রিংকু কর্মকার চৌধুরী






কিরে বিনতা তোর ঠাকুমা  কেমন আছে?  নিম দাঁতনে দাঁত ঘষতে ঘষতে বিনতা কে জিজ্ঞেস করল মানিক কাকু। মানিক কাকু মানে মানিক হড়। বিনতাদের দুটো  বাড়ি পরে থাকে। পেশায় মুদি । বাচাল ও  ফিচেল নামে পরিচিতিটা একটু বেশীই ওনার। 

ভালো  আছে কাকু। একটু ভালো আছে ঠাকুমা। বিনতা মানিক কে কাটাবার জন্য কথাটা বলেই পা বাড়াল বাড়ীর দিকে। আরো  কিছু বলতে যাচ্ছিল মানিক হড় কিন্তু কাকিমা ভিতরের ঘর থেকে চেঁচানোতে গামছা সামলে ঘরে ঢুকে গেল মানিক। বউ কে ভীষন ভয় পায় কিনা।
আমি বারান্দায় বসে সকাল সকাল ব্যপারটা দেখলাম। অন্যদিনের মতা আজ অফিস যাওয়ার তাড়া নেই তাই পেপার নিয়ে মটকা মেরে পড়ে আছি। মা বার তিরিশেক চেঁচিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আজ পণ করেছি আমি কোনো  কাজ করব না।

আমাদের বাড়িটা মানিক হড় আর বিনতাদের বাড়ীর মাঝখানে। আমি মালিনি ঘোষ একটা কাগজের অফিসে স্বল্প মাইনের চাকরী করি আর নেশা বলতে একটু আধটু লেখালিখি। এতে হাতখরচ ও মনখরচ দুই পুষিয়ে যায়। আজ সাতসকালে বিনতা আর মানিকের  কথোপকথন আমার মাথায় গল্পের বীজ বুনে দিয়ে গেল। ঘটনাটা পুরোনো এবং বিনতার ঠাকুমা কে নিয়ে তাই  পাড়ার সবাই জানে ও এ নিয়ে মজা মস্কারাও  করে।   বিনতার ঠাকুমাকে আমাদের পাড়ার সবাই কদুবুড়ি বলে ডাকে। পাড়া বলতে এপাশ ওপাশ দশটা বাড়ী।  বিনতার বাবা পাঁচ ভাইয়ের বড়। বিশাল জায়গা নিয়ে ওদের বাড়ীটা, সব একত্রে এক বাড়ীতে থাকে। হাঁড়ি অবশ্যি আলাদা। ছোটখাটো ক্ষেত আছে বাড়ীতে। নানা সব্জি চাষ হয়।বিনতার বাবা পাড়ার প্রত্যেক কে বিতরণ করেন সে সব্জি। ভদ্রলোক খারাপ নয় শুধু একটু বদরাগী। কদুবুড়ির সবকটি ছেলেই মাথামোটা ও রাগী। মায়ের কথায় ওঠে বসে। 

এই কদুবুড়ির বড় অসুখ অসুখ বাতিক। সামান্য  হাঁচিতেও উনি হসপিটালে যেতে এক পা বাড়িয়ে দেন। ডাক্তাররা এবেলা ওবেলা আসে তাকে দেখতে।   খিটকেল বুড়ি শুধু মুখ ঝামটায় আর বউমাদের গালি দেয়। বুড়ির বৌয়েরা তো ছাড় আমরা অব্দি তিষ্ঠোতে পারতাম না এর যন্ত্রণায়।  সারাদিন চেঁচামেচির নির্যাতনে আমরা ক্লান্ত হয়ে যেতাম।  সামান্য পেট ব্যথাতেও দুজন ডাক্তার  বুড়ির মাথার ধারে। এই কদুবুড়ি কে  যে কেউ শুধরোতে পারবে,আমরা ভাবতেই পারিনি। যদি না সে আসতো। সে কে? ওইটাই তো গল্প।

