একদিন এক পরিচালকের ইচ্ছা হলো গোটা দুনিয়াকে একটি ব্যাগে ভরার। ইচ্ছেতে তাঁর ফাঁকি ছিল না তাই, সেই ইচ্ছা একদিন পরিণত হলো বাস্তবে। নামিয়ে আনলেন বিশ্বকে তাঁর স্বপ্নের বাগানে। নাম দিলেন “রামোজি ফ্লিম সিটি”।----হ্যাঁ, আমি তাঁর কথায় বলছি, যিনি আমাদের কাছে ‘রামোজি রাও’ নামে পরিচিত।
এই বছরের গোঁড়াতেই,মাসটা ফেব্রুয়ারী—পাড়ি দিলাম “মুক্তোর দেশ হাইদ্রাবাদে”। আমরা তিনজন—আমি, আমার ছেলে আর ওর বাপি। আমাদের হোটেলটি ছিল হেমন্ত নগরে। এখানকার পরিচিতি সুত্রে এক কাকাবাবুকে পেয়েছিলাম আমরা। তিনিই আমাদের থাকার ও ঘোরার ব্যাবস্থা করে রেখেছিলেন। ট্রেন জার্নির ক্লান্তিতে রাতে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,তাছাড়া পরেরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল হাইদ্রাবাদের “রামোজি ফ্লিম সিটি”। শুনেছিলাম একটা গোটাদিনও নাকি কম পড়ে যায় এই দুনিয়া দেখতে, সুতরাং সকাল সকাল বেরোতে হবে। ভোরের আলিস্যি কাটিয়ে ঘুম থেকে ওঠা কঠিন ব্যাপার, যথারীতি শুরু হয়ে গেল হুটোপাটি। ঠিক সকাল ৮ টায় গাড়ি আসার কথা। কোনো রকমে স্নান সেড়ে, ধোসা দিয়ে নাস্তা করে গিয়ে বসলাম গাড়িতে।
গাড়ি ছুটে চললো প্রধান রাস্তা ধরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেই অদ্ভূত শহরের দিকে। গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকালেই দেখতে পাচ্ছিলাম বোগেনভেলিয়ার শোভা। গাঢ় বেগুনি ,লাল বা সাদা গুচ্ছাকারে ফুটে আছে বোগেনভেলিয়া। ৪০-৪৫ মিনিট পর আমরা এসে দাঁড়ালাম ফ্লিম সিটির প্রবেশদ্বারের বাইরে। ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করাতে নিয়ে গেল আর আমরা মুখে চোখে বিস্ময় নিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে চললাম টিকিট কাউন্টারের দিকে।
টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম,একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে আর লাইন দিয়ে লোক সেই বাসে উঠছে, আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম। মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাস আমাদের নিয়ে ছুটে চললো সেই দুনিয়ায়। বাস কখনো উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার কখনো ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রায় মিনিট পনেরো পর আমরা এসে দাঁড়ালাম একটা ঝকঝকে বাসস্ট্যান্ডে। ফ্লম সিটির স্টাফেদের কাছেই জানলাম, এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই দেখলাম লাল রঙের, মাথায় ছাদ ছাড়া চারপাশ খোলা এক রকমের সুন্দর দেখতে বেশ কয়েকটা বাস পরপর এসে দাঁড়ালো সেই স্ট্যান্ডে। এই বাসেই ঘুরে দেখতে হবে আমাদের পুরো ফ্লিম সিটি। বাসের সিট ভর্তি হতেই বাসগুলো ভ্রমনার্থীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করছে। এমনই একটি বাসে আমরাও উঠে বসলাম। বাস আমাদের নিয়ে ফ্লিম সিটির ঝকঝকে রাস্তায় চলতে লাগলো আর একজন গাইড আমাদের সমস্ত স্পট গুলোর বর্ণনা দিতে লাগলো। কোথাও দু’পাশে সবুজ ঘাসের গালিচা মাঝে ধীর গতিতে ছুটে চলেছে আমাদের বাস। ঘুরতে লাগলাম আর অবাক হতে লাগলাম, যে জায়গাগুলো আমরা সিনামায় দেখেছি, সেগুলো আমাদের চোখের সামনে। প্রায় ২০০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই সিনামা শহরে কি নেই?