গোড়ালি এত সুন্দর! তা আবার এমন শীত দেশে। হ্যাঁ ,একদম তাই। শুধুমাত্র ওই মোলায়েম গোড়ালির জন্য ছোট্ট চা দোকানটায় এত ভীড়। ষাটের দশক। এককালের বৃটিশের পছন্দের শৈলশহর শিলং। আসলে শীত আর চা দুজনেই দারুণ প্রেমিক। নেশা নেশা ,ছোটো ছোটো বরফ কুচির মত নিজের ভেতর নিজেকে জমানোর অভ্যাস।
খাসি মেয়েদের দুচোখে কি জাদু ,তা বুঝতে হলে সেখানের ছেলেদের মত রোমান্টিক হতে হবে। পাহাড় আর পাহাড়ি মেয়ে। আঁকা বাঁকা পথে ঘুরে বেড়ানো আর ছোটো ছোটো চা এর দোকানে সেই সব রূপকথার রাজকন্যাদের সঙ্গে ছোটো টুল ,মোড়া অথবা কাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকা,সামনে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা ,খোলা জানলা ,বাইরে উঠোনে সুন্দর করে ছাঁটা লাল গোলাপের ঝাড় আর হলুদ ডালিয়া। ওরা গরীব ,কিন্তু প্রকৃতি গরীব নয়। এ ফুলে গন্ধ তেমন নেই ,তাজা ফুরফুরে পাপড়ি ই ওর চমক ।
সে সময় শিলং ছিল এক ছোট্ট শহর। রাস্তায় গাড়ির রমরমা ছিল না এখনকার মতন। আকাশ ছিল উজ্বল নীল। খাসি মেয়েদের বৈশিষ্ঠ হল তাদের পরিশ্রমী সুঠাম শরীর । অ্যালুমিনিয়ামের কেটলী গুলো দেখলে ষ্টিল বলে ভ্রম হবে। বেতের ঝুড়িতে মচমচে বেকারী বিস্কুট। কয়লার উনুন। জল ফুটছে। আগুনের লাল আভায় মোহময় হয়ে উঠেছে মেয়েটির মুখ। কাপে চা ঢালছে আর আড় চোখে দেখছে ছেলেটিকে। প্রেমিক ,স্ফূর্তিবাজ দিলদার সেই ছেলে। হালকা গোলাপী মিউজিক। ফিঁয়াসী সরলকাঠের সরলতা। চারপাশ নাচ হয়ে ওঠে। মনে হয় আগুনের শেষের কবিতা। বাইরে জানলায় কনকনে হাওয়া মাথা খোঁড়ে। মেয়েটির নাকের ডগা লাল। এত শীত তবু ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গাল দুটো দুর্ধর্ষ লাল। তারপর লেখা হবে ভেসে যাওয়ার গপ্প। সে এক অন্য ইতিহাস।
খালি পা, মাথায় ঝুড়ি ভর্তি কাঠ, সিঁড়ির ওপর থেকে শুনতাম খাডিয়াং খাডিয়াং। দৌড়ে নেমে আসতাম, আমার প্রিয় কং , ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বলত “মা পুছো ,দিদি”... অর্থাৎ মা কে জিজ্ঞেস কর কাঠ চাই কিনা। সারা দিন পর ওরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে, গায়ে শীত বস্ত্র বলতে শুধু একটা চাদর,খালি পা... কিন্তু অদ্ভুত পরিষ্কার আর মুখে টলটলে হাসি। জানতে ইচ্ছে করে, আজও কি ওরা সেরকমই গরীব... আর সরল !আজ সেই আসাম প্যাটার্ন বাড়ি আর দেখা যায় না বড়। চারদিকে বিল্ডিং ,দোকান ,শপিং মল। সরল গাছ যেন সরে গেছে বহু দূর... হারিয়ে গেছে সরলতার হাসি।
কিন্তু দুঃখের কথা আজ নয়, আজ খোশমেজাজ। চলুন ঘুরে ঘুরে দেখি, গলির মোড়ে ছোট্ট চা দাদা থেকে শুরু হই তারপর গড়াই।আড্ডা ছাড়া জীবন বৃথা। সঙ্গে দেশ বিদেশ। রাজা উজির, সরকারের তুলোধোনা,একটু আধটু পি এন পি সি, আহা না হলে বদ হজম হবে যে। যাই বলুন ,বেশ লাগে। কাঠের বেঞ্চিতে বসে সামনে ধোঁয়া ওঠা নির্ভেজাল চা।
তবে যেখান থেকে শুরু হলাম ,সেখানে মাটির ভাঁড় নেই ,সেটা আফশোষ। যতই সুসাস্থ্য আর পরিচ্ছন্নতার পাঁচালি পাড়ুন মশাই ভাঁড় হল সেই বাবাজী যে কিনা ভবানির পরম ঐশ্বর্যের সব খুঁটিনাটির খুঁটি বললে ভুল হবে না একটুও। তবে পাহাড়ি দেশের লোকে তাকে চেনে না। আমারো পরিচয় সেই ভাঁড়ের চা এর সাথে অনেক পরে । সমতলে নেবে। প্রথম যেদিন সোজা রাস্তা দেখলাম ,পাহাড় যেন হঠাৎ থেমে টা টা করল, কষ্ট হল মনে, আর অবাক হয়ে দেখলাম...পথ চলছে তো চলছেই ... মামাবাড়ি কোলকাতা যেতাম শীতের ছুটি প্রতি বছর। আর দেখতাম সেই চলমান দোকান,গৌহাটি রেল ষ্টেশনে ...চা দাদা...চায়ে গরম চায়... মনে হত বড় হয়ে চা ওয়ালা হলে কি মজাই না হবে... এখনও কি আমি সে রকমই ভাবি? নিজেকে আসলে কতটুকুই বা জানি?
