সব জান্তা

balurghat



ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলার দিনাজপুর , দেশভাগের পর পশ্চিম দিনাজপুর অতঃপর উন্নয়নের গতি বৃদ্ধিতে বর্তমান দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানটি বাণগড়।  জেলার একটি প্রাচীণতম ধ্বংসাবশেষ।  দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর ব্লকে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই বাণগড়  বালুরঘাট থেকে ৪৫ কিলোমিটার  এবং  মালদাহ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

গুপ্তযুগের সময় থেকে বাণগড় ছিল কোর্টিবর্ষ বিষয়ের রাজধানী, যা কিনা পুন্ড্রবর্ধণ ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল।  এই অন্যতম বিষয়টির প্রাচীণ নাম দেবকোট/দেবীকোট, ধষাবন, কোর্টিবর্ষ, শোনিতপুর ইত্যাদি।  প্রায় ৪কিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে বিস্তৃত এলাকাটি থেকে ভিন্ন রকম কিছু প্রত্নবস্তুর অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়।

অধ্যাপক কুঞ্জ গবিন্দ গোষ্সামীর নেতৃত্বে ১৯৩৮-১৯৪১ পর্যন্ত খননের মাধ্যমে জানা যায় যে এই স্থানটি মৌর্য যুগ থেকে মুসলিম শাসনামল পর্যন্ত টিকে ছিল।  বানগড় আর্কোলজিক্যাল সোসাইটি থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়- বানগড়ের আয়তন দৈর্ঘ্য প্রায় আঠারোশো (১৮০০) ফুট এবং প্রস্থে ১৫০০ ফুট বিস্তৃত ছিল ।  নগরটি ছিল চারিদিকে পরিখা ও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।  পুর্ব দিকে প্রধান নগর দ্বার ছিল যা এখন আর নেই।  নগরের কেন্দ্রে একটি রাজবাড়ী ছিল।

বানগড় সম্পর্কে একটি লোক কাহিনী প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি আছে যে, পৌরাণিক যুগে এই জেলার শাসনকর্তা ছিলেন বালি রাজা। 
বালির মৃত্যুর পর এই জেলা শাসিত হয় তার পুত্র বান কতৃর্ক।  

সুপ্রসিদ্ধ বানের নামে তার রাজ্যে নাম হয় বান রাজ্য।  রাজধানী হয় বানগড়।  কথিত যে,  দ্বারকার রাজা শ্রী কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ বানবড়ে এসে ছিল। কিন্তু অনিরুদ্ধের প্রস্তাবে  বানরাজ রাজি হয়নি,ক্রমে অনিরুদ্ধ  দ্বারকার পথে অগ্রসর হয়। এমন সময় বান রাজার কন্যা ঊষার সঙ্গে অনিরুদ্ধর প্রেমালাপ ঘটে, এবং অনিরুদ্ধ ঊষাকে নিয়ে পলায়ন করেন।  বান রাজা খবর পেয়ে অনিরুদ্ধকে বন্দি করে রাখেন।  এদিকে শ্রী কৃষ্ণে  অনিরুদ্ধকে মুক্ত করতে বান রাজার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।  বান অনেক বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও শ্রী কৃষ্ণের হাতে নিহত হন।  যুদ্ধে জয় লাভকরে অনিরুদ্ধ ঊষাকে নিয়ে দ্বারকায় চলে যায়।

