তখন বয়স মনিমার কত ? এই তেরো চোদ্দ হবে। এই বয়সে মেয়েদের সে সময়ে বিয়ে হয়ে যেত। মনিমার জন্যে ছেলে দেখা হচ্ছিল। ওদের বাড়ি ছিল কুলটি, গ্রাম এলাকা বলা যায়। ঘরে বাবা, মা, ভাই, বোন ছাড়া থাকতেন ঠাকুর দা। ঠাকুমা অনেক দিন আগেই মারা গিয়ে ছিলেন। মনিমা জানে তাঁর ঠাকুরদা ভূতের মন্ত্র তন্ত্র জানেন। ভূতে ধরা অনেক কেস আসত তাঁর কাছে। ভূত ছাড়াতে তাঁকে কাছে, দূরে অনেক জাগায় যেতে হত। মনিমা এ নিয়ে কোন দিন মাথা ঘামায় নি। মেয়ে হিসাবে ওকে ঘরের অনেক কাজ করতে হত। বিবাহ আসন্ন তাই ভালো ঘরণী হবার তোড় জোড় চলছিল তখন। মা ডেকে রান্না শেখাতেন, ঘর গোছানো শেখাতেন। শেখানোর আর কি আছে -- সব তো জানে মনিমা। গাঁয়ের মেয়েরা তো স্কুলের পড়াটুকু করে বাকি সময় ঘরের কাজেই কাটায়।
গ্রামে ভয়ের চলন অপেক্ষাকৃত বেশী। ফাঁকা জাগা। লোক সংখ্যা কম তাই ভূতেরা নিরিবিলি থাকতে পারে। তাই বা বলি কি করে ! ভালো ভূত যারা নিজেদের নিয়েই তারা ব্যস্ত --অন্যের পেছনে লাগে না। ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকে না। কিন্তু অন্যের পেছনে লাগা--ভয় দেখানো--এর ওর শরীরে প্রবেশ করে যাওয়া--এ সব তো ভালো কথা না ! তাই ওঝার সৃষ্টি হয়েছে--বিশেষ করে গ্রামে। দুষ্ট আত্মা, ভুতদের শায়েস্তা করার জন্যেই তো ঠাকুরদার মত ওঝাকে থাকতে হয় গ্রামে।
মনিমা ওসব জানে। সব শুনে জেনেছে--নিজে চোখে ও কখনো ভূত দেখে নি। কখনো ভূতে পায় নি তাঁকে। আর এ নিয়ে কখনো মাথাও ঘামায় নি। কি দরকার--ভূত যদি থাকে থাকুক না, ওদের জাগায় ওরা থাকবে, আমাদের জাগায় আমরা ! বর্তমান সময়ে মনিমা এসব চিন্তা থেকে আরও দূরে থাকতে চায়। অবসর সময় হলেই তাঁর মনে পড়ে, বিয়ে হবে বলে। ওঁর বর হবে, ও কারো বৌ হবে, ভাবতে কেমন যেন লাগে ! সুন্দর একটা ছেলে--সে সাজবে, বর--আর মনিমা সাজবে, বৌ!
