সকাল হয়ে আসছে। কাচের জানলা দিয়ে ভোরের আলো ব্যালকনিতে গাছগুলোকে ছুঁয়ে গেল। অর্ক চায়ের কাপ হাতে দাঁড়ালো তার শখের ব্যালকনি-বাগানে। সকালটা তার বড় নিজস্ব - বড় একান্তের। এই ফুল, গাছেদের ঘিরে অর্কর নতুন জগত ।
বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের একটি প্রফেসরস কোয়ার্টার তার আপাতত ঠিকানা। দু-বছর আগে সে জয়েন করেছে জুলজি ডিপার্টমেন্টে। অর্কর কাছে পড়ানোটা একটা নেশা। পড়াশুনায় বুঁদ হয়ে থাকতে তার জুড়ি নেই। তার পড়ানোর স্টাইল, বুদ্ধিমত্তায় মোড়া রসিকতা আর ছাত্রদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠায় বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টএ তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
এই তো সেদিন জুলজি ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর শান্তনুর খুব জ্বর শুনে তার বাড়ি গিয়ে হাজির অর্ক । শান্তনু কিছুতেই গায়ে কোন চাদর দেবে না। এই এক বদ-অভ্যেস। কারো কথা শুনবে না, এই করে ঠাণ্ডা লাগিয়েছে। অর্ক হৈ হৈ করতে করতে শান্তনুর বাড়ি ঢুকল। শান্তনু কে বিছানায় শোয়া দেখেই চিৎকার ...শান্তনু বাংলাদেশের রাজধানী গায়ে দাও।
- মানে ? শান্তনুর চোখে জিগ্যাসু দৃষ্টি ।
- মানে ঢাকা ।
ঘর শুদ্ধ লোকের এবার অট্টহাসি। হাসতে হাসতে শান্তনু বাধ্য ছেলের মতো কম্বল গায়ে দিল তৎক্ষণাৎ।
গত সপ্তাহে ক্লাস নিয়ে সবে বেরিয়েছে, তখন বোধহয় সোয়া তিনটে হবে, অর্কর চোখে পড়ল ক্যাম্পাসের যেদিকে ফুলের বাগান সেখানে বোগেনভিলিয়ার ঝাড় একেবারে শুকিয়ে গেছে । কিছু টবের ডালিয়া শুকনো মুখে তাকিয়ে। জল দেওয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল হাবিবের বিবির খুব শরীর খারাপ । তাই মালীর কাজ দুদিন বন্ধ রেখে ইউনিভার্সিটি থেকে একটু দূরে সুসুহাই গ্রামে তার বাড়ি গেছে। অর্ক নিজেই নেমে পড়ল মালীর কাজে। হাত নেড়ে ডাকল দু-তিন জন ছাত্র কে।
- আরে সন্দীপ , শিবম, তনভির এদিকে আয়।
- কেন স্যার, কি হয়েছে? আপনি মাঠে কি করছেন?
- জীবন বাঁচাচ্ছি রে । সেই যে জগদীশচন্দ্র ছোটবেলা থেকে কানে মন্ত্র পড়ে দিয়েছেন ...। তাকিয়ে দ্যাখ, দুদিন জল না পেয়ে কি অবস্থা গাছগুলোর ! নে নে জলের পাইপটা এদিকে নিয়ে আয়। সমস্ত গাছগুলোতেই জল দিয়ে যাই।
ক্যাম্পাসে পথচলতি ছাত্রছাত্রী তাকিয়ে দেখছে তাদের প্রিয় স্যার আজ মালী । সন্ধ্যে নামছে । বাড়ির পথে অর্ক। বাড়ি বলতে সে আর তার বইপত্তর । তাড়াতাড়ি পা চালাল। আজ বীণাদি রান্নাটা একটু আগে করতে আসবে বলেছিল । সামনে একটা মনজিনিস এর দোকান। একটু দুষ্টু বুদ্ধি এল মাথায় । একটা কেক কিনে নিল দ্রুত । চাবি খুলে ব্যাগ রাখতে রাখতে বীণাদি হাজির ।
- দাদা, আজ কেউ আসবে ?
- কেন বীণা দি ?
- না, বলছিলাম অতোবড় কেকের বাক্স!!
- শোন বীণাদি ওই কেক টাকে টেবিল এর ওপর রাখো। আর রান্নাঘর থেকে কোথায় মোমবাতি আছে নিয়ে এসো। ... দেশলাই না থাক, আমার পকেটেই আছে ।
- কি হবে দাদা ? তোমার জন্মদিন ? একগাল হেসে বীণাদি জিগ্যেস করল ।
- না ... তোমার।
- আমার! কি যে বল । ভুলেই গেছি কবে আমার জন্মদিন ।
- তাই তো মনে করাচ্ছি । ধরো আজ তোমার জন্মদিন । আজই । এরপর থেকে এই দিনেই তোমার জন্মদিন হবে।
- না-আ-আ-ও ছুরি ধরো । হ্যাপি বার্থ ডে টু বীণাদি ।
বীণা দির চোখে জল ।
- এতো বড় কেক কি হবে গো দাদা ?