সেবার কদুবুড়ি প্রায় তিন মাস ধরে রোগের বাহানায় শুয়ে ছিল। কখনও পেটে তো কখনও মাথা। একদিন তো  এমন হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় যে পাড়ার ছেলে থেকে বুড়ো ভাবল এবার বুঝি বুড়ির ইয়ে প্রাপ্তি হল। কিন্তু বুড়ি চেঁচায় আর হরিবোল বলে। যাব যাব করেও ফিরে আসে। দুবার হস্পিটাল ঘুরে,পাঁচটা ডাক্তার পাল্টে লোকজন কে নাজেহাল  করে ফেলছিল  এমন সময় আমাদের পাড়ার পাঁচু কাকার পিসতুতো বোনের ননদের ছেলে ঘন্টি দা এলো বেড়াতে। ঘন্টিদার ছিল পাড়া বেড়াবার নেশা।তাই সবার বাড়ি একবার করে ঢুঁ মারতে লাগল। এদিকে কুদু তো এই যায় সেই যায় করে হুলুস্থূলু বাধায় আর কি। ঘণ্টি দা সাত সকালে কুদুবুড়ির বাড়ি  গিয়ে হাজির। কুদুবুড়ির বাড়ির ভিতর তখন হট্টগোল। মরার মত পড়ে আছে কুদু।  নাড়ি চলছে।  অথচ ডাক্তার রা কিছু  বুঝতে পারছেনা। রোগ থাকলে তো বলবে। এই সবের মধ্যে এগিয়ে গেল ঘণ্টি দা। ডাক্তার বাবুদের হঠাত বলে বসল'আমি একবার দেখি'। ডাক্তার রা কি বুঝল জানি না,সরে গেল। নাড়ি দেখে বললল,বুঝলেন আজ কালের মধ্যে মারা যাবেন।কিন্তু প্রাণটা যেতে পারছেনা। আপনার বাড়ির সামনে যে আমগাছ তার মগডালে  ঝুলছে। বিনতার বাবা হুংকার দিয়ে বলল ইয়ার্কি  হচ্ছে? ঘণ্টি দা ঠান্ডা মাথায় বলল'আমি তান্ত্রিক',সিদ্ধাই লাভ করেছি। ঠাকুমা মগডালে ঝুলছে। আপনারা প্রায়শ্চিত্ত  করুন।উনি মুক্তি পাবেন। কদুবুড়ির চার ছেলে পাঁচু কাকা কে  ধরে আনল। বেগতিক দেখে পাঁচু কাকাও বলল যে  ঘণ্টি দা তান্ত্রিক।  আমরা কিন্তু  শুনেছিলাম ঘণ্টিদার বিড়ির ডিলারশিপ। ডাক্তার রা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।  সবাই মিলে ঘণ্টি দা কে ধরল যাতে কদু কে মুক্তি দেয় ঝোলা থেকে।কদু বুড়ি তখনও মটকা মেরে পড়ে আছে। ঘণ্টি দা বিধান দিল মুক্তির।সে বিধান শুনে আমরা তো থ। বিনতাকে বলল এক বালতি গোবরজল আনতে আর একটু পচা গোবর সার। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। বিনতার বাবা ডাকল মা,ও মা, মা গো আর তোমাকে ঝুলে থাকতে হবে না। আমরা প্রায়শ্চিত্ত করছি মা। আমরা সব দাঁড়িয়ে দেখছি বুড়ি  হাত পা নাড়ছে। আস্তে আস্তে চোখ খুলছে। আমরা প্রথম সেদিন জানতে পারলাম বিনতার বাবার আরেকটা নাম ভেঁপু।  আমরা রতন জানতাম। হায় কপাল।

বুড়ি ডাকল ভেঁপু রে।  আমি আর বাঁচব নারে। আমাকে তোদের বাপ ডাকচে। আমি চলে যাব রে ভেঁপু। 
এদিকে ততক্ষনে ঘণ্টি দা গোবর জল আর পচা  গোবর সার নিয়ে সবে ঢুকছে। বুড়ির প্রলাপ শুনতে পেয়ে বলল হ্যাঁ ঠাকুমা তোমার আত্মা কে এবার গাছ থেকে নামাবো, তুমি সোজা কেওড়াতলা পৌঁছে যাবে।  দাদু অপেক্ষা করছে যে।

ঠাকুমার প্রায়শ্চিত্ত হবে আপনারা আসুন। সবাই মিলে এক চামচ  গোবর জল খাইয়ে শুদ্ধিকরণ  করুন ঠাকুমার। কথাটা শোনার পর মাথার উপর যেন সিলিঙ ভেঙ্গে পড়েছে আমাদের।  মাথাটা বন্ বন্ করে ঘুরছে। শেষে কিনা গোবর খাবে ঠাকুমা। 
ঘণ্টিদা হুংকার ছেড়ে বলল নিয়ে  আসুন ওনাকে উঠোনের মাঝখানে। তারপর আর একটা বালতি তে পচা সার গুলে নিলেন। আমি কেমন একটা, মানে অবাক না না হতবাক, না মানে কিছু একটা হয়ে গেছিলাম। সবাই মিলে বুড়ি কে ধরে উঠোনে আনতে লাগল। উঠোন তখন পচা গন্ধে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তারপর যেটা হলল তা অবিশ্বাস্য। কদুবুড়ি উঠোনে আসার সঙ্গে সঙ্গে এক চামচ পচা সার নাকের কাছে নিয়ে গেল ঘণ্টিদা।  ব্যস, কদুবুড়ি ওরে বাবারে মারে আমি খাবনারে বলে চিৎকার করছে আর ঘণ্টিদা বলছে' ও ঠাকমা তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে তোমার সোয়ামি অপেক্ষা  করছে,তোমাকে নেবে বলে।'

কদুবুড়ি বলছে আর করব না। আমি ভালো আছি। ভুল হয়েছে। এবারকার মত ক্ষমা করে দাও বুড়ি ঠাকমা কে। ও ভেঁপু  আমাকে বাঁচা বাবা।
বিনতার বাবা বলল এখন কেন।  ঠিক হয়েছে।  খালি রোগ রোগ বাই তাইনা।।

বুড়ির কান্ড দেখে আমরা পাড়া শুদ্ধ লোক হেসে কুটোপুটি। তারপর থেকে কদুবুড়ি কাউকে জ্বালায়নি আর রোগ রোগ করে।

ওই দেখুন আবার শুরু হল মায়ের হাঁক ডাক। যতই ভাবি কাজ করব না। মা করিয়েই ছাড়বে। যাই দেখি কি হল।  ও হ্যাঁ কদুবুড়ির বাড়ির সামনের বটগাছটা আর নেই। এই ঘটনার পর বুড়ির মনে হয়েছিল কে যেন বুড়ি কে ওই গাছের উপর থেকে ডাকে।

পরিচিতি 



Previous Post Next Post