দেবশ্রী চক্রবর্তী

debasree





মানুষ বড় সস্তা । সস্তাই বটে! না হলে ভারতে ভ্রমণে এসে ১৫ দিনের জন্য এক নাবালিকার দাবি জানাতে পারেন ওমানের ৭২ বছর বয়সী এক শেখ? টাকা থাকলে যে সব পাওয়া যায় তা দেখালেন দুই 'দালাল'। শেখের পছন্দ মতো সপ্তদশী মেয়েকে এনে হাজির করলেন তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। এখন শ্রীঘরে রয়েছেন শৌখিন শেখ।

ঘটনাটি ঘটেছে হায়দ্রাবাদে। পুলিশ জানিয়েছে, হায়দ্রাবাদে মাস খানেকের জন্য ঘুরতে এসেছিলেন ওমানের শেখ আল সানাইদি খামিস মহম্মদ খামিস। বয়স ৭২। তাতে কী! এসেই একটি নাবালিকা বধূর খোঁজ শুরু করেন তিনি। কাজের জন্য নুরজাহান এবং শফিক মহম্মদ নামে দুই দালালকেও পাকড়াও করেন তিনি। এরাই ১৭ বছরের নাবালিকাকে এনে হাজির করে শেখের সামনে। শেখও মেয়েটির মায়ের হাতে ২১ লক্ষ টাকা তুলে দেন এবং চুক্তি হয় ১৫ দিনের জন্য মেয়েটিকে বিয়ে করবেন তিনি। সঙ্গে ডিভোর্স পেপারও সই করিয়ে নেওয়া হয়।

স্থানীয় এক কাজিকে ধরে এনে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে একটি বাড়িতে নব-বিবাহিতদের নিয়ে যাওয়ায় হয়। বিয়েতে মেয়েটির মত ছিল না। সে পালানোর ফন্দি আঁটতে থাকে। অতি কষ্টে বছর দশেকের একটি ছেলেকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে পুলিশের কাছে খবর পাঠায়। পুলিশ এসে মহম্মদ খামিস-সহ দুই দালালকেও গ্রেপ্তার করে। কাজি আপাতত বেপাত্তা।

গত কয়েক বছর ধরে হায়দ্রাবাদে মুতা বিবাহের কয়েকটি ঘটনা জন সম্মুখে চলে আসার জন্য আমরা এই বিশেষ বিবাহটির সম্পর্কে জানতে পেরেছি, না হলে সেই বহমনি সাম্রাজ্যের যুগ থেকে মুতা বিবাহ হায়দ্রাবাদে চলে আসছে । আগে মেয়েরা প্রতিবাদ করতে পারত না, কিন্তু এখন মেয়েরা প্রতিবাদ করছে । এই সমস্যাটা নিয়ে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী দল আন্দোলনও চালাচ্ছেন ।

এবার আমরা দেখব যে মুতা বিবাহ আসলে কি ।

ইসলামের গরিষ্ঠ অংশ সুন্নিদের মধ্যে মুতা বিবাহ চালু না থাকলেও শিয়াদের মধ্যে এই বিবাহ প্রথা এখনও মান্যতা পায়। মুতা বিবাহ এক অস্থায়ী চুক্তি। তা এক বিশেষ সময়ের জন্য।  তা একদিনের জন্যও হতে পারে এ বিবাহ বা যৌনচূক্তি । এ বিয়ের চুক্তি শুধু বিশেষ সময়ের জন্য নারীকে ভোগ করার অধিকার। শুধু তাকে এক বৈধ ধর্মীয় লেবেল পরানো। না হলে এই চুক্তির সঙ্গে পতিতা গমনের কোন পার্থক্য নেই। আজকের সভ্য ভাষায় যাদের আমরা যৌন কর্মী বলি,মুতা বিয়ের স্ত্রীকে নামে সেই নারী যৌন কর্মীর বেশী মর্যাদা দেওয়া যায় না । 

