ইফতেখারুল হক

iftekharul


ভোগসর্বস্ব এই পৃথিবী ও তার মানুষ প্রাচীনকাল থেকে এই আধুনিক সময়েও বয়ে নিয়ে চলেছে এর সর্বগুণহীন কার্যকলাপ এবং তার ফলাফল ।  সেই থেকে এই, এমনকি ক্রমবিকাশমান সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে আজঅব্দি এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি কেউ ।  না মানুষ, না সমাজ, না পরিবার, না রাষ্ট্র ! ভোগের অব্যাহত ধারাবাহিকতায় ক্রমশ মানুষের মন ও মানসিকতা, বিবেক ও বিবেচনা, চিন্তা ও চেতনা দিনদিন সঙ্কীর্ণ এবং সংকোচিত হয়ে পড়ছে ।  মানুষ হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক আত্মভোলা; সর্বোপরি দায়হীন ।  মানুষের এমন বিবর্তনমূলক এবং বৈষম্যমূলক আচরণের কোন সুস্পষ্ট সামাজিক এমন কী রাষ্ট্রিক কোন বিচারালয় নেই । নেই এমন ঘোরতর বিপর্যয়ের বিচার যা মানুষকে নষ্ট করছে, তাঁকে করে তুলছে অপ্রতিরোধ্য; কোনকোন ক্ষেত্রে শক্তিমান !  কে করবে বিচার ? সমাজ, রাষ্ট্র ? নাকি ব্যক্তি নিজেই ? যে বা যারা আজো নষ্ট হয়ে যায়নি, ভেসে যায়নি ভোগের স্রোতে ন্যূনতম বিবেকবোধের কারণেই কিংবা নীতি বোধের কারণে ।  রাষ্ট্রের কাছে ভোগ কখনোই অপরাধ নয়, এই নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা নেই ।  ভোগবাদী মানুষ, সমাজ রাষ্ট্রের চোখে ততক্ষণ অপরাধী নয় যতক্ষণ না এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে রাষ্ট্র এবং তার অন্যান্য নাগরিকের ক্ষতিসাধনে ।  তাই একথা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয় যে একজন ভোগবাদী মানুষ সমাজ রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী এবং তার অপরাধের বিচার সুনিশ্চিত ।  যদিও ভোগের ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত সর্বগ্রাহী প্রভাব সমাজ এবং রাষ্ট্রের উপর গিয়ে পড়ছে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ ভাবেই । যাকে সমর্থন করে রাষ্ট্র নিজেই ভোগ আর বিলাসিতায় মগ্ন ! এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমর্থন আর আড়াল করছে আদতে ভোগবাদী মানুষটিকেই ।  ভোগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং তাকে মদদ দেয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি অপ-কৌশল । যদিও গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা বলে অন্য কথা ।  তার সুরটিও এমন নয় ।  এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে দুরভি-সন্ধি এবং বৃহৎ স্বার্থের খেলা । যা সাধারণের পক্ষে বোঝা দায় ।  তবে রাষ্ট্র কখনোই এই দায় অবমুক্ত করেনা তার অতিসাধারণ নাগরিকের সামনে ।  এ এক নষ্টের খেলা, ভ্রষ্টের স্বীকৃতি প্রদান রাষ্ট্রের বিবেকহীন মানুষ দ্বারাই; যারা নিয়ন্ত্রণ করে সরকার এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলো ।  আদতে রাষ্ট্র নিজেই নষ্ট, ভ্রষ্ট এবং ভোগে উন্মত্ত !

তাহলে সাধারণের জায়গা কোথায় ? কী এবং কে-ইবা তাঁদের ভরসা, কেমন তাঁদের চাওয়া এবং পাওয়া ? ভোগবাদী মানুষের দ্বারা লাঞ্ছিত বঞ্চিত এইসব সাধারণ মানুষের প্রাপ্তিই-বা কী ? রাষ্ট্র কতোটুকু দাঁড়ায় এঁদের পাশে ? নানা প্রশ্ন আসে যায় তবে আসেনা সঠিক কোন উত্তর, কারণ রাষ্ট্র নিজেই যেখানে ভোগের মদদ দাতা সেখানে সাধারণের বিচার কেমন ক’রে আর কোন পথে আসবে ?

