শান্তনু দাশ


                     -
আধা শহর আধা গ্রাম পলাশপুরের ভীষণ দাপুটে চৌধুরী পরিবারের পালিত সন্তান রুদ্র প্রতাপ ৷ বাড়ির কর্তা সমর প্রতাপ চৌধুরী তাকে খুব ছোটবেলায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন পথের ধারে এক আবর্জনা স্তুপের মাঝে ৷ তখন শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক, সারা গায়ে ঘা আর ক্ষতস্থানে ভর্তি ৷ পরম মমতায় তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন সমর প্রতাপ ৷অনেক সেবা শুশ্রুষা আর চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তোলেন শিশুটিকে ৷ চৌধুরী পরিবারের পুরনো জমিদারী রীতি অনুযায়ী বাচ্চাটার নাম রাখেন রুদ্র প্রতাপ ৷ যদিও সে যত বড়ো হতে লাগলো ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের কারণে রুদ্র প্রতাপের বদলে কালু নামেই বেশী পরিচিত হতে লাগলো সকলের কাছে ৷ রুদ্রও সেই ডাকে খুব একটা মনঃক্ষুণ্ন হত বলে শোনা যায় না ৷ তবে সমর প্রতাপের সামনে কারোর অবশ্য সাহস হয়নি কখনো রুদ্রকে ওই নামে ডাকার ৷

রুদ্র প্রতাপ যত বড়ো হতে লাগলো ততই যৌবনের তেজ প্রকাশ পেতে লাগলো তার শরীরে ও আচরণে, এলাকার মেয়েদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো সে ক্রমশঃ ৷ অনায়াসেই চার পাঁচজন কে গায়ের জোরে ঘায়েল করা তার কাছে ছিলো জল ভাত ৷ আর সেই কারণেই পলাশ পুরে দুর্বৃত্তের উপদ্রব খুব বেড়ে গেলেও চৌধুরী পরিবার ছিলো অনেকটাই নিশ্চিন্ত, রুদ্রর ভয়ে কেউ তাদের ত্রিসীমায় আসবে না, এটা সকলেই বুঝে গিয়েছিলো ৷ বাড়ির সকলেই সমর প্রতাপের রুদ্রর প্রতি অনাবশ্যক অতিরিক্ত স্নেহ কে যদিও খুব একটা সুনজরে দেখত না, এমন কি আড়ালে আবডালে ন্যাকামি বলেও কখনো কখনো কটাক্ষ করত তবুও রুদ্রর প্রতি সকলেরই অল্প বিস্তর স্নেহই ছিলো ৷ বিশেষ করে তার গুণের সমাদর সকলেই করত ৷

সকালবেলার ব্রেকফাষ্ট সমর প্রতাপ ও রুদ্র প্রতাপ একসাথেই করতেন ৷ সমর প্রতাপ এর সাথে বাজারে বা দোকানে যাওয়া কিংবা সবসময় সমর প্রতাপের খেয়াল রাখা ছিলো রুদ্রর প্রিয় কাজ ৷ যতক্ষণ সমর বাবু বাড়ি থাকতেন রুদ্র এক পাও বাড়ির বাইরে রাখতো না ৷ কিন্তু সমর বাবু ব্যবসার কাজে যেই বেরিয়ে যেতেন তখন আর বাড়িতে মন টিকতনা রুদ্রর৷ পথে পথে ঘুরে বেড়ানো, পাড়ার বন্ধু এবং বান্ধবীদের সাথে দেখা করা, আড্ডা মারা ইত্যাদি  কাজেই তখন তার বেশী সময় অপচয় হত৷ আবার মধ্যাহ্নভোজের সময় এবং সমরপ্রতাপের ফেরার ঠিক আগে সে বাড়ি ফিরে আসতো ৷ সারাদিন এইভাবে কাটিয়ে রাতে পেটপুরে খেয়ে, সমর প্রতাপ ঘুমতে গেলে সেও শুয়ে পড়তো ৷ যদিও সে ছিলো ইনসোম্যানিয়াক ৷ রাতে ভালো ঘুম হত না তার ৷

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল রুদ্র প্রতাপের৷ এর মধ্যেই সমর প্রতাপের একবার বিহারের ভাগলপুর জেলায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো ৷ ওই অঞ্চলে চৌধুরী পরিবারের কিছু পুরনো জমিদারী সূত্রে পাওয়া জমি ছিলো, তারই একটা হিল্লে করতে এক সপ্তাহের জন্য তিনি রওনা দিলেন ভাগলপুর ৷ যাওয়ার আগে রুদ্রকে খুব আদর করলেন আর বাড়ির সকলের খেয়াল রাখার নির্দেশ দিলেন ৷

তিনি যাওয়ার পরেই আকষ্মিকভাবে এক বিপর্যয় দেখা দিলো চৌধুরী পরিবারে ৷ একদিন সকালে এক ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হল রুদ্র প্রতাপ  ৷ কলকাতা গামী ম্যাটাডর এসে তাকে প্রায় পিষে দিয়ে চলে গেলো৷ কোনোরকমে প্রাণটা কেন জানি তখনো টিকে ছিলো ৷ বহু চিকিৎসা করালো চৌধুরী বাড়ির  লোকেরা, কিন্তু সবই ভষ্মে ঘী ঢালার সামিল৷ চিকিৎসকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে রুদ্র কে বাঁচানো অসম্ভব, যে কোনো সময় তার মৃত্যু হবে ৷সে যে তখনো বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্যের ৷ বাড়ির সকলে সমর প্রতাপ বাড়ি ফিরলে রুদ্রর কথা জানতে পেরে কতটা শোকগ্রস্ত হবেন এইভেবে আরো উৎকন্ঠিত বোধ করতে লাগলেন ৷

সমর প্রতাপের পালিত পুত্র মৃত্যু পথ যাত্রী আহত পঙ্গু রুদ্র প্রতাপ চৌধুরী এরপর বেঁচেছিল আরো দীর্ঘ চারটে দিন ৷ কি কারণে? হয়তো পালক পিতার সাথে শেষ সাক্ষাৎ এর ইচ্ছাশক্তিই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো ৷

সমর প্রতাপ বাড়ি ফিরে সব জানতে পেরে একেবারে ভেঙে পড়লেন ৷ তিনি এতদিন পর বাড়ি ফিরছেন আর রুদ্র সবার প্রথমে এসে তাকে সম্ভাষণ জানায়নি এমনটা আগে কখনো হয়নি ৷তখনি তার মনে খটকা লেগেছিলো ৷ এরপর সমস্তটা জানতে পেরে তার আর চোখের জল বাঁধ মানলো না ৷ ছুটে চলে এলেন তিনি বারান্দায় যেখানে শোয়ানো ছিলো রুদ্র কে ৷

অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন তিনি রুদ্র, রুদ্র, রুদ্র-রে ....

সমর প্রতাপ কে দেখতে পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো রুদ্র প্রতাপের দুচোখ ৷ অসার পঙ্গু দেহে সমস্ত শক্তি জড়ো করে একবার প্রাণপণ চেষ্টা করলো সে উঠে দাঁড়াবার ৷ আনন্দে লেজ নাড়তে নাড়তে শেষবারের মত ডেকে উঠলো ভো-ভৌ-ঔ-ঔ ৷ তারপরই ভূপতিত হল তার নিষ্প্রাণ শরীর ৷



পরিচিতি

                         

Previous Post Next Post