রফিকের ভালো নাম রফিকুল ইসলাম, তবে সে দারুন স্মার্ট একটা ছেলে, একটা ঔষধ কম্পানিতে চাকুরী করে। ভালো বেতন পায়, তার একটা মটর বাইক আছে, তার বন্ধু-বান্ধবের অভাব নেই। সে কনক নামে একটা মেয়েকে ভালোবাসতো কিন্তু শেষমেষ আর তাকে বিয়ে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কারন সে আটকেপরা পাকিস্তানি বাবার একমাত্র ছেলে ছিল; আর কনক একটা বাঙালী মেয়ে ছিল, তার বাবা থানার একজন দাপুটে পেটমোটা দারোগা ছিলেন।
যাহোক, মুল কথায় আসি- রফিক বেশ ভালো প্রকৃতির মানুষ ছিল। কিন্তু রফিকের আরো যে সব বন্ধু ছিল তারা সবাই উচ্চবিলাসী ছিল। ফলে তারা কিভাবে বেশী টাকা করা যায় সেদিকে ছুটতো। একদিন বন্ধু রবিকে বললো- বন্ধু আমি চাকুরীর পাশাপাশি একটা (ফার্মেসী) ঔষধ এর দোকান করতে চাই, তুই কি বলিস, রবি বললো, খারাপ না, করতে পারিস; কিন্তু বন্ধু তুই দোকানে কখন বসবি, বললো- অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বসবো আর আমার চাচাতো ভাই আরমানকে রাখবো, সে দেখাশুনা করবে। রবি বললো, এটা কিন্তু বেশ কঠিন কাজ আর বিশ্বস্ত লোক ছাড়া ঔষধ এর দোকানে লাভ করা খুব কঠিন।
যাহোক, সে তার দোকান শুরু করে দিল, দোকানটা বেশ চলছিল। এলাকার মধ্যে দোকান, অনেকে এসে দোকানে আড্ডা দিতে শুরু করলো, লোকেরা ঔষধ কিনতো আবার বাকিও রাখতে লাগলো। অনেক লোকজন দোকানে আসতো আর ঐসব লোকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। এদের মধ্যে থেকে একজন লোক বললো, রফিক ভাই আমার ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে চাই, আপনার হাতে কি কোন বিশ্বস্ত লোক আছে যার মাধ্যমে পাঠানো যায়। রফিক বললো- ঠিক আছে ভাই আমি দেখছি, আপনার ছেলের জন্য কি করা যায়। তারপর সে অন্যান্য বন্ধুদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করলো। তাদের মধ্যে থেকে নাসির নামে এক বন্ধু বললো বন্ধু ঐ লোককে ধরে রাখ, আমার কাছে লোক আছে, তুই আর আমি যদি লোক ধরিয়ে দিতে পারি তাহলে, বারতি কিছু ইনকাম করা যাবে। রফিক বললো তাহলে ঐ লোককে ডাকি তার সাথে কথা বলি সে আমাদের কি সুবিধা দেবে। নাসির বললো- ঐ লোকতো আমাদের এলাকার লোক, কোন ভয় নাই, পালিয়ে যাত্তয়ার কোন সুযোগ নাই। তুই লোক ঠিক কর, এতে আমাদের লাভই হবে।
একদিন সেই আদম ব্যাপারী রফিকের দোকানে আসলো। ঘটনা চত্রেু রফিকের প্রিয় বন্ধু রবিও ছিল। রফিক, রবি ও নাসিরকে আর আদম ব্যাপারীকে নিয়ে পাশের একটা হোটেলে বসলো। রবি ওদের সাথে হোটেলে বসে চা-পানি খেল আর ওদের কথা-বার্তা মনে দিয়ে শুনতে থাকলো। ওরা সিদ্ধান্তে আসলো যে তারা এক সাথে কাজ করবে। নাসির রফিককে আশ্বাস দিল যে সে তার সাথে আছে। সবাই চলে গেলে পর রফিক রবিকে বললো, বন্ধু তুই কি বলিস। রবি বললো, কাজটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না বন্ধু, কারণ যাদের তুই পাঠাবি কোনভাবে কিছু হলে সব টাকা কিন্তু তোকে পরিশোধ করতে হবে। সাবধান বন্ধু সাবধান, ঐ লোকটাকে আমার বেশি সুবিধার মনে হচেছ না। কিন্তু রফিক নাসিরের উপর আস্থা রেখে রবির কথায় কর্ণপাত করলো না। বন্ধু স্বপ্ন দেখতে থাকলো যে, এখন থেকে খুব সহজে ঘরে বসে বসে বারতি কিছু ইনকাম করতে পারবে, এই ভেবে- সে সুখে নাক ডাকতে থাকলো।