চিন্তায় বাধা পড়ল মনিমার। ঠাকুরদা এসে দাঁড়িয়েছেন দোর গোড়ায়। তাঁর নিশ্চয় কোন কাজ আছে। ঠাকুরদা বললেন, মনি মা ! বৌ মাকে বলো, আমি বের হচ্ছি এক জাগায়, রাতে ফিরতে দেরী হবে।’
--‘কোথায় বের হচ্ছ ঠাকুরদা ?’ মনিমা প্রশ্ন করল।
--‘নিতাইয়ের ঘরে যাচ্ছি।’ ঠাকুর দা বললেন।
--কি ভূত ভাগাতে ? মনিমার প্রশ্ন।
--‘হ্যাঁ, রে, নেতাইয়ের বৌকে ভূতে ধরেছে, ঠাকুর দা বলেন।
--‘সুধা বৌদিকে ?’ আবার মনিমার প্রশ্ন।
--‘হ্যাঁ’, ব’লে মনিমার ঠাকুরদা, কৈলাস বাবু বেরিয়ে গেলেন নেতাইয়ের বাড়িতে।
সুধা বৌদিকে ভূতে ধরেছে ! মনিমার সঙ্গে সুধা বৌদির ভালো ভাব, অনেক দিন থেকে সুধা বৌদিকে চেনে ও। বৌদি শিক্ষিতা মহিলা। নিতাইদার সঙ্গে কোলকাতার মেয়ে সুধার বিয়ে হয়ে ছিল। বি.এ.পাশ মেয়ে। তাকে কি না ভূতে ধরল ! তাও কি না গ্রামের ভূত ! সে ভূত অশিক্ষিত হবারই কথা !
মনিমা রাতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। জানতে পারলো না, কখন তাঁর ঠাকুরদা এলেন নিতাইদার ঘর থেকে। গ্রামের ঘরগুলি একটা থেকে আর একটা বেশ দূর দূর হয়। অনেক সময় দেখা যায় কয়েক হাজার গজ দূরত্বে হয়ে যায় এক ঘর থেকে আর এক ঘর। মনিমাদের বাড়িও তেমনি। ওঁদের বাড়ির পাশে মণ্ডল বাড়ি, কম হলেও দু তিন হাজার গজ দূরে তো হবেই ! গ্রামের ঘরগুলিতে আরও একটা অসুবিধা হয়, ল্যাট্রিন, বাথরুম নিয়ে। থাকার ঘর থেকে সে গুলি বেশ দূরে তৈরি হয়। অবশ্য এটা স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখেই করা হত। সে দিন মনিমার মনে ভূতের চিন্তা ঢুকে গিয়ে ছিল। বিশেষ করে সুধা বৌদিকে ভুতে ধরেছে কথা শোনার পর থেকেই এমনটা হল। মনিমা যে ঘরে শোয় তার পরেই সামনের দিকে বারান্দা। ঠাকুরদা যখন অনেক রাত করে বাড়ি ফেরেন তখন বারান্দার খাটেই শুয়ে যান। তাঁর জন্যে সে ব্যবস্থা আগে থেকেই করা থাকে। সে দিন সুধা বৌদির বাড়ি থেকে ভূত তাড়িয়ে আসতেও বেশ রাত হয়ে গিয়ে ছিল। ঘরে এসে তিনি আর কাউকে ডাকেন নি। বারান্দার খাটে পাতা বিছানাতেই শুয়ে পড়লেন।
মনিমা জানে, ঠাকুরদা তাঁর ভূতের মন্ত্র জানেন। তার মানে ভূতদের শত্রুও তিনি ! বাগে পেলে ভুতেরাও দাদুর ঘাড় চেপে ধরতে পিছু পা হবে না ! নেহাত বদলা ওরা নিতে পারে না, কারণ, ঠাকুরদা সব সময় মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে নাকি নিজেকে বেঁধে রাখেন! এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল মনিমা। শেষ রাতের দিকে তাঁর ঘুম ভেঙে গেলো। মনে হল ঠাকুরদার কথা। নিশ্চয় সুধা বৌদির বাড়ি থেকে ফিরেছেন তিনি। সকালে উঠেই জানতে হবে সুধা বৌদি কেমন আছেন।
