সেই পুরনো চেম্বারটাই, তবু কেমন অচেনা! শীত পড়তে শুরু করেছে। সকাল-সন্ধ্যায় কুয়াশার চাদর আলতো করে গায়ে জড়িয়ে রাখে রাস্তাঘাট-হারিয়ে যায় নীলের গভীরতায় বেলা বাড়লে। শুধু বুকের ভেতর কালো পুরু আস্তরণটা। সত্যি ভোগেও বটে বাচ্চাগুলো ! দু’দিন পরপরই জ্বর-সর্দি-কাশি লেগেই আছে। যত্নের তো অভাব নেই! ‘হাইজিন হাইপোথিসিস’-যতো তুমি দূরে সরে যাবে প্রকৃতির স্বাভাবিকতার থেকে,ততোই শরীর অক্ষম হবে রোগজীবাণুর সাথে লড়তে। ন্যাচারাল এক্সপোজার,শরীর নিজেই তৈরী করে অ্যান্টিবডি নামের সেই সৈনিক,….চিনে রাখে শত্রু কে পরবর্তী আক্রমন প্রতিহত করে সহজেই।
খালি পা, আদুল গায়ে ছেলেটা ছুটছে মাঠ-ঘাট প্রান্তর ডিঙ্গিয়ে। চোখদুটো স্থির লক্ষে চেয়ে আছে আকাশপানে, হাতে বাঁশের কঞ্চি।ধরতেই হবে লাল-সাদা চাঁদিয়ালটাকে।
-বাবা !
-উ।
-লুসিড ড্রিম দেখো তুমি?
-সেটা আবার কি !
-যে স্বপ্নে মানুষ বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে।
-না। তুই দেখিস?
-হ্যাঁ। খুব মন দিয়ে ঘুমনোর আগে ভাবলে দেখা যায়। জানো বাবা, আমি না একদিনের স্বপ্ন পরদিনও দেখি । কেমন করে হয়?
-এখন ঘুমো আর স্বপ্ন দেখ। জ্বালাস না। বোর্ডের পরীক্ষা আসছে, ভুলে গেছিস!
-হু।
এই এক খেলার নেশা অনির। তবে পড়াশোনাও করে, অল্পসময় হলেও মন দিয়ে।
খারাপ খেলে না। স্কুল টিমের ক্রিকেট-ক্যাপ্টেন,ক্লাস টেনেই।
কি দুঃসহ জীবন আজকালকার বাচ্চাদের! মনে মনেই হাঁপিয়ে ওঠে অনিকেত। হালকা হওয়ার চেষ্টা করে ওদের সাথে এক মজাদার খেলায় মেতে উঠে।
-খেলতে ভালো লাগে?
-খুউউব।
-কি খেলিস?
-Need for Speed, Vice City,…..
-আরে না ! ডাংগুলি খেলেছিস কোনদিন? মার্বেল? দাড়িয়াবান্ধা?
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বছর আটেকের ছেলেটা।
গ্রাম থেকেও আজ হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব !
-সময় কোথায় ডাক্তারবাবু ! সকালে স্কুল, বিকেলে টিউশনি। যা পড়ার চাপ ! ....পাশ থেকে বলে ওঠেন ক্লাস ফোরের মা।
মাঝেমধ্যে দু’একজনের চোখে যখন নিজেকে খুঁজে পায়, কি অদ্ভুত একটা ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে অনির শরীর বেয়ে।
গুগল সার্চ করছিলো অনিকেত-অ্যাস্ট্রাল প্রোজেকশন। মানুষের আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। সত্যিই কি আত্মা বলে কিছু আছে? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো আজ।
আবার লেগেছে মা-ব্যাটার। অনীর গলা ভেসে এলো ড্রয়িংরুম থেকে।
-না !! আমি কিনবো !
-অসম্ভব!আমি দেবো না।..সুমিতার গলাও বেশ উঁচুতে।
ড্রয়িংরুমের দরজায় অনীকের ছায়া।
-দেখো না বাবা। ফুটবলের জন্য বুট কিনতে বলেছেন গেমস্ স্যার, কেডসে হবে না। মা কিছুতেই দেবে না।
-আমি স্কুলে কথা বলে নেবো বাবা। তুই বরং টিটি,ক্যারাম এগুলো খেলিস।
-কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার!!
কাঁধের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দুমদুম করে ভেতরে চলে গেলো অনী।
সোফায় শরীরটাকে এলিয়ে বসে আছে সুমিতা। দপদপ করছে কপালের শিরাগুলো।
-খেলুক না। এতো জেদ কোরো না।
-চুপ!! একটা কথাও শুনতে চাইনা আমি!
বদলে যাচ্ছে দ্রুতবেগে দৃশ্যের কোলাজগুলো, ছোটবেলার বায়োস্কোপের মতো।
শর্ট বল-পুল-লুটিয়ে পড়লো ফরোয়ার্ড শর্টলেগ। উঠে দাড়ানোর অক্ষম চেষ্টা।স্ট্রেচার।ভেন্টিলেটর। শুয়ে আছে অনির্বান। বুকফাটানো গোঙানির আওয়াজ একটা।
লাল টুকটুকে দুটো সুতোয় মোড়ানো একটা বল। জীবন বদলে দেয় কয়েকটি মুহূর্তেই।
-বাবা! ভাইকে কিনে দেও না বুটজুতো।
-তোর মা…..।
-ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট বাবা। রাস্তাঘাটে, বাসেট্রেনে তো হরদম হয়। তা বলে কি আমরা….।
-পারবো বোঝাতে?
-পারতেই হবে বাবা! নইলে আমরা যে হেরে যাবো!
চুপ করে অন্ধকার ঘরটায় শুয়ে আছে অনীক। পিঠে হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো শরীরটা।
কাঁদছিলো!
-একটু ধৈর্য্য ধর বাবা। একটু সময় দে । আমি ঠিক রাজি করাবো তোর মাকে।
-সত্যি! কিনে দেবে!...উঠে বসেছে বিছানায়।
-হ্যাঁ রে পাগল!প্রমিস।
Tags:
মুক্ত গদ্য