ভোগ আর দুঃশাসনে যখন কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্র উন্মত্ত হয়ে পড়ে বিক্রি করে ফেলে তার নিজস্ব সত্তা তখন আয়নায় মুখ দেখে সে নিজেই কেঁপে উঠে; কারণ প্রকৃতি অতিবেশি আতিশয্য পছন্দ করেনা ।  ঐতিহাসিক নিয়তির বেড়াজালে আটকে যায় তার গতি, প্রকৃতি । এটাই জনগণের বিচার অন্যায় আর অপরাধের বিপরীতে যদিও সময় সাপেক্ষ বিষয়টি; তথাপি বিচারের পথ যে একেবারেই রুদ্ধ নয় এই হলো আশার কথা ।  ভোগবাদীতার  চরম শাস্তির বিধান যদিও নেই সমাজ রাষ্ট্রে তবুও বিবেকের কাছে নত হওয়ার মত কঠিন শাস্তিই যথেষ্ট ভোগবাদী ব্যক্তিটির জন্যে এবং রাষ্ট্রের জন্যেও ।  বিবেকই একজন মানুষের প্রধানতম বিচারালয় এবং বিচারক পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ ভাবেই ।  অন্তত দর্শন শাস্ত্র এবং নীতি বিজ্ঞানতো সে কথাই বলে ।  কিন্তু এখানেও কথা থেকে যায়, প্রশ্ন রয়ে যায় সু-স্পষ্ট ভাবেই; আর তাহলো, মূর্খের কাছে বিবেকের গ্রহণযোগ্যতা কতোটুকু যেখানে শিক্ষিত সমাজে,শিক্ষিত মানুষটির কাছেই বিবেক আজকাল সোনার হরিণের মতো ? তবে এই কথা স্বীকার করতেই হবে আমাদেরকে যে, সময়ের প্রেক্ষিতে আজো নিরীহ আর সাধারণের বিবেক অনেক সমৃদ্ধ যেখানে শিক্ষিত মানুষ অনেক পিছিয়ে তা থেকে ! এরও রয়েছে নানবিধ কারণ তবে সন্দেহ নেই অনেক কারণের মাঝে পরিবর্তিত সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ; যা মানুষকে অনেক ব’দলে দিয়েছে এবং আজো দিচ্ছে এবং আরো দেবে ।  কারণ ত্যাগের মনোভাব না আছে মানুষের, না আছে পরিবারের, না আছে সমাজ রাষ্ট্রের ।

‘ত্যাগ’ অতি ক্ষুদ্র একটি শব্দ কিন্তু বৃহৎ তার অর্থ যে অর্থের গুরুত্ব খুঁজে বের করতে আমাদের কে চিন্তা করতে হয়না, ভাবনায় পড়তে হয়না ।  উদ্বুদ্ধ করেনা তা পালনে, আকর্ষণ করেনা তার মাহাত্ম্য এবং রূপটি ।  এমনকি তাকে লালন করার জন্য মনের কোন কোণেই তার জায়গা নেই ! মানুষের ছোটো মনে জায়গা যদিও অনেক বড়ো, বিস্তৃত তার সীমা পরিসীমা; তথাপি ত্যাগের জন্য জায়গা অনেক ছোটো, অনেক সংকোচিত তার বেড়ে ওঠার পথ । কেন আর কীভাবে ? বলার অপেক্ষা রাখেনা যে অসংযত মন মানসিকতাই প্রধান ভাবে দায়ী । নিয়ন্ত্রিত মানসিকতা দিয়ে ভোগের নামে অসংযত আচার,আচরণ এমনকি কর্তৃত্বপরায়ণতা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব যদিও তার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল সু-নিশ্চিত নয়, সংরক্ষিত নয় ।  কারণ মানুষ তাঁর আচরণগত এবং স্বভাবগত দিক দিয়ে পরিবর্তনশীল ।  আর সমস্যাটি এখানেই; বেশ বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ । এই ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা কেমন আর কতোটুকুই বা সহায়ক মানুষের মনটি কে পরিবর্তন করে দেবার জন্য ? যে মনটি আজ পতিত ভোগের সর্বনাশী সমুদ্র জলে ।

