শেষ করলাম পূজা মৈত্র সম্পাদিত শারদীয়া দমকা হাওয়া পত্রিকাটি। গল্প পড়ার উপর আমার আগ্রহ চিরন্তন। তাই পড়তে বসলে সময়ের জ্ঞান থাকে না।এক দিনেই শেষ করে ফেললাম পুরো পত্রিকাটি। পত্রিকার প্রথমেই আছে সাহিত্যিক অমর মিত্রের গল্প " বড়ে গুলামের গান"।আধুনিক রূপকথাধর্মী গল্প।সাহিত্যিক অমর মিত্র এই নামটাই যথেষ্ট। পত্রিকায় তার গল্প থাকা মানে বাড়তি আকর্ষণ। পরের গল্প নির্মল চন্দ্র পাঠকের "এক ধর্ষণ কথা"। খুব পরিচিত একটা প্লট হলেও গল্পটা বেশ টেনেছে আমায়,পরের গল্পের মতামত অন্য পাঠকেরা দেবে। ওটা আমার লেখা গল্প "ট্যাক্সি চালকের উপাখ্যান"।

অঞ্জন আচার্যের "স্মৃতি ভেজা এক দীর্ঘশ্বাসের গল্প"টিকে আমার রম্যরচনা বলে একেবারেই মনে হয়নি। বরং এটি একটা বেদনাবিধুর গল্প।গল্প বলায় লেখকের এক সহজাত দক্ষতা আছে। যার ফলে গল্পের মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাহিত্য রস জারিত করেছেন লেখক। তবে তার জন্য এটা রম্যরচনা কোনভাবেই নয়। সব মিলিয়ে গল্প বিভাগটিকে "ভাল"-র বেশি কোন শব্দে অভিহিত করা গেল না। তবে পত্রিকাটির মান কেমন সেটা বলতে গেলে কেবল ''ভাল'' এই শব্দটা কোনোভাবেই প্রয়োগ করা যাবে না কারণ এখানে এমন একজনের লেখা আছে যিনি একাই একটি পত্রিকার উৎকর্ষতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।তিনি আর কেউ নন পত্রিকার সম্পাদক পূজা মৈত্র। তার লেখা উপন্যাস "কিস্তিমাত" পত্রিকার অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কখন যেন নিজের অজান্তেই চরিত্রগুলির সাথে একাত্ম হয়ে গেছি। গল্পের প্লট, চরিত্র স্রিষ্টি,সংলাপ রচনার দক্ষতা,নাটকীয়তা,সব কিছুতেই লেখক চরম মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। শুধুমাত্র এই উপন্যাসটির জন্যই পত্রিকাটি কিনে পড়া যায়। এক্ষেত্রে অধিনায়কের মতই পূজা মৈত্র সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
পত্রিকার শেষে মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার টি বেশ আকর্ষণীয়। অনেক অজানা তথ্য জানা গেল মলয়বাবুর সম্পর্কে।বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের করা উত্তরপুরুষ উপন্যাসের গ্রন্থ সমালোচনাটি বেশ সাহিত্য গুণ সম্পন্ন।ঠিকভাবে লিখতে পারলে গ্রন্থ সমালোচনাও অনেক সময় পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখে। দমকা হাওয়ার প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণ খুব-ই উচ্চ মানের,পাতার মান খুব ভাল তবে প্রিন্ট অফসেটে হলে ভাল হত। সব মিলিয়ে দমকা হাওয়া ভাল লেগেছে। পরবর্তী সংখ্যায় এর থেকেও ভাল কিছুর প্রত্যাশা করি। দমকা হাওয়া কিনতে চাইলে সম্পাদককে কল করতে পারেন-৯৩৩৩৪১৪৩৭৩ নাম্বার-এ।

" অযোধ্যায় ফিরলেন রামরাও
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেম আমরাও।
এবার তোমরা যারা
মাস শেষে গদি হারা
ঘরে বসে হাত পা কামড়াও। "
লিমেরিক নিয়ে পার্থ সারথি সরকারের সুন্দর একটি প্রবন্ধ - বাঙালির লিমেরিক চর্চা একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পড়লাম সৃজন পত্রিকায়।
অপর একটি প্রবন্ধ শ্যামসুন্দর রায়ের লেখা ' বিবেক শ্রদ্ধায় রবি মন' তথ্যসমৃদ্ধ, গবেষণাধর্মী। প্রবন্ধকার লিখেছেন - 'রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১), বিবেকানন্দ (১৮৬৩) প্রায় একই সময় ফোটা দুটি পারিজাত। দুজনেই স্ব স্ব প্রতিভার জন্য হৃদয় রাজ্যের রাজা হয়ে আছেন। .... অনেকের ধারণা রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের মত মহান পুরুষটির জন্য কোন প্রবন্ধ রচনা করেননি। এর কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করেন বিবেকানন্দের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর অশ্রদ্ধা। এটাই নাকি বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের দূরত্বের প্রথম ও প্রধান কারণ। বিবেকানন্দের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কতটা শ্রদ্ধা ছিল সেটা জানানোর জন্যই এই প্রবন্ধের সৃষ্টি। বিভিন্ন ঘটনাবলী উল্লেখ করে নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন প্রবন্ধকার। রোঁমা রোঁলাকে বলা রবীন্দ্রনাথের উক্তির মধ্যে দিয়েই বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর কতটা শ্রদ্ধা আর তাদের মধ্যে কতটা হৃদ্যতা ছিল,তা প্রকাশ পায় - "তুমি যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। " আলোচনার সমাপ্তি টেনেছেন শুভ দাসগুপ্তের একটি নাট্যকল্পের উদ্ধৃতি দিয়ে - ' শিউলি আর কাশফুল দুটোই শরতে ফোটে। কিন্তু তারা আলাদা বলেই আলাদা করে মানুষের কাছে ভালবাসা পায়। দুজনে আলাদা হয়েও শরতের চিহ্ন হয়ে ফুটে ওঠে। যার যত পথ,তার তত মত। '
