 
টিকিট কেটেছ? 
সে আর বলতে ! তোমার বলার অপেক্ষা রাখি নাকি ! কাতা হয়ে গিয়েছে। তুমি তৈরি থেক আমি তোমায় পিক উপ করে নেব। কেমন। 
ঠিক আছে। আমার কিছু কেনা কাটার আছে সেগুল সেরে নিতে হবে ডিনারের আগে। (অয়নের সঙ্গে আজ দেখা হওয়ার কথা। রাতের ডিনার এক সঙ্গে খাবে ওরা।) 
ওকে। তুমি অন্যসব জিনিষ পত্র গুছিয়ে নিয়েছ?
সব গোছান হয়ে গিয়েছে ‘চাঁদ’। এসে দেখতে পার। 
শালুর গলায় হঠাৎ ‘চাঁদ’ কথাটা শুনে অয়নের আশ্চর্য লাগলো। পরে ভাবে ভালো মুডে আছে রাগিয়ে কাজ নেই। 
আজ ওদের দুজনের কোলকাতা ফেরার কথা। দুজনে এক সঙ্গে ফিরছে অনেক দিন পর। মনটা দুজেনেরি খুশী। বাড়ী ফিরে অনেক কাজ। 
শালুকে খুব শান্ত সুন্দর দেখাচ্ছিল। ফ্লাইটে দুজনে পাশাপাশি সিটে বসে গল্প করছিল। 
প্লেনটা, রান ওয়েতে ল্যান্ড করার আগে সিট বেল্ট পোঁরে নিল। আঃ স্বস্তির নিঃশ্বাস নীল দুজনে। ঘর ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। ওদেরই বা লাগবে কেন?

শালিনীর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। 
বাড়ী ফিরে শালু দ্যাখে বিয়ের পুরো ধুম ধাম আয়োজন। অদের আত্মীয় স্বজন সব এসে গিয়েছেন। দুই মামা মামি, মেস মাসি, এক কাকা উনি অবিবাহিত। মামাতো, মাসতুত ভাইরা সবাই এসেছে। দিদি জিজু টুকাই আছে। জিজুর মাথায় সব দায়িত্ব। ক্যাটারার যোগাড়, হলদিরামের ব্যাঙ্কে-ট হলে বিয়ের আয়োজন হয়েছে। সমস্ত কেনা কাটা... দিদি জিজু মিলে করেছে। শালুকে, মা সব দেখাচ্ছিলেন... শালুর মনটা অন্যমনস্ক দেখে বোঝেন ওর নিশ্চই বাবার কথা ভাবছে।
কিরে কি হল মা ... অমন অন্য মনস্ক কেন তুই?
কিছুনা ত ... ! কি আবার হবে? 
তবে গয়না গুল দেখছিস না কেন? ডিজাইন টা দ্যাখ !! 
(মুখ ফিরিয়ে নিয়ে) তুমিত যান আমার ও সব একদম ভালো লাগে না। এত টাকা খরচের কি ছিল? তোমার ভবিষ্যৎ, তোমার শরীর অসুস্থ হলে কে দেখবে মা? যদি ডাক্তার ওষুধের হঠাৎ প্রয়োজন হয়। তুমি ত সব শেষ করে দিয়েছ দেখছি ! টাকাগুলো এরকম ভাবে নষ্ট করলে? আমরা কে কখন কোথায় থাকি ! 
মেয়ের কথা দ্যাখ ! ওরকম বলে না। নষ্ট আবার কি রে? মেয়ের বিয়ে একবার ই হয়। আমার যা গয়না ছিল সেগুলো তোদের দুই বোন কে দিয়েছি। গড়ানোর মজুরি যা লেগেছে। ওরে তোরা সুখে থাকলেই আমার সুখ। আমার আবার কি হবে? দিব্বি থাকবো। তখন ত আর তোর চিন্তা থাকবে না ! ঠাকুরের নাম নেব আর গুরুদেবের আশ্রমে যাব। 
এত টাকা নষ্ট করেছ তোমরা। সাধারণ ভাবে কি বিয়ে হয়না? এ’ত এলাহি আয়োজন !! 
জিজু দিদি ঘরে ঢ়কে। কিরে পছন্দ হয়েছে তোর? দিদি বলে। 
তুইকি আমায় নতুন দেখছিস দিদি? আমি এসব পরি কোন দিন ! সং সেজে যাত্রা করতে যাব? সাধারণ ভাবে কি বিয়ে হয় না। 
না হয় না ... মা বলেন। কেন হবে? আমার কি নেই কিছু ! হা ঘরের মত বিয়ে দিতে হবে কেন?