শিক্ষা আলো, শিক্ষা মুক্তি তবে বিবেককে জাগ্রত করতে শিক্ষার পাশাপাশি আত্মউপলব্ধি, আত্মসচেতনতা বড়ো প্রয়োজন।   প্রয়োজন আরো অনেক কিছুরই ।  শুধু শিক্ষা বিস্তার করে ভোগবাদী মানসিকতা দূর করা যাবে না সমাজ রাষ্ট্র থেকে এতো সহজেই। যেতে হবে মূলে, মূলটি কোথায় ? মূলটি মনে, একেবারে গভীরে । চেতনে-অবচেতনে যখন তখন ওই গভীর থেকে উঠে আসে লোভ-লালসা হিংসা-বিদ্বেষ; আর নষ্ট করে বাইরের ‘আমি’টাকে ।  মনের গভীরের এই কঠিন সমস্যাটি সমাধান ক’রে নিতে পারলে জয় ত্যাগের পরাজয় ভোগের ।  উৎপাটন করব কেমন ক’রে ? কোন পথ দিয়ে ? পদ্ধতি অনেক রাস্তাও ।  ব্যক্তিকেই বাছাই করে নিতে হবে সেই পদ্ধতিটি এমনকি রাস্তাটিও । ব্যাপারটি কঠিন কিন্তু অসাধ্য নয় কোনভাবেই ।  মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে আমাদেরকে থাকতে হবে নির্মোহ আর অহিংস ভাবাপন্ন ।  দেখতে পাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সমাজে এমন মানুষ আছে যারা মোটেও ভোগবাদী জীবনে বিশ্বাসী নয় ।  তাঁদের রয়েছে ত্যাগ আর নিষ্ঠার দুর্বার ইতিহাস ।  বরং ভোগেই অস্বস্তি হয় তাঁদের।  সকল মানুষ যেমন চরিত্রে, স্বভাবে এক নয় তেমনি তাঁদের জীবন ধারণও ভিন্ন ভিন্ন । তবে সমাজে ভোগবাদী মানুষের সংখ্যাই বেশী ।

ত্যাগ আর ভোগের তুলনামূলক পার্থক্যে যদি যাই পশ্চিম আর পুবের দেশ গুলোর মধ্যে, তাহলে দেখতে পাই খালি চোখে; পশ্চিমা বিশ্বে ত্যাগ আর ভোগের ব্যবধান অতি সামান্য । যেখানে ত্যাগ আর ভোগের ব্যবধান পুবে কোটি মাইল ।  এই পুবে ত্যাগের পারে দাঁড়িয়ে থেকে ভোগের দেখা মেলেনা আবার ভোগের সাথে সহবাসে ত্যাগ কে মনে হয় জাত শত্রু ।  শত্রুই বটে, বেশ কঠিন এবং নির্মম;শক্তিশালীও বটে ।  পুবে দরিদ্র দেশ গুলোর দরিদ্র মানুসিকতা সম্পন্ন মানুষের ভোগ যেখানে একমাত্র তপস্যা সেখানে তাঁদের কাছে ত্যাগের আশা করাটা বড়ো বেশী অন্যায় । কারণ ভোগের মত অত্যন্ত নির্লজ্জ মানসিকতা তৃতীয় বিশ্বের মানুষের এমন কী কোন কোন রাষ্ট্রের রক্তে আর অস্থি মজ্জায় । ভোগ বিলাসিতায় মগ্ন মানুষ এবং  কোন কোন সমাজ রাষ্ট্র দেখায় চরম স্বার্থপরতা । চিনতে ভুল করে আসল নকল ।  এবং সবচায়তে অগ্রহণযোগ্য যে বিষয়টি মানুষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় তা হলো বৈষম্য । বৈষম্যটি তখন আর একার ভিতরে থাকেনা; তা ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে সমাজে,অতঃপর সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ।  বৈষম্য কোথায় নেই সমাজ রাষ্ট্রের নানা কারণে ? ভোগ থেকে সৃষ্ট বৈষম্যটিও তার মধ্যে অন্যতম ।  লোভ লালসা যেখানে মূল কারণ ।  এখানেও ঠিক শ্রেণীর দ্বারা বিভক্ত বিষয়টি । সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত শ্রেণী মিলেমিশে ভোগের রাজত্ব চালিয়েছে ।  যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে নিম্নবিত্তের উপর । নিম্নবিত্তের ভোগের উপকরণ নেই, সামগ্রী নেই, মানসিকতাও নেই; আছে ত্যাগের মত পীড়িত ছোটো বড়ো ইতিহাস, জীবনালেখ্য ।  সেই বর্ণনা আমরা পাই সাহিত্যেরও প্রায় প্রতিটি শাখায় । বড়ো নির্মম, বড়ো বাস্তব সেই ত্যাগের বর্ণনা, শ্রেণীর সংঘাত, জীবন উপলব্ধি; কথামালা গুলো ।