মুতা বিবাহের নামে যা চলে তা হল ধর্ষণ । টাকার বিনিময়ে নারী শরীরকে যেমন খুশি ব্যবহার কর । আমার পরিচিত এক মুসলিম ভদ্রলোক হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। তার মুখে শুনেছি, চারমিনার এর আশেপাশে যেসব মুসলমান পরিবার থাকেন তাঁদের কাছে কন্যা সন্তানের জন্ম খুব আনন্দের।  কারুর মেয়ে হলে সেই খবর দালালের মাধ্যমে আরবদেশে চলে যায়। তার পর মেয়েটির যখন ১২ বছর বয়স হয় তখন থেকে মেয়েটিকে টাকার বদলে বিয়ে দেওয়া হতে থাকে। যত দিন বারে মেয়েটির দামও কমতে থাকে। শেষে মেয়েটির যখন ৩০ বছর বয়স হয়, তখন আর সেই মেয়েকে কেউ নেয় না । তখন তাদের জন্য অন্য দালাল ঠিক করা হয় । তাঁদের কাজ গ্রাহক ধরে আনা, তখন মেয়েটিকে ঘরে বসে দেহ ব্যবসা করতে হয় ।

মুতা বিবাহ সম্পর্কে যখন জানতে পারলাম, তখন একটা কবিতা লিখে ফেললাম 


জন্মেছে কন্যা...
বাহবা বাহবা.....
তাড়াতাড়ি সারতে হবে চুক্তি,
আরব দেশে অপেক্ষা করছে
সব মালদার শেখ বাবাজী ।

কন্যার কপালে পড়ল শিলমোহর
তার অজান্তেই শৈশবে
বিক্রি হয়ে গেল তার যৌবন ।
কন্যা, তুমি রাজি.....?

রাজি রাজি রাজি,
শুরু হল বরবাদি ।
এক মাস, ছয় মাস
কখনও বা একটি মাত্র রাত্রি...
আম্মিজান এতো বরবাদি ...!

বেটি তোমার আব্বুর 
পকেটের বাড়ছে ওজন,
তোমাকে শেখের বিছানা
যে করতেই হবে গরম ।

বছরের পর বছর
ডাস্টবিনে জমতে
থাকে টিসু পেপার,
তিরিশ ঊর্ধ্ব কন্যাটিকে 
সংসারে রাখাই এখন বেকার ।

ছোট্ট পাখীর ছানাকে খাবে বলে যেমন বিড়াল নানা ছলনার আশ্রয় নেয়, তেমনি নারীর শরীর কে ছিরে খাওয়ার জন্য ধর্ষকরা নানা পথ বার করে রেখেছে।  মুতা বিবাহ হল ধর্ষণের একটি বৈধ পথ।  ভাবলেই কিরকম যেন লাগে, যে ধর্মে নারীদের আপাদমস্তক কালো পর্দার আড়ালে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেই ধর্মে কালো পর্দার পিছনে চলছে নারীর রক্ত,মাংস নিয়ে কারবার ।  ভাবা যায় একটা ছোট্টো শিশুর বোধ বুদ্ধির বিকাশ হবার আগেই তাকে তাঁর বাবার বয়সী কিংবা দাদুর বয়সী কারোর যৌন লালসা মেটাবার উপাদান হিসাবে দেখা হয় এবং সেই হিসাবে তাকে তৈরি করা হয় ।

এই মুতা বিয়ে এখনো মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে ঠিকই কিন্তু এজন্য সরাসরি ইসলাম দায়ী নয়।  ইসলাম ধর্মে - কবর / মাজার পুজা হারাম, সুদ হারাম, বিবাহ বহির্ভুত নর নারী সম্পর্ক হারাম, মদ হারাম।  সেই সাথে ধর্মের বিধিনিষেধে মুতা বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ হবার পরেও মুসলিম ধর্ম অবলম্বনকারী অনেক মানুষ এই সবে যুক্ত থাকছেন। এজন্য যতটা সেই মানুষগুলো দায়ী, ইসলাম ধর্ম তার এক অংশেও নয়।  অনেক মুসলমান সম্প্রদায় মানুষ এটাকে পালন করছে শুধুই মোচ্ছবে। ঠিক এজন্যও ইসলামকে দায়ী না করে ওই মানুষগুলোকে দায়ী করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্যকার ও সাহিত্যিক লিটন আব্বাস ভাই এর সাথে আলাপচারিতায় জানা হল  ইসলাম ধর্মে মুতা বিবাহ সত্যকারেই নিষিদ্ধ ।  হাদিসে প্রায় ২০-২৫ বার অস্থায়ী বিয়ে নিষেধের কথা এসেছে। এক কথা বার বার এসেছে।  লিটন ভাইয়ের কাছে পাওয়া তথ্য গুলি এই রূপ -