আর ঘুম আসছিল না মনিমার। একবার বাথরুমে যাবার কথা ভাবছিল। ধীরে ধীরে বেশ প্রেশার আসছিল। এমন খুব কম হয়। আজ রাত জাগার জন্যে এমনটা হবে হয় তো ! ধীরে ও বারান্দায় বের হল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলো, ঠাকুরদা শুয়ে আছেন। সামান্য ভয় লাগছিল মনিমার। এমনিতে তাঁর ভয় লাগে না। নিজে নিজে ল্যাট্রিন বাথরুমে ঘুরে আসে। কাউকে ডেকে দাঁড়াতে বলতে হয় না। তবে আজ সুধা বৌদির কথা ভেবে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল। ঠাকুরদাকে ডাকবে কি না একবার ভাবল, তারপর, না ডেকেই এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে।
বর্ষার সময় ছিল। আশপাশের জমিতে জল জমে আছে। তখন ঝিরিঝিরি বর্ষা পড় ছিল। চাঁদনী রাত না হলেও শেষ রাতের ফালি চাঁদ আবছা আলো ছায়ায় খেলা করছিল যেন ! বাথরুম একটু দূরেই বলা যায়। বেশ লম্বা উঠোন ছাড়িয়ে ধান জমির শুরুর কিনারায় বাথরুম। পা টিপে টিপে তো গেল মনিমা। ঠিক ফেরার সময় মনে হল দূরে ধান খেতের জলে থপ থপ পা ফেলে কেউ হাঁটছে ! স্পষ্ট কানে গেলো তার। মনিমা তাকাল, দেখতে পেল, একটা আলো ধীরে ধীরে জমির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আলোর সঙ্গে কোন মানুষকে দেখা গেলো না। কোন ছায়া দেখা গেলো না। শুধু আলো এগিয়ে যাচ্ছে ! কিন্তু থপ থপ, ঝপ ঝপ কার পায়ের শব্দ হয়ে চলেছে ! মনে হচ্ছে জমিতে জমা জলে কেউ পা ফেলে ফেলে হেঁটে যাচ্ছে !
ভয়ে মনিমা দৌড়াতে পারছিল না। তার গতি যেন কেমন শ্লথ হয়ে গেছে। কেউ যেন তাঁকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে ! দেখল মনিমা, আলো এক জাগায় থেমে গেলো। একটু পরেই সে সচল হল, আবার ঝপ ঝপ জল কেটে চলেছে সে ! কিন্তু কোথায় চলেছে ? এ যে তার দিকেই এগিয়ে আসছে ! ভয় পেল মনিমা। ও চীত্কার করতে চাইল। কিন্তু গলা তাঁর বন্ধ ! ‘গোঁ গোঁ’, শব্দ ছাড়া আর কিছুই মুখ থেকে বের হচ্ছিল না। শরীর কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছে। ও তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো ক্রমশ: তার দিকে এগিয়ে আসছে ! আর ত্রিশ হাত দূরে হবে আলো। যতদূর দেখা যাচ্ছে, শুধু আলো--সাথে কোন জনপ্রাণী নেই !
হঠাৎ মনিমার হুঁশ এলো। স্বপনের মত হলেও যে ঘটনা সামনে ঘটে যাচ্ছে সে কি সত্যি ! ও, ‘কে ?’ বলে চীত্কার করে উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে আলোটা নিভে গেলো। চলার শব্দ সে সঙ্গে থেমে গেলো। ততক্ষণে মনিমা বারান্দার ধারে কাছে পৌঁছে গেছে। এবার মনে হল আলো নেই, তবে কেউ যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে ! কারো পায়ের শব্দ থপথপিয়ে এগিয়ে আসছে --কেউ যেন ওর কাছে আসছে...আরও...আরও এগিয়ে... চীত্কার দিয়ে মনিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চীত্কারের শব্দে আচমকা ঠাকুরদার ঘুম ভেঙে গেলো। ধড়ফড় করে উঠলেন তিনি। মনিমাকে বারান্দার কিনারে তিনি পড়ে থাকতে দেখলেন। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল সে। তাঁর মাথায় জল দেওয়া হল। মনিমার মা, বাবা, সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে এলেন। বেশ কিছু সময় পরে হুঁশ এলো ওর।
কৈলাস বাবু ব্যগ্র হয়ে বললেন, ‘দিদা কেমন আছ ? কি হয়েছে তোমার ?’