গায়ে হলুদ
গায়ে হলুদের দিন বরের বাড়ী থেকে তত্ত্ব এল। সকলে হুমড়ি খেয়ে দেখছে কি এল বলে।
শালু, কি সুন্দর তত্ত্ব পাঠিয়েছে। খুব সুন্দর হয়েছে। 
শালু বলে, “তোরা খুশি ত, তাহলেই হল।” আমি ওসবের কিছু বুঝি না। 
সমাজের সব রীতি সময় নির্ভরশীল। সমস্ত রীতির মধ্যে সময়ের ছাপ পড়ে তাই নাকি গয়না ছাড়া বিয়ে হয়না। তাই বাঙ্গালীদের বিবাহ উৎসবে শাড়ী গয়না এসবের আকর্ষণ এখন ও প্রচলিত। শালিনী যত বোঝালেও এদের মগজে ওই ব্যাপারটা থাকবেই কেউ ঘোচাতে পারবেনা

আজ শালিনীর বিবাহ উৎসব
এই দিনটার জন্য শালুর মা বসেছিলেন। আজ তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। তার প্রধান দায়িত্ব সুচারু রূপে পালন করতে পারলে দক্ষিণেশ্বরে মায়ের পুজো দেবেন। মেয়ে যে বিয়েতে রাজি হয়েছে এটাই তাঁর চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য। অয়নের মতন জামাই তাদের মতন ঘর পাবেন বলে আশা করেন নি। তবে মেয়ে তাঁর ‘মা সরস্বতীর’ প্রতীক। তার সুপাত্র জুটেছে তার ই পছন্দ অনুসারে। সেটাই সব চাইতে বড় কথা। সারা পাড়া সানাইয়ের সুরে মুখরিত। 
সানাইয়ের সুর আমায় বলে
ছোট বেলাকে যাচ্ছ ফেলে, 
সুরু হবে নতুন জীবন, 
হিয়ার মাঝে থাকবে স্বজন, 
ফুল ফুটবে হৃদয় মাঝে, 
স্মৃতিটুকু থাক তার ই মাঝে।