তারপর বহুবছর গড়িয়ে গেছে। শিলং আজ স্মৃতির শহর। চলে এসেছি উত্তরবঙ্গ সেও প্রায় বছর পনেরো। কিন্তু চায়ের নেশা সঙ্গ ছাড়ে নি । ঘুরে বেড়িয়েছি এখানের পথে ঘাটে ,টুক করে ঢুকে পড়েছি বাঁশের খুটি বাঁধা পথের ধারে চা দিদি অথবা দাদার সংসারে। জমে উঠেছে গপ্প। কত মানুষ...গরীব কৃষক থেকে শুরু করে রিক্সাভাই, সব্জী বিক্রেতা পাঠক ,কবি নাট্যকার । এ যেন এক আজব রঙ্গমঞ্চ। লেবু চা ,দুধ চা, আদা চা ,পুদিনা চা... কি চাই, চোখ দেখে চাহিদা টের পেয়ে যায় এই সব দাদা দিদিরা । কেমন এক আত্মীয়তা গড়ে ওঠে অলিখিত ।
বিশুকে মনে পড়ে? ওই যে গলির মোড়ে নিপুর দোকানের বিশু। আমার দোস্ত। সারাদিন কাপডিশ ধুচ্ছে ,চা ঢালছে। টেবিল পরিষ্কার করতে করতে চোখ তুলে বলে ,বাবু আর এক কাপ আনব? চেনেন বই কি ,আলবাত চেনেন।রোগা ,লম্বা , মাথা ভর্তি রুক্ষু এলোমেলো চুল। শুধুমাত্র চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে অজানা তারার মত। তা সেই বিশুই একদিন বলল , জানেন বাবু, রোজ সকালে দাস কাকু, বোসকাকু আর মিত্র কাকু খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কত কি গপ্প করে। আমি সব শুনি। সেদিন শুনলুম শিশু শ্রমিক না কি সব বলছে। বলছে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দিয়ে এ সব কাজ করানো আইন করে বন্ধ করা হোক । ।আপনাকে বলি চুপিচুপি এ সব আইন আমি চাই না। শুনে আমি তো থ। বলে কি ছেলে, সে কিন্তু থামে না ,বলেই চলে ,এই আইন হলে বাবু ,সন্ধ্যে বেলা ঘরে ফিরে মার হাতে কি দেব? সেদিনই বুঝেছিলাম এই শিক্ষা সভ্যতা কালচার কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এই সব বিশুরা কিন্তু খসে যাচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে অজানা গ্রহের ভেতর।
তবে সুখের কথা এই চুপিচুপি ব্যাপারটা আমার সাধের দেশে খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। যাইহোক চা এর দেশ উত্তরবঙ্গ, সে গপ্প শেষ হবার নয়, এবার পা বাড়াই গুড়ুং বস্তির হরিচরণের জয় মা টি স্টলের দিকে। আমরা চার বন্ধু ওর রেগুলার কাষ্টমার। এক গ্লাস (বড়) চা,ভাগ করে প্রতি ঘন্টায় অন্তত চারবার। এখানে হরি হল নিজেই চা নিজেই চিনি,চামচ সবকিছু ,তবে ঘাঁটানোটা দারুণ আর সেইজন্যেই তো এত ভীড়। সেদিন বলল ,দাদা আমার বড় ছেলে দশ ক্লাস পাশ দিল , বেশ পাশ করসে ,ওর একটা ভাল কাজের বন্দোবস্ত কইরা দেন যদি , জিজ্ঞেস করলাম কি কাজ ? সে বাবু আপনে বড় মানুষ ,আপনেই বুঝবেন, আমি মুখ্যু সুখ্যু লোক অনেক কষ্টে পড়াইসি ,ছেলেটা দাঁড়াক আর বেশী কিছু চাই না বাবু...
পারি নি ,কাজ হয় নি হরির ছেলের। আমরা আসলে কত কম পারি। ওরই দোকানে বসে রাজা উজির মেরেছি কাপের পর কাপ চা খেয়েছি ,সিগারেট টেনেছি। কার উদ্ধার হয়েছে জানি না। তবে হরির হয় নি। কিছুদিন পর দেখি ছেলেটা বাইক চালাচ্ছে, বাপের পয়সায় নয়। কি নাকি বড় ব্যাবসায় নেমেছে, হরি বুড়ো হয়েছে, বুড়ি বহুদিন গত। দোকান এখনও হরিই চালায়। ছেলেটা রাতে বাড়ি ফিরে বাপকে গালিগালাজ করে। মুখে দুর্গন্ধ।
না,সব গল্পই এত দুঃখময় নয়। আশা আছে , আশার বর আছে, প্রেমিকও আছে। আশার দোকান ইউনিভার্সিটির দু নম্বর গেটের ঠিক পাশটায়। সাজপোষাক করলে বেশ লাগে দেখতে। বড়টা রুগ্ন ,আশাই খাওয়ায়, সেবা করে দোকান চালায় আবার ছোকরা প্রেমিকের সাথে সিনেমা যায়।দোকানের নোংরা দেয়ালের গায়ে দিব্যি হাসিমুখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শাহরুখ সলমন। ক্যটরিনার লিপ্সটিক ঠোঁটে গাঢ় করে চুন ঘষে গেছে কোনো পাগল প্রেমিক ,গান ভেসে আসছে হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ লাভ লাভ।
আশা আছে তাই সংসার আছে ,প্রেম আছে ,দোকান চা চিনি গরম সিঙ্গারা সবই আছে। যা নেই তা হল একটা নেই নেই ভাব। যা আমাদের মত মধ্যবিত্তের অগাধ বিপুল ঝুলি ভর্তি আছে।
Tags:
আত্মকথা