—শুধু তাই নয়, সারা বিশ্বে এতবড় ফ্লিম সিটিও নেই। বাইরে তাকাতে তাকাতে দেখলাম হঠাৎ প্রকৃতিটা কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ভারতের মাটি ছেড়ে আমরা হঠাৎ এসে পড়লাম বিদেশের মাটিতে। বাস্তবের সাথে এই সাজানো শহরের কোনো পার্থক্য নেই, হুবহু এক। সত্যিই যেন আমরা এই ছোট্ট বাসে চড়ে পাড়ি দিচ্ছি। লন্ডন, প্যারিস—আরো আরো কত দেশে।
বাস বিদেশের অলিগলি ঘুরে এসে দাঁড়ালো একটা বড় হলঘরের সামনে। আমাদের ১৫ মিনিট পর আবার এই বাসেই ফিরে আসতে বলা হলো। আমরা হলে প্রবেশ করতেই অবাক হয়ে গেলাম। বিদেশের রাস্তা থেকে হঠাৎ যে রাজপ্রাসাদে এসে পড়ব বুঝতেই পারিনি। কে বলবে নকল?---থাম থেকে শুরু করে সিংহাসন,সব যেন সোনায় মোড়া। ছাদে থামে অপুর্ব কারুকার্য। মুগ্ধ নয়া হয়ে উপায় নেই।
ঘুরতে এলে কি হবে? অনুশাসন মানতে হবে। শুধু ওই বাসেই নয়, ওই একই সিটে বসতে হবে সকলকে। আমরা বাসে ফিরতেই বাস আবার চলা শুরু করলো। কিছুদূর গিয়ে এই বাস ছেড়ে আমরা গিয়ে উঠলাম একই রকম দেখতে আরেকটি বাসে। এই বাস আমাদের নিয়ে যাবে ফ্লিমসিটির অন্য অংশে।
দেখলাম দূরে একটা স্টেশন একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল একটি আসল স্টেশন ও ট্রেন। এবার বুঝলাম নায়ক চলন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে নায়িকার হাত ধরে কিভাব তুলে নেয়। – নয়া শুধু স্টেশন নয়, এয়ারপোর্টও আছে। বাস এসে দাঁড়িয়ে পড়লো এয়ারপোর্টের সামনে। আমরা একে একে গিয়ে বসলাম প্লেনে।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই দেখি জেলখানার গারদ ধরে উন্মত্ত কয়েদিরা হুংকার দিচ্ছে। গারদের লোহার শিক ঠকঠক করে নড়ছে। ---না, ভয় পায়নি কারন ওরা যে সবাই নকল। কিছুদূর গিয়েই আবার আমাদের বাস থেকে নেমে যেতে হলো। এই বাসটার যাত্রাপথ এতটাই ছিল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম রাজস্থান, একে বারে হাওয়া মহলের সামনে। সেখানে অনবরত নেচে চলেছে রাজস্থানি শিল্পীরা, রাজস্থানি গানের আবহে ক্ষণিকের জন্যও মনে হয়নি এটা কৃত্রিম রাজস্থান।
পায়ে পায়ে নেমে এলাম নিচের বাগানে।যেন পৃথিবীতে স্বর্গ। বিরাট আকারের নৃত্যরত মূর্তি। দেখেই মনে হলো আরে! এগুলো তো দেখেছি।----কোথায় আবার?----সিনামায়। নায়িকারা মূর্তি ঘিরে নাচ করে আর গায়।