মনিমা কিছু সময় চুপ করে থাকলো। একটু আগের স্বপ্ন্ মত যে ঘটনা তার সঙ্গে ঘটে গেলো ঠাকুরদাকে ধীরে ধীরে তা বলল।
কৈলাস বাবু বললেন, ‘এটা ঠিক করো নি দিদিভাই ! আমায় একবার ডেকে যেতে পারতে। সব রাত সমান নয়। আর শেষ রাত খুব খারাপ হয় ! তোমার কাছে হরেন্দ্র আসছিল,দিদুন !’ --‘হরেন্দ্র ? না আমি শুধু আলো দেখেছি’ , মনিমা বলল।
--‘তুমি জান না দিদিভাই ! ও হরেন্দ্র,এমনি সময় ও যায়। ওই দূরের শ্মশান থেকে উঠে আসে। ওর মৃত্যু তো স্বাভাবিক ছিল না !’ ঠাকুরদা বললেন।
কৈলাস বাবু, মানে ঠাকুরদা ওই রাতেই নাতনীকে মন্তর তন্ত্র করে ঝেড়ে দিলেন। বললেন, ‘আর কিছু ভয় নেই তোমার। তুমি ঘরের ভিতরে যাও। আমি যেখানে থাকি সেখানে ভূত কিছু ক্ষতি করতে পারবে না।’
পর দিন ঠাকুর দা, মানে কৈলাস বাবু বললেন আলেয়ার কথা।
গাঁয়ের হরেন্দ্রর অনেক টাকা পয়সা ছিল। ডাকাতের ভয়ে সে টাকা পয়সা ঘরে রাখত না--তার নিজের কোন জমির কোনায় মাটির নিচে নাকি পোঁতে রাখত!
ডাকাতরা জানত হরেন্দ্রর অনেক টাকা পয়সা। ওর বাড়িতে এক বার এলো ডাকাতি করতে। ডাকাতেরা ওকে সমস্ত টাকা পয়সা বের করতে বলল। তাও সে টাকা পয়সা দিলো না। দেবে কোথা থেকে--সব তো পোঁতা ছিল মাটির নীচে! শেষে ডাকাতেরা ওকে খুন করে চলে গেলো। সেই থেকে হরেন্দ্র আলেয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় রাতেই সে শ্মশান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়ে যায়। যেখানে সে টাকাপয়সা মাটিতে পুঁতে রেখে ছিল সেখান পর্যন্ত সে আলেয়া হয়ে যায়। মাটিতে পুঁতে রাখা টাকা পয়সা পাহারা দেয়।
মনিমা বলে উঠলো, ‘সে নিজেই আলেয়া, নাকি আলো নিয়ে যায় ?’
কৈলাস বাবু বলেন--‘হ্যাঁ, সে নিজেই আলোর রূপ ধারণ করে। তার শরীর দেখা যায় না। ভূতদের ছায়া হয় না। তাই তার নিজের আলোই হয় আলেয়া !’
--‘তুমি দেখেছ ?’ মনিমা ঠাকুরদাকে প্রশ্ন করে।
কৈলাস বাবু বলেন, ‘হ্যাঁ, প্রায়ই তো ওকে দেখি। কারো কিছু ক্ষতি করে না বলে আমিও ওকে কিছু বলি না।’
--‘আচ্ছা, তুমি চাইলে সে টাকা পয়সা উদ্ধার করতে পার না ? খুঁজে তো বের করতে পারো ?’ মনিমা আবার প্রশ্ন করে।
ঠাকুরদা বললেন, ‘তা পারি, কিন্তু হরেন্দ্র ভীষণ রেগে যাবে। ও নিশ্চয় আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আর তা ছাড়া ওই টাকা পয়সা অভিশপ্ত থাকে--কেউ নিলে তার অমঙ্গল হয়।’
![]() |
পরিচিতি |
Tags:
গল্প