বাণগড় সম্পর্কে আরো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা পাওয়া যায়।  জানা যায় যে, খ্রিস্তপুর্ব ষষ্ট শতাব্দীতে জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর পুণ্ডদেশে এসেছিলেন ধর্মের প্রচারে।  এখানে এসে তিনি কোটি বর্ষ নগরের অধিবাসী সুধর্মা নামে এক জনৈক ব্যক্তিকে  জৈন ধর্মে দীক্ষিত করেন। মহাবীরের শিষ্য সুধর্মা আবার এই নগরের অধিবাসী জম্বু স্বামী এক জনৈক ব্যক্তিকে  জৈন ধর্মে দীক্ষিত করেন।  জম্বু স্বামী নিগ্রধর্ম প্রচার করে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে দেবতার আসনে বসেন। কোটিকপুরে তিনি মারা যান এবং তাকে কোটিবর্ষে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।  কোটিকপুরে জম্বু স্বামীর সমাধি  থাকায় এই নগরী এক তীর্থ স্থানে পরিণত হয়।  মৌয্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা কালে কোটিবর্ষ নগরে নিগ্রধর্ম যে ব্যপক ভাবে প্রচার লাভ করেছিল তা হরিষেণ রচিত বৃহৎকথা কোষ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। কোটিবর্ষ নগরে বহুকাল থেকে পদ্মরথ নামে এক রাজা ছিলেন।  তাঁর রানির নাম ছিল পদ্মশ্রী।এই রাজার আশ্রিত এক জন সোমশ্রমা নামে বাহ্মন ছিলেন।  সোমশ্রমার এক মাত্র পুত্র জন্ম গ্রহণ কারেন এই কোটিবর্ষ নগরে।  পুত্রের নাম ভদ্রবাহু।  মিধাবী ভদ্রবাহুর শৈশব কাল থেকে পড়া শুনার অপরিসীম ঝোঁক ছিল। তাঁ র এক মাত্র কাজ ছিল মানুষের কল্যাণ সাধন করা।ভদ্রবাহুর প্রতিভা দেখে শ্রী গোর্বধনাচার্য প্রীত হয়ে তাঁকে জৈন ধর্মে দীক্ষা দেন।  পরে শ্রী গোর্বধনাচার্য মারা গেলে ভদ্রবাহু জৈন ধর্মে অধিনাযক পদে নিযুক্ত হ্ন।এই সময় মৌর্য্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের বৈরাগ্য দেখা দেয়।  এই অবস্থায় চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য ভদ্র বাহু কাছে দীক্ষা নেন। মৌর্য্য বংশের সম্রাট চন্দ্র গুপ্তের গুরু ভদ্রবাহু ছিলেন পঞ্চম শ্রুতকেবলী। কেবলী অর্থ পুর্নঞ্জানী। এঁদের পরে আরও পাঁচজন “শ্রুতকেবলী” ছিলেন।

বানগড়ের খননে আবিষ্কৃত তথ্যঃ

উৎখনন খুব একটা বিশাল আকারের না হলেও পরিখা ও দুর্গ প্রাকার পরিবেষ্টিত প্রাচীন নগর এলাকার সব থেকে উচু জায়গার খনন হয়েছে।  সর্বাধিক ১০.৭৫ মি. অবধি গভীর খনন পরিচালিত হয়।  জানা যায় প্রাগ মৌর্য যুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অধিবসতির স্তর উন্মেচিত হয়েছে।

বানগড়ের ভেতরে প্রথমে রাজবাড়ীর স্তূপে খননে সেখানে গুপ্ত যুগের একটি বৃহৎ দেওয়ালের চিহ্ন এবং কিছু পুরা বস্ত ও তামার একটি চতুষ্কোণ ক্ষয়প্রাপ্ত মুদ্রা পাওয়া যায় ।  বর্তমানে বাণগড় প্রবেশের মুখে পাল  যুগের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, সেখানে পাওয়া যায় ক্রুশচিহ্ন বিশিষ্ট ঘরের ঠিক মধ্যে ইটের তৈরি সাড়ে পাঁচ ফুট ব্যাসের এক অগভীর কুণ্ড।  যার উপরে ভাগে ছিল ষড়োশদল পদ্ম এবং নিচে আটকোন বিশিষ্ট জলাধার।  আরও গভীর খনন করে পাওয়া যায় বড় ও ভারী ইটের তৈরি নগর বেষ্টনকারী প্রাচীর। ঐতিহাসিকদের মতে এই নগরটি মৌর্য যুগের।  খননের ফলে পাওয়া যায় পাতকুয়া, বিভিন্ন ধরনের লাল চকচকে কাল রঙের মৃৎপাত্র, বিভিন্ন ধরনের পাথরের মালা, ঢালাই করা তামার মুদ্রা ইত্যাদি।  তাছারা শুঙ্গ যুগের নিদর্শন স্বরূপ পোড়ামাটি স্ত্রিমুর্তি, ব্রাহ্মীলিপি যুক্ত পোড়ামাটি শিলিং, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র চকচকে কাল রঙের মৃৎ ভাণ্ড, নগরের রক্ষার জন্য নির্মিত পোড়ামাটির ক্ষেপনী ইত্যাদি।

