জয়দীপ চক্রবর্তী

joydip

এই সভ্যতা, শান্তি, মানবতার, বিপক্ষে বর্বরোচিত, হিংসাশ্রয়ী, প্রাণঘাতী আক্রমণের সূচনা ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৪ এর রাতে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর টিএসসিতে ঘৃণ্য আক্রমণের মধ্য দিয়ে। মৌলবাদীদের ধর্মান্ধ পেশিশক্তির আগ্রাসনের শিকার হয়েছিলেন বিখ্যাত ও সংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া লেখকের সত্যবিচারে। তারপর আর কখনও স্তব্ধ হয়নি এই হত্যার যজ্ঞের চাকা। ‘চাপাতি সংস্কৃতি’র দোর্দন্ডপ্রতাপে ক্রমান্বিত হয়েছে রক্তক্ষরণের বেবাক অন্ধকারে মৃত্যুর মিছিলে পদদলিত হয়েছে মুক্তমনাদের মৌলিক চাহিদা থেকে সামান্যতম বাকস্বাধীনতা। ২০১৩ সালে এসে এই ধ্বংসস্তূপ বিস্তারে আরো গতি পায়।  মৌলবাদী শক্তির শোনদৃষ্টিতে পড়েন ভারচুয়াল জগতে লেখালেখি করা মুক্তচিন্তার ‘ধারক’রা, ‘ব্লগার’রা। এরপর থেকে ব্যাপারটি ক্রমান্বয়ে এতোটাই দ্রুততর শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের কোণায় কোণায় , যার ফলে প্রতি মাসে এইসময় নিত্যনতুন  ব্লগার বা লেখকের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হচ্ছে আর আমরাও যথারীতি সকালের কাগজে কিংবা ইলেকট্রিক চ্যানেলে পড়ে ও দেখে দু-একদিন চেষ্টা করি মনে রাখার, চায়ের দোকানে আলোচনা করি, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে গভীর চিন্তায় আহা-উহু করি, তারপর কখন ভুলে যায় আমরা নিজেরাই হয়তোবা জানি না।

আজ এখন এই লেখাটি লিখতে বসেছি যা গভীরতর বিষাদের এবং বিপন্নতার। জলজ্যান্ত অসহনীয় রক্তক্ষরণ দেখে মনের দাউদাউ অনুভূতির কান্না এই লেখা।  গত ৩১ অক্টোবর একইদিনে আলাদা দুটি প্রাণঘাতী হামলায় একজন প্রকাশককে হত্যা এবং আরেক প্রকাশকসহ দুই কবি ও ব্লগারকে গুরুতর আহত করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়াইয়ে তালিকায় নতুন সংযোজন করেছে মৌলবাদীরা। এই পর্যন্ত এই ঘটনা জুড়ে দিলে ব্লগার ও মুক্তমনা লেখকদের মৃতের মিছিল দশজন ছাড়িয়েছে।

বেলা 2.30 দিকে লালমাটিয়ায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে সর্বপ্রথম হিংসাশ্রয়ী আক্রমণ চালানো হয় ।  সেখানে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল-সহ দুই কবি ও ব্লগারকে চাপাতির দ্বারা গুরুতরভাবে আহত করা হয়। আহত তিনজনকে হাসপাতালে নিয়ে যখন চিকিৎসা চলছিল, তখন জানা যায় শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটে আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ের ভেতরে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রাণহীন পড়ে আছেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন । প্রতিটি ক্ষেত্রেই হামলার পর কার্যালয়ের দরজায় তালা আটকে দিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক'কে হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ আরও তিনজন'কে কুপিয়ে জখমের পরদিন হত্যার হুমকি তাঁকেও দেওয়া হয়েছে জানিয়েছেন সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী প্রকাশক ফরিদ আহমেদ।

রোববার [১ নভেম্বর] আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে তাঁর মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে এই হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। উল্লিখযোগ্য যে নিহত ও আহতরা প্রত্যেকেই জঙ্গিদের হামলায় নিহত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশনার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাই এদেরকেই টার্গেট করা হচ্ছে, হয়েছে এবং হবেও বলা যেতে পারে। কেননা এই সম্ভাবনার কথা বলছেন স্বয়ং গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাই।

সেইসঙ্গে এইরকম ধারণার কারনেই একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠে আসছে নিশ্চিতভাবেই সবার মাঝে। তাহলে এই কারণেই কি আগত বইমেলায় মুক্তচিন্তার বই প্রকাশ বন্ধ করাতেই এই হামলা? বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এর উত্তর, হ্যাঁ।