সব আত্মীয় স্বজনরা বিয়ের আয়োজন এবং খাওয়ার প্রশংসায় পঞ্চ মুখ। বর বধূকে আশীর্বাদ করে যে যার ঘরে ফিরে গেলেন। শালিনী তার নতুন জীবন আরম্ভ করবে শ্বশুর বাড়ীতে। শ্বশুর বাড়ীতে ওর সুখ্যাতিতে সব্বাই আনন্দে আত্মহারা। মোটা মুটি বিবাহ সুসম্পন্ন হল। বর বধূ বিদায় নিল কন্যা ঘর হইতে। সকলের চোখে জল। মা দিদি টুকাই সকলের কান্না কাটি দেখে শালিনী সামলাতে পারলোনা নিজেকে। তার ও চোখে জল ! বিদায় ত একদিন নিতেই হবে এটাই হিন্দু ধর্মের নিয়ম। কনকাঞ্জলি র সময় কন্যা  পেছন থেকে এক মুঠো চাল ছুঁড়ে পিতৃ মাতৃ ঋণ শোধ করা হাস্যস্কর ব্যাপার। কি মনে করতো এই পুরন দিনের ব্রাহ্মণ সমাজ? এটা যে বাবা মাকে কত অপমান করা তা তাদের ঘটে ছিলনা !  আজ এই সমাজে তাই মহিলাদের প্রত্যেক পদক্ষেপে ঘাৎ প্রতিঘাৎ সহ্য করে চলতে হয়। শিক্ষার প্রসার ঘটেছে কিন্তু কুসংস্কার এখন মানুষের মনে আছে। মানুষ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বিচার ধারা পাল্টান প্রয়োজন।
বিবাহ বাসরঃ-
বিবাহ বাসরে অয়ন শালিনীর জুড়ী সকলের পছন্দ। অয়নের বন্ধুরা এই প্রথম শালিনীকে দ্যাখে। ওর বিষয় আগে শুনেছিল তবে চাক্ষুষ দেখেনি। খুব জাঁক যমকে ওদের বিয়ের রিসেপপ্সন এখানে হয়। বাপের বাড়ীর গয়না আবার শ্বশুর বাড়ীর গয়নার ভারে শালিনী খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। এগুলো সত্যি বাড়া বাড়ি লোক দেখান বলে মনে হয় শালুর। মুখে কিছু না বললেও পরের দিন মনে মনে ভাবে শাশুড়ি মায়ের হাতে তুলে দেবে সে সব গয়না। কি হবে তার এগুলো? মা বারে বারে বলে দিয়েছেন, ওখানে এমন কিছু না করতে যা তাদের সম্মান হানীর কারন হতে পারে। এ সব নিছক লোক দেখানি সেকেলে। এ সব সম্পূর্ণ বন্দ করা উচিৎ। যে দেশে এখন মানুষ দু মুঠো মুখে ভাত দিতে পারেনা অভাবের তাড়নায় সেখানে এগুলো তার মতে বিলাসিতা।
মনে মনে ভাবছিল ওইসময় আরও গহনার প্রেসেন্টেসন আসে।  অয়নের মাসি,পিসী,মামা মামি,কাকা সকলে যেন  কম্পিটিশন করে গয়না দিতে লাগেন। অয়ন কে তার বিরক্তির কথা জানায় চুপি চুপি।  ও বলে আজকের দিনটা চুপ থাকতে। পরে সব সমাধান হয়ে যাবে। অয়ন ওর মাকে ও বলে রেখেছে আগে থেকে।  
যাইহোক ক্রমে রাত অনেক হল। বর বধূ বাসর ঘরে গেল। সকলের হাঁসির ফোয়ারা।
অয়ন, শালুর জন্য হীরের আংটি কিনে রেখেছে বাসরে দেওয়ার জন্য  কিন্তু দেওয়ার সাহস নেই কারন ও জানে শালু খুব অসন্তুষ্ট হবে। ওটা ওর মতে টাকা নষ্ট করা।  তবুও একবার দেখানোর ইচ্ছা।
অয়ন- শালু, আমি তোমার জন্য একটা হীরের আংটি কিনেছি দেখবে।
শালু- ওই আংটি টাকি তোমার চেয়ে বেশি দামি? 
অয়ন- সত্যি বলছ !
শালু- কেন মিথ্যের কি আছে শুনি !
অয়ন- তুমি সত্যি কি ধাতে গড়া ভগবান জানেন। মেয়েরা প্রেসেন্টেসেন দিলে খুশী হয় আর তুমি?
শালু- কে খুশী হয় আমার জানার ইচ্ছে নেই তবে আমি খুশী হইনা।
অয়ন- তবে কিসে খুশী শুনি?
শালু- তোমার সান্নিধ্য। তোমার ভালোবাসা। ব্যাস আর কিছু চাই না।
অয়ন- ফ্যাল ফ্যাল করে দ্যাখে তার শালুকে। তার শালুর প্রতি গভীর শ্রধ্যা আসে। সত্যি আজকালকার মেয়েদের চেয়ে ও কত আলাদা। ওর মধ্যে লোভ নেই আছে আত্ম মর্যাদা, স্বাভিমান, সততা। অয়ন ধন্য শালুর মত স্ত্রী পেয়ে। সে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলো শালুকে। সে শালুর  ‘আবিষ্কারের নেশাকে’  মর্যাদা  দেয়  দেবে। এটাই তার প্রতিজ্ঞা।



পরিচিতি 
Previous Post Next Post