১। আলী আবু তালিব থেকে বর্নীত – খাইবরের যুদ্ধের দিন আল্লাহর রাসুল মুতা বিয়ে ও গাধার মাংশ খাওয়া নিষেধ করেন Bukhari, Volume 5, Book 59, Number 527:

২। আলী আবু তালিব বলেছেন – খাইবর এর দিন আল্লাহর রাসুল অস্থায়ী বিয়ে ও গৃহ পালিত গাধার মাংশ খাওয়া হারাম করেন। Muslim, Book 21, Number 4763:

৩। সাবুরা ইবনে মাবাদ থেকে বর্নীত – আল্লাহর রাসুল মহিলাদের সাথে অস্থায়ী বিয়ে হারাম করেন।  Abu Dawood, Book 11, Number 2068:

৪। সাবরা আল জাহানী বর্ননা করেন – আল্লাহর রাসুল বলেছেন – হে মানব সম্প্রদায়, আমি অস্থায়ী বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলাম কিন্তু আল্লাহ সেটা (এখন) কেয়ামত পর্যন্ত নিষেধ করেছেন। অতএব যাদের কাছে এখন এমন অস্থায়ী স্ত্রী আছে তারা তাদেরকে মুক্ত কর, এবং তাদেরকে যে মোহরানা দিয়েছ সেটা ফেরত নিও না। Muslim, Book 008, Number 3255:

৫। আবদুল আল মালিক বর্ননা করেছেন – আল্লাহর রাসুল রাসুল অস্থায়ী বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন কিন্তু মক্কা বিজয়ের দিন সেটা নিষেধ করে দেন। Muslim, Book 008, Number 3257:

৬। রাবী সাবরা বর্ননা করেছেন – আল্লাহর রাসুল চুক্তি (অস্থায়ী) করে বিয়ে করা বাতিল করেছিলেন। Muslim, Book 008, Number 3259:

৭। রাবী সাবরা বর্ননা করেছেন – আল্লাহর রাসুল মক্কা বিজয়ের দিন অস্থায়ী বিয়ে নিষেধ করেন।
Muslim, Book 008, Number 3260:

৮। সাবরা আল জাহানী বর্ননা করেছেন – আল্লাহর রাসুল চুক্তি করে অস্থায়ী বিয়ে বাতিল করেছিলেন এবং বলেছিলেন – শোন, আজ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তোমাদের জন্য অস্থায়ী বিয়ে বাতিল হল, যারা মোহরানা দিয়েছ তা ফেরত নিও না। Muslim, Book 008, Number 3262:

এতবার নিষেধ করার পরে মুতা বিয়ে ইসলামে হালাল থাকে না। মুতা বিয়ে স্পস্ট হারাম। যারা মুতা বিয়ে করে তারা তাদের মতন করে করে। এটা তাদের পদ্ধতি। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। যে প্রথা ইসলামে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে,তাকে শুধু শুধু কিছু মানুষ নিজেদের মোচ্ছবের স্বার্থে চালিত রাখছেন। রেখে লাভ কি? কিছু মানুষের অমানবিক এবং নিষ্ঠুর ক্রিয়া সম্পন্নে ইসলামের প্রতি মানুষের ঘৃনা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাবে যা একটি ধর্মের জন্য কখনই হিতকর নয় ।

একজন লেখিকা হিসেবে , সভ্য সমাজের নাগরিক হিসেবে শুধু ইসলাম ভিত্তিক মানুষ নয় , ধর্ম বর্ন জাত পাত ভেদে সমগ্র সুশীল সভ্য মানুষের প্রতি অনুরোধ জানাবো আসুন মুতা বিবাহের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি।  কোথাও মুতা বিবাহের খবর পেলে পুলিশ ও প্রশাসনকে খবর দিন । আসুন আমরা এক হয়ে মুতা বিবাহের মতন একটি কূখ্যাত ভোগ প্রথা সমাজ থেকে চির নির্মূল করি ।





Previous Post Next Post