পলাশ কুমার পাল



ক্ষীণ আলোয় ফুটপাথ ধরে দীপক ও কুশল গল্প করতে করতে হাঁটতে থাকে। টিপ্ টিপ্ বৃষ্টির দু-একটা ফোঁটা তাদের বেগকে বাড়িয়ে দেয়। দীপক আকাশের দিকে তাকায়। রাজপথের মায়াবী কৃত্রিম আলোয় আকাশের স্পষ্টরূপ বোঝা যায় না। কেবল মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁকে বিদ্যুতের ঝিলিক অস্পষ্টভাবে চোখে পরে। রাজপথে ব্যস্ততার গর্জনে মেঘের গর্জন চাপাই রয়।  হঠাত্‍ই অন্যমনস্কতায় দীপক  সামান্য হোঁচট খায়।  শিশির মঞ্চ থেকে নাটক দেখে বের হবার পর মনটা এমনিই উত্‍ফুল্ল ছিল। প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে দীপক কোনোদিন এত বড় মঞ্চে নাটক দেখেনি। তাই তার মনে একটা আনন্দের রেশ বহে যাচ্ছিল। এর জন্য সে মনে মনে তার বন্ধু কুশলকে ধন্যবাদ জানায়। কুশল শহরে না থাকলে তার রাতে থাকা এবং এই নাটক দেখা হয়তো হত না।

এ.জি.সি. বোস রোড থেকে বামদিকে ঘুরে জহরলাল নেহেরু রোডের ফুটপাথে উঠতেই দীপক বলে,"কিরে, মেসে ফিরবি না?"
কুশল পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করতে করতে বলে,"যাব তো! আগে একটু ঘুরি। তারপর ময়দান থেকে মেট্রো ধরব।"
দীপক আর কিছু বলে না। কারণ সে কলকাতার রাস্তাঘাট সঠিক চেনে না। এখন আর বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পরছে না। তাছাড়া ঘুরতে তার ভালোই লাগে। রাত্রিতে প্রায় ফাঁকা ফুটপাথ এবং কৃত্রিম আলোয় সজ্জিত জনবহুল শহরের রূপটা দেখার আগ্রহ তো ছিলই। ফুটপাথে মানুষ দেখা না গেলেও অনেক দোকানে কাঁচের আড়ালে ঝাঁ-চকচকে দ্রব্যাদির ইশারা নাড়া দিচ্ছিল। কিন্তু পকেটের অন্ধত্ব সেই আলোগুলির কাছে প্রহসন মাত্র।

ইচ্ছাকে তাই বিদায় জানিয়ে , দু'জন রাত্রিতে মেসে কী রান্না করে খাবে? -এই কথোপকথনের সঙ্গে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল ময়দানের দিকে। দীপক দেখল ফুটপাথের ধারে একটি অসহায় বয়স্কা মহিলা। তার পরনে একটি ময়লা চামটানি নাইটি, যার কোনো কোনো অংশ ছেঁড়া। সেই বয়স্কাটি রাস্তায় পরে থাকা একটি প্লাস্টিকের গ্লাস কুড়িয়ে রাস্তারই একটি এবড়ো-খেবড়ো অংশে জমা জল গ্লাসটিতে ভরে পান করতে উদ্যোত হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে দীপকের মনের উত্‍ফুল্লতা কোথায় হারিয়ে গেল। চরম বাস্তবের জীবন্ত ছবিটি দেখে সে শিউরে উঠল। দীপকের কী করণীয় সেটা না বুঝে কুশলকে ইশারা করে,"দেখ!দেখ!" কুশল ঘুরে দেখবার আগেই তারা দু'জনে ঐ মহিলাটিকে অতিক্রম করে কিছুটা এগিয়ে যায়।

এগিয়ে গিয়েও দীপক দাঁড়িয়ে যায়। আজও সভ্যতার বুকে কিছু মানুষ অন্ধকারেই রয়।  শহর সেজে ওঠে দীর্ঘাকায় বাড়ি, ঝাঁ-চকচকে দোকান, বিজ্ঞাপনে। গাড়ি ছুটে যায়, মানুষও ছোটে... ফিরে তাকানোর সময়ও কারোর নেই। দীপক গ্রামের ছেলে হলেও শহরের একটা অমানবিক স্রোত চোরাপথে মনকে দূর্বল করে তুলেছিল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। এই অসহায় মানুষগুলির অন্ধকর দূর করবে কে? প্রশ্নের আয়নাটি নিজের দিকে ঘোরালেও নির্বাক এক অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না সে। বুঝদার শিক্ষিত ছেলে হলেও তার মধ্যে একটা আড়ষ্টতা কাজ করতে থাকে। তাই সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে কেবল দেখে।

