ফারহানা খানম


অফিসের কাজ শেষ ফাইলপত্র গুছিয়ে সারা উঠলো। এখনি বের হতে হবে নয়তো বাস মিস হয়ে যাবে ,ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে লিফটে উঠতেই দেখা হয়ে যায় আরিফের সাথে ওর সাথে ওর বউ ও আছে ভাগ্যের কি পরিহাস ওরা তিনজনই একই পথের যাত্রী অথচ ওরা দুজন যাবে এসি গাড়িতে যে গাড়িটিতে করে কিছুদিন আগেও সারা আর তার দুই মেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ।

 সারাকে দেখে আরিফের বউ আর একটু আরিফের কাছে ঘেঁসে এলো আদুরে গলায় বলল -
- এখন কিন্তু বাড়ি ফিরবো না আমরা বাইরে খেয়ে শপিং করে তারপর বাড়ি ফিরবো বুঝলে  ?আরিফ যেন একটু আড়ষ্ট বোধ করলো কেমন বিব্রত স্বরে বলল আচ্ছা আচ্ছা বেশ তাই হবে।
সারা এই আদেখলেপনাটুকুও সহ্য করে নিল টুপ করে গিলে ফেলল  যেন একদলা থুথু।  নির্বিকার চিত্তে  ভাবতে লাগলো মানুষ এতোটা বদলে যায় কি করে?
এক এক  তলা করে লিফট  নিচে নামছে ।  আর সারাও যেন অনুভব করতে পারছে ওকে কোণঠাসা করতে লিরা কত নিচে নেমে গেছে ...এ সেই লিরা যে ওর মেয়েদের টিউটর  ছিল অভাবের সংসার বাবা মা আর স্কুল কলেজে পড়ুয়া দুই ভাই নিয়ে আর পারছিল না।    আর তাই বলে কয়ে আরিফের অফিসেই পোস্ট ক্রিয়েট করে ওর চাকুরীর ব্যাবস্থা করেছিল সারা ।

বাসে বসে সারার দুচোখের জল আঁটকে রাখা কঠিন হল।  সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কিন্তু নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সারা ,এই শেষ বিকেলের নিভন্ত  আলোয় নিজের জীবনের গোধূলির রঙ দেখতে পেল ও ।  দুপুর না গড়াতেই ভর দুপুরে যেন গোধূলি নেমে এল। এখন বাকী রাত আর সন্ধ্যেটুকু কি করে কাটবে ও জানেনা ।  দুটো মেয়ের দায়িত্ব ওর কাঁধে কি করে কি হবে ভেবে থৈ পায়না সে ।

বাস থেকে যখন নামলো তখন সন্ধ্যে  মিলিয়ে গেছে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল দোকান থেকে কিছু জিনিশ কিনতে হবে।  আগে এ দোকানে ঢুকলে কর্মচারিরা বেশ সমীহ দেখাত ,কি চাই বলার সাথে সাথেই হাজির হয়ে যেত।  তখন ও ছিল আরিফের স্ত্রী গাড়িতে চড়ে আসতো এখন আরিফের  সাথে তার সম্পর্ক নেই  থাকে একা দুটো মেয়ে নিয়ে। এই পাড়ায় সবাইত  চেনে ওকে আর সব কিছুই সবাই জানে ।

জিনিশগুলো নিয়ে দাম মিটিয়ে  বের হয়ে এল রাস্তায়।  চলতে চলতে মনে পড়লো , আরিফের স্ত্রী হয়ে যখন আসতো তখন  দোকানের ছেলেটি বলত ম্যাডাম দিন আমি পৌঁছে দিয়ে আসি গাড়ি অব্দি ... ।  সারা প্রতিবাদ করতে গেল ম্যানেজার বলত  ম্যাডাম ওকে দিন আপনার অভ্যেস নেই ...।  কত কিছুইত অভ্যেস ছিল না তবে  এখন হয়ে গেছে  যেমন একা একা পথ চলা ...।

দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাতেই ছোট মেয়ে রিয়া দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল।  প্যাকেট গুলো টেবিলে রেখে সারা সোফায় বসা মাত্রই বড় মেয়ে  জারা এক গ্লাস শরবত মায়ের হাতে দিয়ে পাখাটা চালিয়ে দিল তারপর দুইবোন মায়ের পাশে বসে বলে চলল সারাদিনে কার স্কুলে কি মজার ঘটনা ঘটেছে । জারা এক্নটু চুপচাপ সে দু একটা কথা বলে প্যাকেট গুলো নিয়ে ভেতরে  চলে গেল গুছিয়ে রাখতে ।বুঝতে পেরে সারা চেঁচিয়ে বলল -
- জারা তোমাকে কিছু করতে হবে না ,তুমি পড়তে যাও সালেহাই সব  করবে আর আমিও একটু রেস্ট নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছি ।  এত কিছুর মধ্যে সালেহাই ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে , মেয়েরা যখন স্কুল থেকে ফেরে সালেহা ঠিক তখনই ওদের খাবার গুছিয়ে রাখে ।  মেয়েদের দিকে খেয়াল রাখে খুব।  অবসর সময়ে গল্প করে এ সবই করে ভালোবেসে ।  জারা উত্তর দিল ,মা তুমি রেস্ট  নাও তো বেশী কথা বল না। আমি দেখছি ।  সালেহা খালা অনেক্ষন আগেই এসে গেছে রাতের রান্নাও প্রায় শেষ ।

