“আগর কহিঁ জন্নত হো, তো ও ইঁহা,সির্ফ ইঁহা”- এই কথাটা আমার প্রথম মনে হয়েছিল কাশ্মীরে পা রাখার আগেই। পথের পাশের সবুজরঙা নদীটার বয়ে চলার ছন্দ অথবা পাহাড়ের ধাপে ধাপে আঁকাবাঁকা রাস্তার বায়োস্কপিক দৃশ্য- মন ভুলিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাদ সাধল পরিবেশ। থমথমে ভাবটা তখনো ঘিরে ধরেনি আমাদের যখন ড্রাইভার আমাদের বলেছিল “খিড়কি খোলকে মত রখনা ইস জগা পে”। পাথর ছোঁড়ার ভয়ে গাড়িটা খুব জোরে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওই বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তা ধরে। জায়গাটার নাম বানিহাল। ওখানকার লোকের কাছে নাকি “মিনি পাকিস্তান”।কিন্তু প্রকৃতির রূপ পাথর ছোঁড়ার ভয়কে জয় করার পক্ষে যথেষ্ট মনে হয়েছিল।
“কাশ্মীর”- নামটার সঙ্গেই জড়িত অনেক ভয় আর বেশ কিছু স্মৃতি,যা মনে করায় একটাসময় পরিব্রাজকদের জন্য খুব একটা নিরাপদ ছিলনা এই জায়গা। তারপর কেটেছে অনেকটা সময়। পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। আমরা ভ্রমণপিপাসু মানুষরা উপেক্ষা করে থাকতে পারিনি এই সুন্দরের হাতছানি। তাই সাধ আর সাধ্যের কষ্টসাধ্য মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই বছর আয়োজন করেছিলাম ভুঃস্বর্গভ্রমনের। ভয়কে জয় করার মানসিকতা নিয়েই বেরিয়েছিলাম আমরা। এমনকী শ্রীনগর যেতে না পেরে সে রাত্রে যখন আমাদের গাড়ি পহেলগাঁও যাবার পথ ধরল গ্রামের মধ্যে দিয়ে ভয় পাইনি তখনও। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে কেবল আমাদের একটি মাত্র গাড়িই,আশেপাশে বহুদূর অব্ধি চোখে পড়ছেনা কোন আলোর রেখা। শুধু মাঝে মাঝে কোন একটি বা দুটি ঘরে দেখা যাচ্ছে টিমটিমে তেলের আলো। রাতের অন্ধকারে গ্রামের নাম দেখতে পাইনি। ভয় কাকে বলে প্রথম বুঝতে পারলাম যখন গাড়ী আটকে রাস্তার মাঝে জনাদশেক ছেলে আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে দু-তিনজন গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিল ভিতরে বসে থাকা আমাদের। ড্রাইভারকে কাঁচ নামাতে বলে ‘কোথাকার গাড়ি,কোথা থেকে আসছে ইত্যাদি সব তথ্য জেনে সে যখন এটা বলেছিল, “লড়কি হে, জানে দো।”,তখন হটাত কেন জানিনা মনে হয়েছিল,আরে, এরাও আমাদেরই মত। ভয় পাবার তো কিছু নেই।
পরের সকালে ঘুম ভাঙল পহেলগাঁওতে,যদিও যাবার কথা ছিল শ্রীনগর।ভূঃস্বর্গে আসছি বলে কথা,এটুকু ওলটপালট তো চলতেই পারে। এই বলে প্রকৃতির দিকে মনোনিবেশ করলাম। তা প্রকৃতিও তার পুরস্কার অকৃপণ হাতেই দিয়েছিল,তার রূপের ডালি ভরে সাজিয়ে। আরু আর বেতাব উপত্যকার নয়নকাড়া রূপে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়!
আরু ভ্যালি
অমরনাথ যাত্রার প্রথম সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে মনে মনে বলেছিলাম, ‘আবার যেন আসতে পারি। রাতের অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়তে হচ্ছিল। ড্রাইভাররা সব গাড়ি একসাথে যাবে,তাই অমন রাত থাকতে আমাদের তুলে দিয়ে ঘুরতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়া। বেশ খানিকটা বিরক্তও লাগছিল। কি যে করে এরা। এত সুন্দর জায়গাটার শুধু শুধু বদনাম হচ্ছে। কিন্তু ভালো কিছু দেখতে চাইলে কিছু জিনিষ উপেক্ষা করে থাকতে হয়। আর পরের দিন শোনমার্গ গিয়ে রাতের ঘুম বিসর্জন দেওয়াটাও উসুল হয়ে গেল প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার পরে। বরফের গোলা নিয়ে খেলা করার সময় মনেই হচ্ছিলনা রাতজাগার ক্লান্তি আমাদের ছুঁতে পেরেছে।
জোজিলা পাসে
কাশ্মীরকে প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছে তার রূপের সম্ভার,একথা অনস্বীকার্জ। আখরোট,আপেল,কেশর, টিউলিপের সম্ভারে ঢেলে সাজানো এই জায়গাটাকে এই কদিনেই ভালো বেসেছিলাম সেকথা বেশ বুঝতে পারছিলাম। সারা ভ্যালিজুড়ে সাদা বরফের চাদরে নিজেকে মুড়ে নেওয়া গুল্মার্গ আবার সম্পূর্ন এক অন্য রূপে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল আমাদের।ওখানে ঢোকার আগে রাস্তাতেই শুরু হল তুষারপাত।ঠান্ডাতে হাত পা সব ফেটে যাবার জোগাড়। তবু ওরই মধ্যে বরফ নিয়ে মজার খেলা।আর রোপওয়ে চড়া না হলেও আনন্দের ঘাটতি রইলনা।
বরফের চাদরে ঢাকা গুলমার্গ
বরফ,ফুলের সমারোহ,ডাললেকের শিকারা ভ্রমণ থেকে কাওয়া,ট্রাউট মাছ- বাদ গেলনা কিছুই। কাশ্মীরের রূপরস প্রাণভরে নিলাম আমার মধ্যে।
কথায় বলে কোন নতুন জায়গায় গেলে সবার আগে আপন করে নিতে হয় সেখানকার রসনাকে। সেটা মাথায় রেখেই চেখে দেখলাম কাশ্মীরি ট্রাউট মাছভাজা। ওদের রোগানজোশ খেয়ে তো সত্যিই জিভে জল এসেছিল- স্বাদে আহ্লাদ বোধহয় একেই বলে।কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও বাকি থেকে গেল আরও অনেককিছু।যেন দেখেও দেখা শেষ হলনা। কিন্তু সময়সীমা মেনে তো আবার এই কংক্রীটের জঙ্গলে ফিরতেই হবে। তাই আসার আগে আবারও বলে এলাম এই ভূঃস্বর্গকে “আবার আসিব ফিরে।
![]() |
পরিচিতি |
Tags:
ভ্রমন