- কেন আমি খাব, দুজন পড়তে আসবে একটু পরে তারা খাবে । আর বাকিটা যাবে তোমার বাড়িতে সবার জন্য ।
অনেক রাত হল। আর একটা নোট্স তৈরি করে তারপর ঘুমতে যাবে ভাবলো অর্ক। কি ভেবে একবার বেরিয়ে এল কোয়ার্টাস এর সামনের রাস্তায় । মাথার ওপর খোলা আকাশ, অজস্র হিরেকুচির মত নক্ষত্রেরা নভোমণ্ডল জুড়ে । দূরে ধোঁয়ার মত যেন উঠে আস্তে লাগলো স্মৃতির ভগ্নাবশেষ।
... অর্ক ... অর্ক অতো জোরে বাইক চালিয়ো না। আমার ভীষণ ভয় করে ।
- মালিনী , সামনের মাসে আমাদের বিয়ে । এখন আমি উড়বো।
- না, অর্ক, এতো জোরে না প্লিজ । সামনে দ্যাখো । কেন অমন করছো ?
- ধুস, ওসব ট্রাক, লরি ... এ শর্মা কেয়ার করে না । দ্যাখোই না কেমন ওভার টেক করে ঠিকঠাক তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো, নিশ্চিন্ত থাকো।
-যাক বাবা অ্যাট লাস্ট বাড়ি । উফফ... অর্ক............
- কাল ফোন ধরনি কে্ন মালিনি?
- জ্বর ছিল যে ... কদিন ধরেই হচ্ছে। কাল খুব বেশি ছিল। আজ ব্লাড টেস্ট হয়েছে। কাল রিপোর্ট দেবে।
- হুম ওকে, রেস্ট নাও। পরে কথা হবে ।
- হ্যালো হ্যালো , অর্ক... আমি নবারুন বলছি । মালিনী কে নার্সিংহোম এ ভর্তি করতে হল । যাবার আগে বলল " দাদা অর্ক কে খবর দে "। তুমি এসো অর্ক ।
নার্সিং হোমের বিছানায় মালিনী শুয়ে । ফুল যেন শুকিয়ে গিয়েছে । রিপোর্ট এসেছে । ম্যালিগন্যান্ট ম্যালারিয়া ।
- মালিনী তুমি খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠবে । আবার আমরা বাইক নিয়ে সাঁ সাঁ করে শহর ছেড়ে অনেক দূরে ...
- আমার ঘুম পাচ্ছে অর্ক ।
যে শহরে যুদ্ধ করতে করতে মানুষ বেঁচে ওঠে, ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হয়েও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঁচে থাকে মানুষেরা -- সে শহর কলকাতার নামী নার্সিং হোমে প্রবল জ্বরে তিনদিন এর মাথায় চলে গেল মালিনী নামের এক উজ্জ্বল মানবী । যে শহরে মালিনী নেই-- সেখানে কি থাকা যায় ? অতএব ডিঙা ভাসাও --- কত শহর-- জনপদ পরিযায়ী রূপে ঘুরে বেরিয়েছে অর্ক - এই চাকরী ছেড়ে ওই চাকরী --শেষ দু-বছর এখানেই পড়ে আছে-- একমনে বা আনমনে-- । কোথাও যেন একটা রাতজাগা পাখি ডেকে উঠলো। শিষের তীক্ষ্ণতা ফালাফালা করে দিল ঘন অন্ধকার । অর্কর বুকের ভেতর টা যেন হু হু করে উঠলো তীব্র বেদনাবোধে ।
সকাল অনেকক্ষণ হয়ে গেছে । বীণাদি দুবার এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে । আবার কি মনে হতে ফিরে এল । পাশের কোয়ার্টার এর লোকজন দের ডেকে এনে দরজা ধাক্কা দিল । দরজায় আঘাত করতে করতে যখন তারা ভাঙতে বাধ্য হল... সবাই দেখল খাটের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে অর্ক-- নিথর, নিস্পন্দ । আর যেন তরলতা নয় গাম্ভীর্যে ভরপুর । ডাক্তার দেখে বললেন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক ।বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে। পাশে রাখা জসিমুদ্দিনের নকশি কাঁথার মাঠ। এক বিদেশীর মতো এখানে এসেছিল অর্ক -- আবার চলেও গেল শীতের রোদ্দুর মেখে --ফুলে ফুলে ভরা শরীর নিয়ে, সবার আদর কুড়িয়ে চলল - হয়ত আবার অন্য কোন দেশে, অন্য মনে-- হয়ত বা জন্ম নেবে অন্য কোন শরীরে-- পরিযায়ী ছাড়া আর কিছু তো নয় ।
Tags:
গল্প