ফ্রেশ হয়ে  রুমে  আসতে ,সালেহা এসে এক কাপ চা আর একটা স্যান্ডউইচ দিয়ে গেল । ও জানে  স্কুল থেকে ফিরে এটা দুই বোনে মিলে তৈরি করেছে, বিকেলের নাস্তা ।  খেতে বসে সারা ভাবছে যে মেয়েরা জীবনে এক গ্লাস পানি নিজের হাতে নিয়ে খায়নি ,তারা এখন রান্না ঘরের টুকিটাকি কাজও করতে শিখে গেছে , এভাবেই সব অভ্যেস হয়ে যায়।  এটাই জীবনের নির্মম বাস্তবতা ।  পারিনা পারবো না বলে কোন শব্দ জীবনের অভিধানে নেই , পরিস্থিতিতে সব পারতে হয়।  এই মেয়েরা এতোটাই লক্ষ্মী যে এই কষ্ট নিয়ে কখনো অভিযোগও করেনা ।

সারা ভাবছিল  কি সুখের দিন ছিল ওদের,  তখন আরিফ কাজ সেরেই ঘরে ফিরে আসতো ।  মেয়েরা দামী স্কুলে পড়তো , এখন ওই রকম স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য সারার নেই তাই ওরা ভালো তবে সাধারন স্কুলেই পড়ে যেখানে খরচ কম । ভালোবাসা উপচে পড়ছিল যেন, অভাবের কোন  আঁচ লাগেনি সংসারে ।  আরিফের ব্যবসায় উন্নতির পর উন্নতি হতে লাগলো। গ্রামের অনেকেই আসতো চিকিৎসার জন্য, কিংবা দুদিন ঢাকায় বেড়ানোর জন্য।  আরিফ আর সারা মন প্রান দিয়ে সকলের আবদার মেটাত।

এই সারাই তো আরিফের ছোট দুই বোনকে  নিজের  কাছে রেখে মেয়ের মত  মানুষ করেছে বিয়ে দিয়েছে ।  কি সুন্দর সম্পর্ক  ছিল ওদের মাঝে ! এখনো ওরা ঢাকায়  আসে তবে সারার কছে নয় । আসে আরিফের বাসায়।   আসলে  কেউ প্রয়োজন ছাড়া কাওকে বেশীদিন মনে রাখে না।  ওদের কাছে সারার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাই  হয়ত আসে না আর ।  একদিন সারাও ত নিজে সময় পায়না বলে , রিয়া আর জারা কে পড়াতে  লিরাকে নিযুক্ত করেছিল ।  তারপর ওর অভাবের কথা শুনে সারাই একসময় আরিফকে ধরে ওর অফিসে চাকুরীর ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল  লিরাকে আটকাতে।   কারন লিরা  ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট খুব ভালো পড়াত ।

এর কিছুদিন পর সারা বেশ অসুস্থ  হয়ে পড়েছিল বড় একটা অপারেশন করতে হয়েছিল ।  সংসারের তখন বেহাল অবস্থা ।  যদিও আত্মীয় -স্বজন অনেকেই ছিল কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার মত কেউ ছিল না আসলে কেউ এগিয়ে আসেনি দায়িত্ব নিতে ।  এই লিরা  তখন একা হাতে সব সামলে নিয়েছিল আর তখনই আরিফ আর ওর  মাঝে একটা সম্পর্ক  দানা বাঁধতে শুরু করে , অনেকেই তখন সারাকে সাবধান করেছিল কিন্তু সারা বিশ্বাস করতে পারেনি এমন কিছু হতে পারে ।

কিন্তু হল । জীবনের নিয়মেই এই সম্পর্কের দাবী নিয়ে লিরা তার অধিকার চাইল আর আরিফেরও ফেরার পথ ছিলনা অগত্যা ওরা বিয়ে করল । সারা নিজেই আরিফকে ডিভোর্স দিল। আরিফ এই বাড়ি থেকে নিজের জিনিশ নিয়ে চলে গেল ওপরের তলায় এই বাড়িটি তো তারই। সারা চলে যেতে চাইছিল অন্য কোন ভাড়া বাড়িতে । কিন্তু বাড়িটি জারার নামে লিখে দেয় আরিফ।  হয়ত মেয়েদের চোখের আড়াল করতে চায়নি কিংবা এখনো মেয়েদের জন্য কিছুটা দুর্বলতা আছে ,হতেই পারে হাজার হোক বাবা তো ।

সাড়ে সাতটা বাজতেই  জারা আর রিয়া কে নিয়ে বসলো সারা  যদিও টিচার আছে সপ্তাহে তিন দিন আসেন ।  বাকি চারদিন ওই পড়ায় । এসময় মেয়েদের কাছে বসে থাকতে ওর ভালো লাগে । ভালো লাগে কিছু কিছু পড়া নিজে পড়াতে ।

রাতের খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষন টি ভি এর সামনে বসে থাকলো সারা ,টি ভি স্ক্রিনে কত কি দেখাচ্ছে ওখানে ওর মন নেই কিছুই দেখছিল না সে ।  ওর খুব একা লাগছিল ,কেবলই মনে হচ্ছিল এই বিশাল পৃথিবীতে ওর কোন সঙ্গী নেই যার সাথে একান্ত কিছু কথা শেয়ার করা যায় ... রাতের এই অন্ধকারের মত  সেও খুব একা ...  জীবনের আরও অনেকটা পথ একাই হাঁটতে হবে ওকি পারবে ? পরক্ষনেই মনে হল  কিছুতেই হার মানা চলবে না ওদের তিনজনকে এগিয়ে যেতেই হবে । ওরা পারবে ও জানে ওর সাথে আছে দুজন সাহসী যোদ্ধ্যা ,যেকোনো পরিস্থিতিতে ওদের মনোবল অটুট থাকে ,আর কি চাই ওর ?  এই পথ যত ভঙ্গুরই হোক না কেন সব বাঁধা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছুবেই ওরা  ।

পরিচিতি 


Previous Post Next Post