বাণগড়ের খনন কাজ যেখানে করা হয়েছিলো তা সারে চোদ্দ  ফুট পর্যন্ত গভীর ছিল।  সন্ধ্যাকর নন্দী রাম চরিত কাব্যে থেকে জানা যায়, বাণগড় ছিল একটি মন্দির নগরী।  খননে তার অনেকটা রূপ মেলে।  অসংখ্য মন্দির শোভিত এই নগরের প্রধান দেবালয়  ছিল বোধিসত্ত লোকেশ মন্দির ও তারার মন্দির।  তাছারা, মুর্তি শিব মন্দির ও ভূ ভূষন মন্দির, এই দুটি মন্দিরের পুজা পার্বন, উৎসব ভূবন খ্যাত।  বাণনগরী খননের ফলে চিকন পাতলা ইট, সরু দেওয়াল, দোচালা ছাঁদ, এই সব নিদর্শন গুপ্ত আমলের স্থাপত্যর পরিচায়ক। বাণগড়ের দালান কোঠা নির্মানে যে সব মশলা ব্যবহার করা হযেছে, সে গুলি সুরকি মিশ্রিত এঁটেল মাটির কাদা, গাঁথুনিতে চুন ও  সুরকি মিশ্রিত মশলা। বাণগড়ের দ্বিতীয় খননের স্থাপত্যর কাজে বিভিন্ন মাপের ইটের ব্যবহার দেখা যায়। পাথরের স্তম্ভ যুক্ত নির্মান কাজের জন্য বাণগড়ের স্থাপত্যর সুনাম ছিল।  কঠিন বেলে পাথরের ছিল স্তম্ভ গুলি। প্রস্তর ভাস্কর্য শিল্পে বাণগড়ের সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরব ছিল অতুলনীয়।

বাণগড় খননে টেরাকোটা শিল্পের আলোকিতদিক আবিষ্কৃত হয়েছিল। এখানকার শিল্পিরা দক্ষ হাতে সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক অলংকরণের মাধ্যমে টেরাকোটা ফলকগুলিতে তাঁদের স্ব প্রতিভারযে স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেবদেবী, রাজা জমিদার দের প্রতিকৃতি যোদ্ধা, কুস্তিগীর, গায়ক, বাদক, নর্তক বিভিন্ন পশু প্রাণী কীট পতঙ্গ, পাখী, বৃক্ষ লতা, ফল ফুল ইত্যাদি মূর্তি খচিত টেরাকোটাশিল্পকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। এই শিল্পকলা গুলি বেশির ভাগই কুষাণ যুগের। বাণগড় থেকে পাওয়া উভয় প্বার্শে সহচরীসহ মেঘ বর্ষিত জলে স্নানরতা নারী মূর্ত্তি খচিত বিশেষ ফলকটি বাংলার টেরাকোটা শিল্পের এক অনন্য  নিদর্শন। জৈন ধর্মিয় গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই নগরে বসত বাড়ির সংখ্যা ছিল ৬১ হাজার।  

বাণগড় প্রাচীন ইতিহাসেরই একটি সুবিশাল প্রভুমি।  কালের বিবর্ন পাতায় অতীত বাণগড় এখন কিংবদন্তি মাত্র।

কিছু উল্লেখযোগ্য প্রত্নবস্তু খননে আবিষ্কৃত হযেছে, যেমন-
রাজা নয়াপালের হস্তলিপি যা ১১ শতকের, বর্তমানে কলেজ মিউজিয়ামে আছে।  শতাব্দীর মূর্তি, বর্তমানে বালুরঘাট পলিশ লাইনে আছে।  গ্রানাইট পাথরের চারটি রড় স্তম্ভ, এটি শিবাতি গ্রামে অবস্থিত।  গবেষেক হন বলেন যে এটি নাকি রাজা ভাসুর মন্দির। ইমারতের ধ্বংসাবশেষ প্রাচীর, যা বানগড়ে রয়েছে।   মূর্তি, স্তম্ভ এবং প্রত্নবস্তু যা কিছু রাখা আছে শিবাতি মিশনারী স্কুলে।