একঘোঁট জল খাওয়ার পর আবারও যখন সেই বয়স্কাটি সেই প্লাস্টিকের গ্লাসে করে নোংরা জল তুলতে যায়, ঠিক তখনই দু'জন বিদেশিনী সেই বয়স্কাটির কাছে নীচু হয়ে তাদের হাতের জলের বোতল এগিয়ে দেয় এবং কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বয়স্কাটি নিজের খেয়ালেই থাকে। হয়তো তাদের ভাষা বুঝতে পারে না- হয়তো সে সেই কথা শ্রবণে অসহায়- বা বুঝেও বোঝ হয়ে মানবধর্মকে কলঙ্কিত না করে অবুঝ থাকাকেই শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছে।

বিদেশিনী দুটি ব্যর্থ প্রয়াসে ভঙ্গ মনে সেই বৃদ্ধার হাতে স্বল্প কিছু অর্থ গুঁজে দিয়ে এবং তাদের সেই জলের বোতল একপাশে রেখে চলে যায়। আলাদা ভাষার মানুষ হলেও তাদের এই কাজ মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয়। যে কাজটি তারা দু'জনে না করে বয়স্কাটিকে এড়িয়ে চলে এসেছে, সেই কাজটি সেই মহিলাদুটি করল। দীপক বুঝল জীবনে সত্যিকারের আলোর সন্ধান করতে গেলে এই অন্ধকারগুলিকে দূর করে এদের আলোয় আনতে হবে, এদের জীবন দিতে হবে। 

তবে বয়স্কাটি ঐ অর্থ বা বোতলের প্রতি অনাগ্রহী হয়েই রইল। তার কাছে টাকার কোনো মূল্যই নেই। তবু সেই অন্ধকারে সভ্যতার সাজানো অসভ্য মানুষটি ল্যাম্পপোস্টের নীচে ফুটপাথ জুড়ে বসে একপাহাড় অন্ধকার নিয়ে। জনস্রোত চলে যায় না দেখার ভাঙে। আলোর দেখা মেলে না এদের জীবনে। অথচ এই মানুষগুলিই আজও মানুষের ঔজ্বল্যতার স্বরূপ ধূপের মতো পুড়তে পুড়তে।

"কিরে, দাঁড়িয়ে রইলি যে? আয় না রে! কী দেখছিস বলত! এসব নিত্যদিনের ছবি-" কুশল দীপককে মেসে ফেরার জন্য তাড়া দেয়।
অন্যমনস্কতায় দীপকের কানে সেকথা পৌঁছাল না। বরং কয়েক সেকেণ্ড পর সে বলল,"হ্যাঁ রে, কুশল। আমাদের পাশের গ্রামে জগত্‍ মাস্টার একটা আশ্রম করেছে না?"

"সেরকমই তো শুনেছিলাম। কলেজে প্রফেসরি ছাড়া তাঁর অবিবাহিত জীবনের সংসার বলতে কয়েকটা অনাথ শিশু আর বৃদ্ধা!"
"ওনার ফোন নং জানিস? একবার ফোন করত।" বলে দীপক বয়স্কাটির দিকে এগিয়ে যায়। অন্ধকার ফুটপাথের মধ্যে একটা আলোর পথ সে দেখতে পায়।

বয়স্কাটির গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই বয়স্কাটি একটু সরে গিয়ে তার দিকে তাকায়। জীর্ণ পোশাক এবং রুক্ষ শরীরের মধ্যেও তার দুটি চোখের সত্য রূপ বিদ্যুতের মতো ক্ষণিকে দীপকের মনকে ভরিয়ে তোলে। সৃষ্টিকে সুন্দর করতে আবারও টিপ্ টিপ্ বৃষ্টির নৃত্য হঠাত্‍ই শুরু হয়ে যায়।

পরিচিতি

Previous Post Next Post