আজকে শিলিগুড়ি তে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। সকালে আজকে তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে হবে টেস্ট চলছে ক্লাস টুয়েলভের। এদিকে আজকেই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল মল্লারের। না ঘড়ীটা একবার দোকানে দেখাতেই হবে। আর মোবাইলও সুইছ-অফ করে চার্জে। আর কি উঠেই রুদ্ধশ্বাসে রেডি হওয়া স্কুলের জন্য। সাত সকালে স্কুল যাবার আগে একবার খবরের কাগজে চোখ বলানো স্বভাব মল্লারের। নিজের মনেই বলল “নাহ্ আজ আর আরাম করে কাগজ পড়া কপালে নাই ” বলেই ছুটল বাসস্ট্যান্ড। আর কি অনেক যুদ্ধ করে শেষ প্রান্তে জানলার ধারের সীট টা আদায় করা গেলো। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা দিয়ে সোনা গলে পরছে।
খবর পড়তে পড়তে হঠাৎ করে প্রথম পাতার শেষের দিকের খবর টা পড়ে আঁতকে উঠল মল্লার। “মেদিনীপুরে ডাইনি সন্দেহে গণপিটুনি তে গৃহবধূ গুরুতর আহত” পড়তে পড়তে মল্লারের মনে যেন কিসের স্মৃতি ভেসে উঠল। জানলার দিকে চা বাগানের পিছনের দিকে চলে যাওয়া দেখতে দেখতে যেন সেই ১৭ বছর আগে পৌঁছে গেলো মল্লার। সেই বাবার পড়ার টেবিলে পরীক্ষার খাতা দেখার সময় বাবাকে করা তার প্রশ্ন, যার উত্তরে বাবাও নিরুত্তর হয়ে বলেছিলেন, “তোর প্রশ্নের উত্তর আমার যানা নেই রে বাবাই, বড় হলে নিজেই খুঁজে দেখিস হয়তো উত্তর পেয়ে যাবি”। সেই ছোট্ট দুটো প্রশ্ন “বাবা ওরা ডাইনি বুড়ি কে অভাবে মারছে কেন?” “বাবা ও বাবা ডাইনি বুড়িও তো আমাদের মতো মানুষ, তাহলে ও ডাইনি হল কি করে?” বাবা খালি সেদিন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল মল্লারের দিকে - চোখে এক রাশ যন্ত্রণা নিয়ে, বোধয় প্রতীবাদ না করতে পারার যন্ত্রণা।
মল্লারদের বাড়ির পিছনে যে রেলের মাঠ ছিল, তার শেষে প্লাস্টিকের নারকেল, সুপুরির খোলের তৈরি ঝুপড়ি তে থাকো ডাইনি বুড়ি, সবাই ওর পিছনে লাগতো ডাইনি বুড়ি, ডাইনি বুড়ি বলে খেপাত, মা কতবার ভিক্ষে চাইতে আসার জন্য শাপ শাপান্তর করেছে। সবারই বধ্যমুল ধারনা ছিল ডাইনি বুড়ির ছায়াও যে মারাবে তার ক্ষতি অবধারিত। মল্লার তো ডাইনি বুড়ির ভয়ে প্রত্যেক বার পরীক্ষার রেসাল্টের দিন খুব সাবধানে স্কুলে যেতো। পাছে ডাইনি বুড়ির ছায়া পড়ে যায় গায়ে তালে কি হবে। এবাবা নিশ্চিত ফেল। কিন্তু সেদিন কেন জানিনা ডাইনি বুড়ি কে অভাবে মার খেতে দেখে, ছোট্ট মল্লারের মনের ভয় রাগ কেমন যেন করুণায় বদলে গেছিলো।
এরকম করে মল্লারের জীবন চলতে লাগলো, এদিকে রেলের মাঠে শীতকালের মেলা বসলো বিশাল মেলা, কত কি এসেছিলো সে মেলায়, নাগরদোলা, টয় ট্রেন, ঘোড়ার গাড়ি, আরও কত কি। মল্লার রোজই বাবাকে বলে নিয়ে যেতে বাবার কিছুতেই সময় হয় না। এদিকে কতদিনের শখ মল্লারের নাগরদোলাতে চরার। আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের সাথে নাগরদোলা চরবেই সে। যদিও আজকে স্কুল থেকে ফেরার পথে বার-বারই তার মনে হয়েছে, কে যেন সবসময় লক্ষ্য রাখছে তার ওপর। কিন্তু নাগরদোলা চরার নেশায় সব ভয়ই সে মন থেকে দুর করে দিলো সেদিন। আর কি যেমন ভাবা তেমনি কাজ। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে সোজা রেলের মাঠ আর বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ করে নাগরদোলা। কিন্তু মল্লারের নাগরদোলার সেফটি প্লেটের পেরেক সবার অলক্ষ্যে আলগাই থেকে গেছিল। আর এর ফলে হল চরম দুর্ঘটনা। নাগরদোলা থেকে ছিটকে পরল মল্লার। নেহাত কাঠের নাগরদোলা তাই কম উঁচু, কিন্তু মল্লারের চোট গুরুতরই ছিল। সবাই ধরা ধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। খবর দেওয়া হল মল্লারের বাবা মা কে। ডাক্তার বাবু বললেন “রক্ত যোগার করুন এখুনি, আমাদের হাতে সময় খুব কম, এখুনি রক্ত লাগবে ও নেগেটিভ, বড্ড রেয়ার ব্লাড গ্রুপ মল্লারের” আর কি ছুটল বাবা আর তার কজন বন্ধু ছুটলেন সদর হাসপাতালে রক্তের খোঁজে, ওখানে উপস্থিত অনেকেরই রক্ত নেওয়া হল কিন্তু মল্লারের সঙ্গে কারুর রক্তই মিলল না। অনেক খোজা খুঁজির পর যেন কার সঙ্গে একটা মিলে গেলো মল্লারের সঙ্গে। অনেক কষ্টে মল্লারের বাবা এক বোতল রক্ত নিয়ে শুনলেন অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। উৎকণ্ঠার ঘণ্টা খানেকের পর ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এসে বললেন- “ মল্লার ভালো আছে।” সবাই ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ দিতে গেলে তিনি বাধাদিয়ে বললেন । “ আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না ,এনাকে দিন, ইনিই দু বোতল রক্ত দিয়েছেন ওকে, ঠিক সময় মতো রক্ত না পেলে কি হত বলা যায় না।” সবাই দেখল গুটি গুটি পায়ে একজন এগিয়ে এলেন। কিন্তু সবার সামনে আসতেই, সবাই আঁতকে উঠল – “আরে এ তো সেই ডাইনি টা ” সবাই হা রে রে রে রে করে উঠতেই মল্লারের বাবা ধমকের গলায় সবাই কে থামিয়ে ওনাকে বাইরে বের করে নিয়ে গেলেন।
এরপর মল্লারের জ্ঞান ফিরতেই হাসপাতালে বাবাকে ওর কাছে ডেকে কানে কানে বলল মল্লার। “ জানো বাবা আমি না কালকে রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখলাম, সেই ডাইনিটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল জানো, ঠিক মায়ের মতো করে আদর করলো কতক্ষন জানো ? জানো... ” বলতে বলতে আবার দুর্বল শরীরে ঘুমিয়ে পড়লো সে। যা হোক সেই ঘটনার একমাস কেটে গেছে মল্লার এখন সুস্থ, আবার মল্লারের বাঁদরামো সেই পুরনো ফর্মে শুরু হয়ে গেলো। রোববার দিন বাবার সঙ্গে বাজারে যেতে গিয়ে, রেলের মাঠ পার হবার সময় মল্লার দেখল সেই ডাইনি বুড়ি, দুরের ঝুপড়ি থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মল্লার বাবাকে বলল “বাবা ওই দেখ ডাইনি বুড়ি” মল্লারের বাবা সেদিন মল্লার কে বলেছিলেন “ছি বাবাই এরকম বলে না, ওনাকে ডাইনি বুড়ি বলতে নেই” সেই থেকে মল্লার মনে মনে ডাইনি বুড়ি কে “ডাইনি - মা” বলেছিল।
হঠাৎ সম্বিত ফিরল মল্লারের, কন্ডাক্টারের মুখে ময়নাগুরি ময়নাগুরি,ও দাদা নামুন নামুন চিল চিৎকার শুনে। স্কুলে যেতে যেতে কুয়াশার মধ্যে সূর্যটার লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে একটাই কথা বলল সে “ভগবান আমাদের মনের কুয়াশাগুলোকে সরিয়ে এবার তো সূর্য ওঠাও। নাহলে যে ................................”
Tags:
আত্মকথা