বিন বখতিয়ার খিলজির সমাধিঃ

বঙ্গদেশে প্রথম মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি যে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন তার রাজধানী ছিল দেবিকোট।  অর্থাৎ বর্তমানে গঙ্গারামপুর অঞ্চলেই  ছিল বাংলার প্রথম মুসলিম রাজধানী।  এটা ১২০৫ সালের কথা।  গঙ্গারামপুর থানার অধিন বাণগড়ের পশ্চিম পার্শ্বে পুনর্ভবা নদীর তীরে, নারায়ন পুর মৌজার পীরপাল গ্রামে রয়েছে গৌড়বঙ্গ বিজেতা বখতিয়ার খিলজির সমাধি আছে।  দেবী কোটের শাসন কর্তা আলী মর্দান কত্তৃর্ক ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই সমাধি ভবনটি নির্মিত হয়েছিল স্থানীয় ভাবে জানা যায়।  শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে থাকা অবহেলিত এই সমচতুষ্কোণ সমাধি বেদীটির দৈর্ঘ্য ১০ ফুট, প্রস্থ ছিল ১০ফুট। প্রাচীন ভগ্ন দশার চারিপাশে দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ এই সমাধিকে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।  তাঁরা বলেন এই কবর হল পীর বাহা রুৎদ্দিনেরমাজার,  কিন্তু প্রবল জনশ্রুতি হল এইটি বুড়া পীর মহম্মদ বখতিয়ার খিলজির সমাধি।

নাড়ই গ্রামে মোগল সৈন্য সমাধিঃ 

আলি মর্দান ছিলেন নারানকোই নাম স্থানের জায়গিদার । গঙ্গারামপুর থানা পূর্বাংশে বর্তমানে নাড়ই নামের গ্রাম রয়েছে তা ঐ নারানকোই নামের অপভংশ হতে পারে।  এই নারই গ্রামে মোঘল সৈন্যের একটি সমাধি রয়েছে। 

ধাল দিঘিঃ
গঙ্গারামপুর শহর থেকে ১ কিমি মধ্যে এই ধাল দিঘি।  যা ১.৫ প্রস্থের এই দিঘিটি পাল সময়কালের।  দিঘিটির জলের রং ধলা ছিল তাই এটির নাম ধাল দিঘি হয়েছে। দিঘিটির উত্তর পার্শ্বে মাজার আছে বিখ্যাত পীর আতশ ফকিরের। সেখানে বেশ কিছু প্রাচীন ইমারতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।

সাধক আতাশাহ দরগাঃ

ধলদিঘির উত্তর পারে সাধক আতা শাহ্-র দরগা।  অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে, সমগ্র বঙ্গ দেশে প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন সুচিত হয় এই গঙ্গারাম পুরের ধল দিঘি তথা দেবকোট নগরী থেকে।  বর্তমানে আতা শাহ্-র দরগাটিতে অতীতের বৌদ্ধ বিহারের স্থাপনার কিছু সম্ভাব্য চিহ্ন দেখা যায়।  দিঘির ঘাটে চওড়া সিঁড়ি গুলির পশ্চিম পাশে পাথর দিয়ে বাঁধানো ভিত্তিগাত্রে প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের নকশা, স্বস্তিকা জাতীয় চিহ্ন, দ্রগার সম্মুখ ভাগের উপ্রিভাগে পরা মাটির ফলকে রূপায়িত পদ্মফুল এবং সমাধি কক্ষের অভ্যন্তরে লতাপাতার নকশা ও অনান্য অকংকার দেবকোটে পালযুগের বৃহদায়তন বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্বই বলে অনুমেয়।

অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে, বৌদ্ধ বিহারটির সামান্য পরিবর্তন সাধন করে মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি মসজিদে রূপান্তরিত করেন। সাধক আতা শাহ্ ইসলাম ধর্মের প্রচার ও আরবি-ফার্সি ভাষা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে দেওকোটে এসেছিলেন।  এই মসজিদকে কেন্দ্র করে সাধক আতা শাহের তত্ত্ববধানে একটি ধর্মিও প্রতিষ্ঠান সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠে ছিল।  ক্ষমতাবান এই সাধকের নির্দেশে মসজিদেরই এক কোনে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। বর্তমানে আতা শাহ-র দরগায় যে গম্বুজটি দেখা যায়, ওই  গম্বুজ শোভিত সমাধি কক্ষের কাজ নির্মান কাজ সাধিত হয়।  সম্ভবতঃ সাধক আতার শাহ্ মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুসারে বান্দা গিয়াস অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে একত্রে মিলিত হয়ে মসজিদ কক্ষেরই এককোনে তাঁকে দাফন করেছিলেন।