এবার গিয়ে চাপলাম তৃতীয় বাসে। এখনো কত বিস্ময়ই নয়া বাকি। কিছুটা পথ ঘুরে বাস আমাদের নামিয়ে দিল। আমরা ভিতরে প্রবেশ করেই দেখলাম,ধ্যানমগ্ন মুণিঋষিদের,এটা যেন একটা পাতালপুরির গুহা। আমরা যত এগিয়ে যেতে লাগলাম, ততই প্রবেশ করতে লাগলাম রূপকথার দুনিয়ায়। একটা ছোট্ট খেলনা গাড়ি লাইনপাতা পথে এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে, আমরা তাতে উঠে বসতেই আমাদের নিয়ে পাড়ি দিল হিমশীতল রূপকথার দেশে।প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের জন্য আমাদের মনটাও যেন শৈশবের আনন্দে ভরে উঠলো। মাটির তলার দেশ দেখিয়ে গাড়ি আবার আমাদের নামিয়ে পাড়ি দিল অন্য যাত্রী নিয়ে। এরপর সবটা পায়ে হেঁটে। কোথাও ঝর্ণা, কৃত্রিম নদী। একটু বসা আবার চলা।
চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম পতপঙ্গের দুনিয়ায়, যেখানে প্রজাপতিরা ডানা মেলে নেচে চলেছে। কখনো তারা ফুলের পাঁপড়িতে আবার কখনো তারা বাহারি গাছের পাতায়। ওদের উড়ার মাঝেই আমরা ঘুরে চলেছি ওদের রাজ্য।আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলেছে রঙিন প্রজাপতি।এভাবে পজাপতিদের মাঝে ঘোরার এক অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে আবার চলা শুরু করলাম।
তখনো জানি না এর থেকেও বিস্ময়কর কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে। এসে ঢুকলাম পাখিদের রাজ্যে। সারি সারি পেঁপেগাছ,তাতে ঝুলছে কাঁচা পাকা পেঁপে। মাথার উপর দিয়ে এপাশে ওপাশে উড়ে চলেছে লাল-নীল-সবুজ রঙের বাহারি পাখি।এমনো হতে পারে! আমরা আর ওরা প্রকৃতির মাঝে এত কাছাকাছি! এত কাছ দিয়ে উড়ে চলেছে যেন মনে হচ্ছে মাথায় বুঝি এবার ওদের ডানার ছোঁয়া লাগবে।
এমন রাজ্যে দুদন্ড জিরিয়ে নিয়ে আবার চলা শুরু নতুন কিছু দেখার জন্য। শুধু ঘোরাঘুরি নয়। কেনাকাটারও সুযোগ আছে। আছে স্থানে স্থানে হস্তশিল্পের দোকান। দাম একটু বেশি তবে সখের দামতো এখন আর ষোলো আনা নেই একটু বেশিই লাগে। ওদিকে দীর্ঘপথ হেঁটে নাড়ি-ভূঁড়ি তো একেবারে হজম হওয়ার জোগাড়। পথে যে দু’চারটে স্টল আছে সেখানে স্ন্যাক্স ছাড়া কিছুই মেলেনি। খাবারের খোঁজে কিছুটা হাঁটতেই দেখলাম বিরাট এক ফুডপ্লাজা। যেখানে বিরিয়ানী থেকে চায়নিজ সব ধরনের খাবারই মেলে।কুপন কেটে ঢুকে পড়লাম।দুপুরের আহার সেরে একটু জিরানো, কখনো চ্যাপলিনের পাশে বসে ছবি তোলা।সময় বয়ে যেতে লাগলো। ঠিক তখনি দেখে সামনে এক বিরাট হলঘরের সামনে লম্বা লাইন। সেই যে মাথাপিছু ১৩০০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকেছিলাম, আর কোথাও টিকিট কাটতে হয়নি। যখন আর পয়সা খরচের ব্যাপার নেই তখন আর বসে থাকায় বা কেন? ---গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনে। শো চলছে। ---একটা শেষ হলে আরেকটা শুরু হবে আর আমরা ঢুকবো। ভিতরে ঢুকে বুঝলাম,কি দেখতে এসেছি। এতদিন সিনামা দেখেছি। এবার দেখবো সিনামা কিভাবে হয়।একটা ঘরে একেক পর্যায়, মোট চারটে পর্যায়ে আমাদের দেখানো হলো সিনামা আসলে কি?----সে এক অদ্ভূদ অনুভূতি--- না সেটা আমি আর বলবো না,সেটা জানলে সিনামায় যত দুঃখের সিন ই হোক না কেন,---আপনার শুধু হাসি পাবে আর সিনামার পিছনের আসল রহস্যটা রহস্য থাকায় ভালো।
Tags:
ভ্রমন