মৃন্ময় ভৌমিক



ঘনা দা চীনেমাটির পাত্র, টব,ফুলদানি, চটো মূর্তি নিয়ে ফেরি করতে আসে আমাদের শহরের অলিগলিতে সুদূর কৃষ্ণনগরের হরিণডাঙা থেকে।  শহুরে সৌখিন আবাসন গুলিতে বেস ভালো দামেই বিক্র হয়ে। সেদিন ঘনা দা ঘুরতে ঘুরতে হাজির আমাদের পাড়াতেও।  সপ্তাহের কদিনই দেখা পাই এখানে, বাকি দিন গুলি নাকি শহরের আরও অনেক পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় সে তার পসরা নিয়ে। তার ঝুরি দিকে হঠাৎ চোখ যেতেই দেখি একটি বাস্ট।  আড়াই ইঞ্চির লম্বা- শাড়ি পড়া বাংলার রমণীদের যেমন পুতুল পাওয়া যেত ঠিক তেমনি।  ঐ  বাস্ট আমাকে মুহুর্তে মনে করিয়ে দিলো সেই সোভিয়েত ইউনিয়ান জুড়ে থাকা সেই স্তালিন, লেলিন মুর্তি যার গলায় দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নামানো শুরু হোল।  মুহুর্তে ভেঙে টুকরো টুকরো চীনে মাটির পুতুল। আর সেখান থেকে একটি টুকরো ছিট্‌কে এসে পড়লো পুরো ইউরোপ ঘুরে আমাদের শিবপুর। আচ্ছা, সত্যজিৎ রায় কি আগে থেকে জানতেন মূর্তি ভাঙার কথা ? 

আশে পাসের কিছু বোদ্ধা দাড়ি চুলকে, মাথা নেরে, চশমা তুলে বললেন – ‘আমরা তো আগেই জানাই মাক্সসিজেম আর কোন ভবিষ্যৎ নেই। বোঝ সকলের জ্যোতিষী।  আগে যদি জানতেন তবে এটা বুঝছেন না যে আমাদের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে।  হঠাৎ কিছু মানুষ সমাজের মুক্তির চেতনা কে তোল্লাই দিয়ে ধনতান্ত্রিক ইউরোপ ও মার্কিন জোট সেখানকার সাধারণ শ্রমিক, আঁখ চাষিদের উপর অত্যাচার চালালো।  কত গরীব মেয়েদের ইচ্ছা মতো টেনে নিলো যৌনতার লোভে।  সমগ্র বিশ্ববাসী সাদ পেল মার্কিনী ধনতন্ত্রের। 

ঠিক তার কয়েক দশক পর একই ভাবে ইরাকে সদ্দাম হোসেনের  মূর্তির রূপ দেখা গোটা পৃথিবী।  ইরাকে নাকি অত্যাচারিত শাসনের অবসান ঘটে মাথ চারাদিলো সার্বভৌম স্বাধীনতা।  বিশ্বে আবার প্রমাণিত হল মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপই একমাত্র দেশ দশের এবং পৃথিবীর রক্ষাকর্তা। এই ধনতান্ত্রিক শক্তি ছাড়া আর গতি নেই। 

তারপর ইরাকে মাস খানেক ধরে নির্বিচারে চললো লুন্ঠন রাজ সমগ্র পুরাতন মিজিয়াম গুলিকে কে খালি করে সেখানে রাখা হল খুনি গুলিদের, সমস্ত ধন সম্পদ চুরি করে নেওয়া হল।  এই সকল ছবি 



তুলে রাখনি কোন সংবাদমাধ্যম।  সায়গানের জেল খানায় মার্কিন সৈন্যদের সাধারণ মানুষদের উপর কি অত্যাচার চাকিয়েছে, আলজেরিয়ার দ্য  গল – এর সৈনিকরা যে পুরো লাতিন আমেরিকা জুড়ে কি আমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে তার কথা কত জনই বা জানে। অর্থাৎ এই ফ্রান্স এবং মার্কিনরাই মুক্তির প্রতীক।  জজ বুশ বা দ্য গল এর মুর্তি কিংবা কলকাতার ভিক্টোরিয়ার মুর্তি কখনো ভাঙা হয়নি বলে এরা র‍য়ে গেলেন মুক্তি দাতা হিসাবে।  মুর্তি ওপড়ানোর কারণ থাকা সত্ত্বেও।

ভ্যাটিকানের আপাদমস্তক ফ্যাসিস রোমান ক্যাথলিকরা পাকা নাৎসিক দের  দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ানের শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের আর্জেন্টিনা,কলোম্বিয়া, বলভিয়া পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু ভ্যাটিকানদের কোন মূর্তি না থাকায় বেঁচে গেলেন।  লেলিনের মূর্তির আওয়াজ শুনেছি আমরা অনেক, তার একটুরো বাস্ট আজও ছিটকে আসে আমার শহরে কিন্তু মানুষ আর বুঝলো কই? এখনো সেই হলিউডের মিথ্যা সকল লড়াই লড়াই খেলায় তো আমরা মেতে। সেদিনের সেই লেলিনের মূর্তির ভেঙে যাওয়ার আগের মুহুর্তের ছবি আজও আমাদের জালান দেয় দেশের সমাজতন্ত্রের মৃত্যুর এবং পূর্ব ইউরোপ ও মার্কিন ধনতন্ত্র বাদের বিভৎস রূপের। এখনো সময় আছে আমাদের দেশের সংস্কৃতি, সভ্যতার ভিত্তি ভূমি সমাজন্ত্রকে বাঁচাতে আজও এই লেলিনের মূর্তি ভেঙে যাওয়া অথাৎ সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার আগের মুহুর্তের ছবিটি আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক যতটা সেদিন ছিল।




Previous Post Next Post