অনেকে বলে থাকেন বাঙ্গালী বৌদ্ধ আচার্য দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এই দিনাজপুর জেলার সুরোহর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই গ্রামেরই আচার্য জেতাবির কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে দেব কোট বিহারে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন।  যদিও জন্ম বিষয়ক কথাটির ভিত্তি অনেক কম।

মহিপাল দিঘিঃ
বালুরঘাট থেকে ৬০ কিমি এবং গঙ্গারামপুর থেকে ৩০ কিমি দূরে মহিপাল দিঘির অবস্থান।  দিঘিটির আয়তন প্রায় ৬১.১৬ একর। দিঘিটি পাল রাজবংশের দ্বিতীয় মহিপাল সময় কালে খনন করা হয়েছে।  বড় এই জলাশয়টির উত্তর তীরে একটি নীলকূঠি রয়েছে যাকিনা উইলিয়াম কেরীর বন্ধু মিঃ থমাসের ছিল। তবে উইলিয়াম কেরীর করা একটি নীলকূঠি ছিল ৩০ কিমি দূরে মালদাহর মাদনাবাতিতে।  নীলকূঠির ধ্বংসাবশেষ এখনো দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।  শীতকালে এখানে অথিতি পাখি আসে।

হরিরামপুরঃ
শ্রীমতি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। গঙ্গারামপুর থেকে ৩৫ কিমি এবং মালদাহ্ থেকে ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত। এখানে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়াদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা কিছু উদ্ধারও হয়েছে বর্তমানে কিছু প্রত্নবস্তু ব্লক অফিসে এবং পুলিশ স্টেশনে রয়েছ।  এছাড়াও এখানে চারটি বড় প্রাচীণ দিঘি রয়েছে।

১. আলতা দিঘি।
২. মিলিয়ান দিঘি (৮০.৪৮ একর)।
৩. গৌড় দিঘি (৫৮.০৯)।
৪. হাতি ডোবা দিঘি ।

পাকা রাস্তার সাথে সংযুক্ত থাকা বিশাল জলারাশি এই দিঘিগুলোতে শীতকালে এখানে প্রচুর পরিমান বিদেশী পাখির আগমন ঘটে।
বায়িরহাতা কাছেই আছে ঐতিহাসিক ভাবে সুপরিচিত ‘দিহাবন্ড’ নামের একটি গ্রাম। প্রাচীণ নগরের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান সমূহের চিহ্ন হিসেবে বেশ পরিচিত এই স্থানটি। চারদিক দিয়ে সীমানা করা প্রত্ন এই স্থানটি সমহজেই নজরে আসবে। এখান খেকেই সম্ভবত প্রথম উত্তর ভারতীয় শৈল্পিক শৈলীতে আর্ট স্কুল খুলেছিলেন এবং  এবং এখানে ভাস্কর্য এই স্বতন্ত্র শৈলীতে বিবর্তিত হয়ে দুজন বিখ্যাত শিল্পী এসেছিলেন, তারা হচ্ছেন ধিমান এবং বিটপাল।

ঐতিহাসিক একডালা দুর্গঃ 

১৩৫৩ সালে ফিরোজ শাহ এক বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে ইলিয়াসের রাজধানী পাণ্ডুয়া জয় করেন।ইলিয়াসের তাঁর পুর্বে লোক জনকে ছড়িয়ে নিয়ে একডালা নামক দুর্গে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। এই একডালা যেমনই বিরাট তেমনিই দুর্ভেদ্য দুর্গ। এর চারি দিকে ছিল নদী দিয়ে ঘেরা।

ফিরোজ শাহ কিছুকাল  একডালা দুর্গ অবরোধ করে রইলেন। অবশেষে একদিন ফিরোজের সেনারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ায় ইলিয়াস শাহ মনে করলেন ফিরোজ শাহ পিছু হচ্ছেন। তখন তিনি একডালা দুর্গ হতে সসেনা বের হইয়ে ফিরোজ শাহকে আক্রমণ করলেন।  দুই পক্ষে যে যুদ্ধ হয়েছিল সে যুদ্ধে ফিরোজ শাহ ইলিয়াস শাহকে সম্পূর্ন ভাবে পরাস্ত করতে পারলেন না।  শেষ পর্যন্ত এই  দুই সুলতানের মধ্যে সন্ধি হয়েছিল। এই ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন বিজড়িত একডালা দুর্গটি ছিল আদি দিনাজ পুর জেলার অধিনে। বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজ পুর জেলার কুশমন্ডি থানার অধীনে চিরামতী এবং বালিয়া নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।