এর পরের প্রবন্ধটি সুমন্ত চ্যাটার্জীর। কবিতা ও গানের মধ্যে যে সম্পর্ক, তার একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন প্রবন্ধকার। প্রবন্ধের শুরুতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উক্তি মন ছুঁয়ে যায়। ' প্রত্যেকটি ঝরে যাওয়া ভালবাসার জায়গায় আবার তেমন করে একটি ভালবাসা জন্মায়। আমরা মানুষ, গাছ পাথরের মত সীমাবদ্ধ নই।... তাই আমাদের ভালবাসা যখন মরে যাবে, অন্য মানুষ তখন ভালবাসবে। আমাদের প্রেম ব্যর্থ হবে না।'
কবি জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থ ও তার কবিতার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন প্রবন্ধকার কৌশিক কুমার দত্ত তার ' সকল লোকের মাঝে বসে একা,একটি নক্ষত্র আসে ' প্রবন্ধটিতে। সব মিলিয়ে প্রবন্ধ বিভাগটি ভীষণ ভাল লাগল। প্রতিটি প্রবন্ধই স্বকীয় বিশিষ্টতায় ভাস্বর।
মাঝে এসেছে কবিতা বিভাগ। ভাল লেগেছে শর্মিষ্ঠা ঘোষ, সর্ভানু দাশগুপ্ত,বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়, নবকুমার পোদ্দার আর সঞ্জয় সোমের কবিতা।
গল্প বিভাগের প্রথমেই আইভি চট্টোপাধ্যায়ের ' ফিক্সড প্রাইস ' গল্পটি চমকপ্রদ। দীপকবাবুর বাপ-ঠাকুরদার আমলের ছাপোষা কল্পতরু ভান্ডার, ধুতিশাড়ি, গামছার দোকান থেকে কিভাবে ফিক্সড প্রাইসের ঝাঁ চকচকে 'কল্পতরু রেডিমেড সেন্টার' হয়ে উঠল, গল্পটিতে সেই কাহিনীই তুলে ধরেছেন লেখক। তবু জীবনের শেষে দীপকবাবু অনুভব করলেন কিভাবে ফিক্সড প্রাইসের হিসেব মেটাতে মেটাতে জীবনের অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছেন। আবার কি তিনি পুরোন কল্পতরুকে ফিরে পাবেন? এই জীবনে বড্ড প্রাইস দেওয়া হয়ে গেছে। ভাল লেগেছে শঙ্করনাথ প্রামাণিকের 'আশীর্বাদ' গল্পটি। শাসন একজন কিশোরকে সঠিক পথে চলার শিক্ষা দেয়। মাষ্টারমশাই সুধীরবাবুর ছড়ির ঘা রমেশের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে। গল্পের শেষে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে রমেশের উক্তি - 'আমাকে ওইভাবে না মারলে আজ আর আমি ডাক্তার হতে পারতাম না স্যার।'
সঞ্জয় মিত্রর 'মিমিও' গল্পটি কাল্পনিক। ঘটনার সময়কাল দেখানো হয়েছে দু হাজার পঞ্চাশ সাল। এক সেন্টিমিটার সাইজের ছোট্ট কার্ডটির নাম মিমিও। এটা দু আংগুলের ফাঁকে রেখে কারোর গায়ে ছোঁয়ালেই প্রতি সেকেন্ডে তার চিন্তার গতি বিধির ওপর নজর রাখা যায়। কল্পনার ওপর ভিত্তি করে গল্পটি নির্মিত হলেও কাহিনীর গতিকে কখনো স্তব্ধ করেনি। বরং গল্প বলার দক্ষতা ও সূক্ষ্ম রসবোধে গল্পটি চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে।
ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য রুমকি রায় দত্তের 'বেতলার পথে লোধ' মনোগ্রাহী এক লেখনী।
পত্রিকার শেষে বেশ কিছু গ্রন্থ সমালোচনা রয়েছে। সেখানে আমার লেখা 'দুই মুখ' উপন্যাসটির গ্রন্থ সমালোচনা করেছেন সাহিত্যিক অরুণ চট্টোপাধ্যায়। পূজা মৈত্রের 'উত্তর পুরুষ' উপন্যাস ও দেবাশিস লাহার 'ঢেউ' গল্প সংকলনটির তুলনামূলক আলোচনা করেছি আমি।
পত্রিকার মাঝে সম্পাদক মধুসূদন রায়ের নেওয়া সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকারটি পত্রিকার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করেছে। ওঁর সাক্ষাৎকারের যে লাইনটি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে,সেটা দিলাম - " তোমরা খুব কষ্ট করে সৃজন বের করছ। সকলের সেটা বোঝা উচিৎ। ফ্রি কপি দেওয়া বন্ধ কর আর পাঠকদের জন্য বলব সৃজন একটা অসাধারণ পত্রিকা। সবাই কিনে পড়ুন। সহজে বা বিনে পয়সায় কিছু পেলে মানুষ তার গুরুত্ব বোঝে না। "
এরপর আর কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
Tags:
প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