ইফতেখারুল হক



বেশকিছু দিন থেকে মিনহাজ লক্ষ্য করছে মিসেস রুবি খন্দকার মেয়ের পড়ার টেবিলের পাশে এসে বসে ওর সাথে টুকটাক গল্প করছে । মিনহাজ রুদ্রা কে পড়াচ্ছে আজ দুই বছর । ইংরেজি মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড টু এ পড়ে ও । মিনহাজ এরই মধ্যে রুদ্রা এবং ওর মায়ের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে । মিনহাজের ভাল লাগে বিষয়টি । বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে অনেক ঘুরাঘুরি করেছে একটা চাকরির জন্যে কিন্তু পায়নি । যেখানেই যায় যোগ্যতার চেয়ে অন্য কিছু চায় সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো । মিনহাজ প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট পেত কিন্তু এখন আর পায়না । রুবি খন্দকার চাকরির ব্যাপারে মিনহাজকে সহযোগিতা করতে চায় কিন্তু ও রাজি হয়না । কেন রাজি হয়না মিনহাজ তাকে বোঝায় । রুবিও বুঝতে পারে মিনহাজকে । কিন্তু রুবি যখন নিজের জীবন নিয়ে ভাবে, কিছুতেই বুঝে ওঠতে পারেনা সে । বরং না বোঝার আক্ষেপটাই বারবার তাড়িত করে ওকে ।

রুবির কাছে আজ সবকিছুই আছে তবুও অনেক কিছুই নেই ! সেই নেই এর গল্প করতে করতে রুবি খন্দকার একসময় মিনহাজের বেশ কাছে চলে যায় । মিনহাজ বাধা দেয় কিন্তু রুবি খন্দকারের ভেতরের শূন্যতা মিনহাজকে ছুঁয়ে যায় । আজ রবিবার মাসের শেষদিন । মিনহাজ প্রতিদিনের মতোই পড়াতে যায় রুদ্রাকে । আজ টিউশানির টাকা হাতে পেলেই রুদ্রাকে দুইদিনের ছুটি দিয়ে একবার গ্রামে যাবার কথা ভাবে ও ।

কলিং বেল চাপতেই দরজা খোলে রুবি খন্দকার নিজেই ।  একটু অবাক হয় মিনহাজ ।  বলে- ‘‘আরে আপনি ? কখনো দেখা যায়নি যে আপনি নিজে এসে দরজা খুলেছেন’’ ।  ‘হ্যাঁ খুললাম-বলেই রুবি বলে ওঠে আজতো রুদ্রা বাসায় নেই ।  মামা বাড়ি গেছে ।  সঙ্গে রাহেলাকেও পাঠিয়েছি ।  আজ আর ওরা ফিরবেনা’ । ‘‘তাহলে আমি আসি’’ ? মিনহাজ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রুবি খন্দকার বলে ওঠে- ‘কেন ? আসুন না ভেতরে । যাবার সময়তো পড়েই আছে’ ।  মিনহাজ না করতে পারেনা ।  ভেতরে যাবার সময় একবার চারপাশটা দেখে নেয়ার চেষ্টা করে ।  মিনহাজকে সরাসরি ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে রুবি ভেতরে গিয়ে ফিরে আসে একটা সাদা খাম নিয়ে ।

ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি দুজনে ।  সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ ।  টেবিলে রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে কাটতে থাকে রুবি খন্দকার ।  চেয়ে থাকে মিনহাজ ।  রুবি বলে- ‘‘জানেন মিনহাজ, এই আপেলের মতোই প্রতিনিয়ত আমাকে কেউ কাটে, কিছু কাটে । ফালি ফালি করে আর আমি রক্তাক্ত হৃদয়ে প্রায়ই মধ্য রাতে যখন ছাদে গিয়ে কাটা চাঁদটাকে দেখি তখন ভেতরের যন্ত্রণা একটু একটু করে ভুলতে থাকি ।  একসময় আন্দোলিত মনটা যখন শান্ত হয় আলো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, আর ঘুমোতে যাই; মনে হয় দ্বিতীয় জন্মের আগে প্রথম মৃত্যুটাকে ছুঁয়ে এলাম’’ ! নিজের সাথে নিজেই কিছু সময় যুদ্ধ করি ।  এবং আশ্চর্যের হলেও সত্যি যে ভুলেও যাই ! বলেই হেসে ওঠে রুবি ।  বেশ সাবলীল ভাবেই বলে যায় রুবি কোনরকম জড়তা ছাড়া ।  মিনহাজ বুঝে ওঠতে পারেনা রুবি ঠিক কী বলতে চায়ছে । তবে ওর বলবার স্টাইলে মিনহাজ মুগ্ধ হয় । তবুও বুঝবার চেষ্টা করে একটু গভীরে যেতে চায় ।