বর্তমানে একডালা দুর্গে কোন অস্তিত্ব নেই। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় দুর্গটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে জনৈক বসির বাবুর বাড়ী থেকে একটি কালো পাথরের অংশ পাওয়া যায়। এই পাথরই একডালার স্মৃতি চিহ্ন।

হিলি ব্লকঃ
আন্তর্জাতিক ইন্দ-বাংলাদেশ সীমান্ত চেকপস্ট।  যা বালুরঘাট থেকে ২৫ কিমি দূরে আবস্থান।  রাজ্য মহাসড়কের সাথে সংযুক্ত।  ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ এর মুক্তিযুদ্ধে হিলি ব্লক চির স্মরণীয় ।  ৭১ এর যুদ্ধে নিহত সৈনের স্তম্ব রয়েছে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অর্পনে।  

পাশাপাশি , পতিরাম-ত্রিমোহিনি রাস্তার পাশে বালুরঘাট থেকে ১৮কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত তেভাগা আন্দোলনের  জন্য এই স্থানটি বিশেষ বিখ্যাত।    তেভাগা আন্দলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক স্বারক বেদী।  

এছাড়াও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক দ্রষ্টব্য স্থান গুলির মধ্যে রয়েছে - বানগড়, শিব বাড়ী মিউজিয়াম,   শিব বাড়ীর শিবমন্দির, একাদশ ও দ্বাদশ শতকের নিমির্ত শিব মন্দির, আতাশার দরগা, কালদিঘি, পির পাল গ্রামের বস্তিয়ার খলজি সমাধি,  প্রান সাগর দিঘি ও তার সংলগ্ন  শিব মন্দির, নিত পুরের জৈন ভগ্ন সমাধি মন্দির, সর্ব মঙ্গলার ববিখ্যাত চণ্ডীমন্দির, তপন দিঘি, পাথর পুঞ্জ, মহিপাল দিঘি নীল কুঠি   শনী বৃক্ষ, বিরাট রাজার গোশালা,এক ডালা দুর্গ, পাকিস্থানী ট্রাঙ্ক, বুড়ীমা কালী মন্দির, বালুড়ঘাট কলেজ মিউজিয়াম,  সন্ধাকর নন্দীর জন্মস্থান, পতিরাম বিদ্যেশ্বরী মন্দির, বোল্লা কালী মন্দির, জীবৎ কুন্ডূ, জগদ্দল মহাবিহার।

কিভাবে আসবেন – কলকাতা  শিয়ালদহ স্টেশন থেকে গৌড় এক্সপ্রেস , চিতপুর থেকে তেভাগা এক্সপ্রেস অথবা ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে সরকারী – বেসরকারি বিভিন্ন নৈশ বাসে সরাসরি বালুরঘাট ।  দমদম থেকে রাজ্য সরকারের ব্যবস্থায় সপ্তাহের বিশেষ দিন গুলিতে হেলিকপ্টারে পৌঁছে যেতে পারেন।   বালুরঘাট মুল শহরে রাত্রি বাসের জন্য  অতি আধুনিক বিভিন্ন আবাসিক হোটেল রয়েছে , খাবারের সুবন্দোবস্ত সহ ।  শিলিগুড়ি থেকে এন জি পি রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে অথবা দিন রাতের বাসে বালুরঘাটে পৌঁছে যেতে পারেন । 

বাংলাদেশ থেকে – সরাসরি সড়ক বা ট্রেনে বাংলা হিলি ।  আন্তর্জাতিক চেক পোস্টে সরকারী কাজ শেষে ভারতীয় হিলিতে প্রবেশের পর বাসে সরাসরি বালুরঘাট । 


সহযোগী সুত্র - 

মুহাইমিনুল কাবির রেইন

ঐতিহ্য দক্ষিণ দিনাজপুর 






Previous Post Next Post