ব্লগার হত্যাযজ্ঞের মাঝে আকস্মিক করে দুজন প্রকাশকের উপর হামলা, তাও আবার তাঁদের যাঁরা মুক্তচিন্তার বই ছাপেন। এখানে দুই হিসাব মিলিয়েই পাওয়া যাচ্ছে অভিনব এবং নতুন এই মৌলবাদী তৎপরতা। বইমেলার মাত্র চার মাস আগের এই হামলায় স্বভাবতই অনেক মুক্তচিন্তার লেখক-প্রকাশক হতচকিত হয়ে পড়েছেন । অনেক লেখকরা এখন থেকেই বই প্রকাশের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন । তাই এই সময়টিকে টার্গেট করেছে জঙ্গিরা এমনই মনে করছেন অনেকে। তারা প্রকাশকদের ওপর হামলার মাধ্যমে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে তা হলো- বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও মুক্তমনাদের বই প্রকাশ করা মৃত্যু মিছিলে নিজের নাম ইচ্ছাকৃত ভাবে সংযোজন একই বিষয়। তবুও যদি সাহসিক এ ধরণের বই প্রকাশ করে তাহলে তাঁর কী পরিণাম হবে তার সম্ভাব্য দৃশ্যপট কি হবে সেটা প্রকাশ করাতেই এই হামলার। ফলে মুক্তচিন্তার বইপত্র প্রকাশ আতঙ্কে ভয়ে কমে আসবে বলে অনুমান করছেন অনেক বিজ্ঞজনেরাই। কেউ ব্লগার, শুনলে তার বই আর প্রকাশ করতে চাইবে না কোনো প্রকাশক। ফলে মুক্তচিন্তা সম্পর্কিত লেখালেখি পাঠকদের হাতে তুলনামূলক কম পৌঁছুবে । এভাবেই মৌলবাদীরা নতুন পদ্ধতিতে মুক্তচিন্তার পথে মধ্যযুগীয় অন্ধকার বিছাতে সক্রিয় এবং যা প্রমাণিত।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে এই অতীব স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বোধকরি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তাদের কতটা, কীভাবে, এই পরিস্থিতিতে কি করনীয়!!! যেটা নিশ্চিতভাবেই ভীষন উদ্বেগের দাবী রাখে। রোববার রাত পর্যন্ত রাষ্ট্র শক্তির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই হত্যাকান্ড ও হত্যাচেষ্টার বিরুদ্ধে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়নি, তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মাহবুব-উল-আলম-হানিফ বলেছেন, ‘জামায়াত-শিবির ও বিএনপির খণ্ডিত অংশ জড়িত।’ আরো যা বলেছেন, ‘কেউ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কেউ জেএমবি, কেউ হরকাতুল জিহাদ, কেউ হুজি—বিভিন্ন নাম দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করছে।’  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও এটিকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ দাবি করে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি হয়নি বলে আশ্চর্যজনক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অতীতের এইরকম নৃশংস, বর্বরোচিত ঘটনার পরেও সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে এবারের বক্তব্যেও মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই । ইতিমধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদা বা একিউআইএসের ‘বাংলাদেশ শাখা’ বলে দাবিদার আনসার আল ইসলাম এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে।তবে এটা ঘটনা যে সংগঠনের অস্তিত্ব ও তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের যোগাযোগ বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত।কিন্তু বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি রয়েছে বলে বলা হয়, তাদের অন্যতম হচ্ছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ ।  সম্প্রতি আওয়ামী-ওলামা লীগ বলে দাবিদার সংগঠনের এক পক্ষ সাংবাদিক সম্মেলনে বিরুদ্ধ পক্ষের বিরুদ্ধে এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে একাত্মতার যে অভিযোগ করেছিল, তা কি খতিয়ে দেখা হয়েছে?নয় নি তা বলাই বাহুল্য বিভিন্ন সূত্রের পাওয়া খবর অনুযায়। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন যেখানে সামগ্রিক ভাবে জড়িত, যেখানে লাগাতার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কর্মী বলে পরিচিত ব্যক্তিরা অস্ত্র ও বোমা-সহ আটক হচ্ছেন, সেখানে এই ধরনের অভিযোগকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ থাকে কি? কিন্তু এই বিষয়ে সরকার তাগিদ তত্পরতা অনুভব করছে বলে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যে বিশ্বাসী উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করছেন।

নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ছেলে খুন হওয়ার পর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ছেলে হত্যার বিচার তিনি চান না। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে ‘রাজনীতি’ করছেন তাদের শুভবুদ্ধি উদয়ের প্রত্যাশাই করছেন তিনি। কেবল আইন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না, এটি সমাধান করতে হলে রাজনৈতিক আন্তরিক উদ্যোগের প্রয়োজনই সর্বাপেক্ষা বেশি, তিনি বলেছেন । বিগত সবগুলো হত্যামামলা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা, তদন্তের লেজেগোবরে অবস্থায় তার এই বক্তব্যের হতাশা স্পষ্টভাবে সবাইকে বর্তমান নিয়ে ভাবিয়ে তুলছে। নিখুঁত রক্তপ্রবাহের নীল নকসায় মৃত্যুর চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ছে একেকটি প্রাণ, কিন্তু এর কোন প্রতিকার হচ্ছে না। মৃতদের মিছিল শুধু বাড়ছেই না, প্রবল পরাক্রমে নতুন তালিকা বাজারে আসছে। দূরের অন্ধকার ধূসরে ঢাকা পড়ে  যাচ্ছে বাংলাদেশ, স্বপ্নের ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলা’ থেকে......


Previous Post Next Post