রুবির সাথে সম্পর্কটা এখন এমন যে মিনহাজ চাইলেই রুবির গভীরে ঢুকে খনন করে আনতে পারে মণিমাণিক্য অথবা তামাটে কোনকিছু । দাঁড় করিয়ে দিতে পারে দ্বিধা দ্বন্দ্বের মুখোমুখি ।  রুবিও সেটা জানে ।  আর জানে বলেই মিনহাজের কথাও মানে ।  তবুও মিনহাজ অপেক্ষা করে বিশেষ পরিস্থিতির জন্য, অপেক্ষাকৃত সহনশীল মুহূর্তের জন্য ।

রুবি খন্দকার বয়স আনুমানিক ত্রিশ একত্রিশ ।  কম বেশীও হতে পারে ।  সুন্দরী, কোমল এক সন্তানের মা যার পেরিয়ে গেছে আট বছরের দাম্পত্য জীবন; কিন্তু পেরোতে পারেনি এমন কিছু অন্ধকার ও তার ছায়া উচ্চশিক্ষিত হয়েও,যেসব পেরিয়ে যাবার ক্ষমতা আজো কোন বাঙালী নারী পায়নি ।  দেখা পায়নি আলো আজো, যদিও আলোতে আলোতে পূর্ণ তার চারপাশ !

কিন্তু এ কেমন আলো ? যার রশ্মি শুধুই পোড়ায় আগুন হয়ে কিন্তু কোন সৌন্দর্য বহন করেনা ! ‘বলতে পারেন বাসর রাতেই আমি স্বামী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হই । তারপর থেকে চলছেই... এবং আরো অনেক কিছু’ ।  নীরবতা ভাঙে মুহূর্তের ।  বলতে বলতে রুবি খন্দকার হেসে ওঠে ।  আশ্চর্য হয় মিনহাজ ! কারণ এইসব অসহায় পরিস্থিতিতে বাঙালী নারীদের একমাত্র আশ্রয় চোখের জল যার রয়েছে বহুমাত্রিক কার্যকারিতা ।  কিন্তু এখানে রুবি একটু অন্যরকম ।  কিন্তু কেন ? প্রশ্ন করেনা মিনহাজ । নিজে নিজেই উত্তর বের করার চেষ্টা করে । হয়তো পেয়েও যায় । রুবিও একটু অবাক হয় মিনহাজের এমন কৌতূহলহীনতায় । তবে সেও কোন কিছু জিজ্ঞেস করেনা এই ব্যাপারে । 

রুবি ডানপাশের দুটি চেয়ার ডিঙিয়ে মিনহাজের ঠিক পাশে রাখা চেয়ারে এসে পায়ের উপর পা তুলে বসে । অদ্ভুত একটা মাদকতা যেন উড়ে এসে মিনহাজের সমস্ত গায়ে মিশে গেছে ।  অদ্ভুত একটা সুগন্ধ রুবির সারা শরীরে ।  একটুও মনে হয়না এত ক্লান্ত সে এত বছর ধরে । এতোটুকুও ভেঙে পড়েনি শরীর । তবে মন যে ভেঙে গেছে কবে তা বুঝতে বাকি নেই মিনহাজের । কিন্তু রুবি ধীরে ধীরে বুঝতে দেয় তা মিনহাজকে । বোঝার প্রশ্রয়ে মিনহাজ ভাবতে থাকে আলোর কথা, ভালবাসার কথা ।  তবে কী আলো নেই, ভালোবাসা নেই আমাদের সম্পর্কে ? যতটুকু আলো যতটুকু ভালোবাসা নিয়ে এক জীবনে পেরিয়ে যাই আমরা আমাদের তৈরি ব্রিজ তা কী ব্রিজের পাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোর মতো ক্ষণস্থায়ী ? প্রয়োজনে জ্বালিয়ে দেই আর মিটে গেলে নিভিয়ে ফেলি ?

আলো নিয়ে আজো আশাবাদী মিনহাজ, আশাবাদী করে তোলে রুবিকেও ।  একদিন আলো আসবে যেকোনো পথ দিয়ে ।  সব অন্ধকার ঘুচে আলোর সূর্য উঁকি দেবে যতদিন মানুষ এই পৃথিবীর, পৃথিবী মানুষের । কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহবাদী মিনহাজ; রুবির মতোই ! তবুও ভালোবাসার আপেক্ষিকতাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারেনা ।  আর পারেনা বলেই দু’জন আজ এত কাছাকাছি একটা ভিন্ন পথ দিয়ে । ভালোবাসার মৌলিকতাকে কে-ইবা অস্বীকার করতে পারে ?  

রাত অনেক হয়েছে, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটায় ।  মিনহাজ এবার বলে- ‘‘উঠি তাহলে ?’’কাল সকালে গ্রামের বাড়ি যাবো ।  এই শহরের আলো বাতাস, মানুষের রূপ,গন্ধ থেকে একটু দূরে থাকতে চাই’’ ।  কথাগুলো শুনে প্রচণ্ড লোভ জাগে রুবি খন্দকারের ।  কিন্তু......।  ইচ্ছে হয়না রুবির মিনহাজকে ছাড়তে কিন্তু এই অন্ধকারে মিনহাজকে আটকে রাখতেও ইচ্ছে করেনা ।  কারণ  এই বাঙলায় কলঙ্কের দায় ঘুরেফিরে নারীরই !         

পরিচিতি 







Previous Post Next Post