লোভ, লালসা, কামনা বাসনা মানুষের জন্ম পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠা জীবনের নিত্য সঙ্গী, যা লুকায়িত থাকে মনে এবং যেসব থেকে একসময় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি ।  আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে কিংবা বলতে পারি চাহিদা পূরণে মানুষ গুলো রূপান্তরিত হয় এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে ! তবে এই রূপান্তরের রঙটি কম বেশী, এই যা পার্থক্য; পার্থক্য নেই বদলে যাবার মাঝে । মানুষের অভাব থেকে স্বভাব যেমন নষ্ট হয়, ঠিক তেমনি বেশী থাকলে আরো বেশী লাভের আশা করে ।  দরিদ্র দেশ গুলোতে একজন মানুষের নষ্ট হ’য়ে যাবার যাবতীয় প্রক্রিয়া বিদ্যমান । ভালো থাকার পথ যেখানে রুদ্ধ । বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাবে । রুগ্ন মানুষ, রুগ্ন সমাজ, রুগ্ন রাষ্ট্র; ব্যাধিগ্রস্ত আমরা । আমরা এতোটাই রুগ্ন আর মোহগ্রস্ত যে, আমরা ছেড়ে কথা বলিনা, ছেড়ে ভোগ করিনা । ভাবি নিজের কথা অন্যের কথা বাদ দিয়ে । আমিত্বের অহঙ্কারে, ভোগের সর্বগ্রাস প্রভাবে নষ্ট করছি নিজেকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে । এই ‘আমি’ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অনেক ‘আমি’র এবং তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসে রুগ্ন হচ্ছে সমাজ রাষ্ট্র ও তার কাঠামো গুলো ।

সময় চলে গেছে সময় আরো চলে যাবে তার স্বাভাবিক নিয়মেই ।  আমারাও এগিয়ে যাব ততোধিক তবে অপরাধ বোধ নিয়ে ,রুগ্ন মানসিকতা নিয়ে ।  তাই ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্রের উচিৎ এখনই সঠিক পথে আসা ।  পরিত্যাগ করা ভোগের ছায়া মায়া ।  উচিৎ আত্মস্থ করা ত্যাগের সর্বগুণ যা আমাদেরকে আরো মানবিক হতে সু-নাগরিক হ’তে সাহায্য করবে ।  সময়ের সাথে সাথে আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে এই রুগ্নতার চিকিৎসাই-বা কী এবং কোথায় ? মনে রাখাটা জরুরী ‘ত্যাগ’ সাময়িক কষ্ট দিলেও তার রয়েছে সুদূর প্রসারী কার্যকারিতা এবং গ্রহণযোগ্যতা ফলাফল যেখানে শূন্য নয় ।    

iftekharul
পরিচিতি


Previous Post Next Post