যথারিতি সে পর উপকারী বন্ধু হয়ে গেল, সে ঐ লোকের ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে দেবে বলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আদম ব্যাপারীর হাতে সমস্ত টাকা তুলে দিল। আজ ভিসা হয়ে যায় কাল ভিসা হয়ে যায় এভাবে এক মাস দুই মাস তিন মাস হয়ে গেল, ভিসা আর আসে না। প রে জানা গেল আদম ব্যাপারী সমস্ত টাকা নিয়ে উধাও। তার খোঁজে সবাই লেগে পড়ল, কিন্তু তাকে আর পাওয়া গেল না। বন্ধু নাসির রফিকের কাছ থেকে সরে দাড়ালো, এরপরই ওই লোক যে তার ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ২,৫০,০০,০০০/- দিয়ে ছিলো সে লোকজন নিয়ে এসে তার দেওয়া সমস্ত টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলো, বললো- আমি সুদে টাকা এনে আপনাকে দিয়েছি আমার পাওনাদাররা আমাকে আমাকে চাপ দিচেছ, দয়াকরে কবে টাকা ফেরত দিবেন? তারাতাড়ি ফেরত দেন। রফিক ভিষন সমস্যায় পরে গেল। এদিকে তার ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। নিজের বোকামীর জন্য নিজের চুল ছিড়তে লাগলো; হায় আমি কি করবো।
এদিকে তার চাকুরীতে সমস্যা দেখা দিল, চাকুরী থাকবে কি থাকবে না । রফিক দিশেহারা হয়ে পড়ল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার আব্বা বললো, এক কাজ কর এক হুজুর আছে, তার কাছ থেকে পানি পরা এনে তোর অফিসে ছিটিয়ে দিলে তোরা কোন সমস্যা থাকবে না । যে কথা সেই কাজ, সে পানি পরা এনে রবিকে সাথে নিয়ে ছুটলো অফিসে পানি পরা ছিটাতে, রবি দাড়িয়ে দাড়িয়ে পানি পরা ছিটানো দেখলো। কিছু দিন পর শুনতে পেল তাদের অফিস খুলনা ছেড়ে যশোর চলে যাচ্ছে। কাজ করতে হলে যশোরে থেকে করতে হবে। কি আর করা, রফিক প্রতিদিন যশোরে যাত্তয়া আসা করতে থাকলো এবং এর মধ্যে তার ফেন্সি মামার প্রেমে পড়ে গেল; প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে মামাকে না খেলে মটর বাইক চালাতে জোষ পেত না। এভাবে পথে পথেই টাকা খরচ হয়ে যেতে থাকলো। দেখতে দেখতে যশোরে ২ বছর হয়ে গেল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এবার আবার তার অফিস গুটিয়ে ফরিদপুর চলে গেল । এবার আর তার চাকুরী বাঁচলো না।
রফিকের জীবনে আবার এক নতুন বন্ধুর আর্বিভাব ঘটলো। তিনি বললেন, যে তারা গোল্ড মাইনের ব্যবসা করে। ব্যবসাটা কি রকম? প্রচুর সোনা আর সোনা। এখানে টাকা ইনভেষ্ট করলে, টাকার পর টাকা আসতে থাকবে। ইনভেষ্ট করলে কোন সমস্যা নেই কারন এই কম্পানির প্রচুর সোনা, তারা টাকা মেরে দিয়ে চলে যাবে না, কারণ তাদের এতো টাকা যে পাবলিকের মাঝে এর শেয়ার দিয়ে দিতে চায়, যাতে পাবলিকত্ত ধনি হতে পারে। যে যত শেয়ার কিনবে সে তত লাভবান হবে। এটা হলো অনলাইন গোল্ড মাইন বিজনেস।
বন্ধুদের মাঝে এই লাভ-লোকসানের বিজনেস নিয়ে আলোচনা চলছে, এমন সময় আগত এক নতুন বন্ধু বললো- বন্ধুরা মন দিয়ে একটা গল্পো শোন, এই গল্পের নাম হল, ‘‘মাঙ্কি ট্রিক্স’’ - একদিন এক চতুর লোক, খুব ভদ্রবেশে এক গ্রামে গেল, এবং ঐ লোক তার এক সাগরেদকে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরলো। সে সারা গ্রাম পর্যটন করে সিদ্ধান্ত নিল যে সে বানরের ব্যবসা করবে; যেই ভাবা সেই কাজ, দু’ এক জন লোক নিয়ে একটা বড় খাঁচা তৈরী করলো। গ্রামের লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করলো জনাব, আপনি এত বড় খাঁচা দিয়ে কি করবেন। লোকটি গ্রামের লোকদের বললো যে সে তাদের গ্রাম থেকে কিছু বানর সংগ্রহ করতে চায়; লোকেরা বললো আপনি বানর দিয়ে কি করবেন- লোকটি বললো এই বানর দিয়ে এক মহা আশ্চর্য তৈল তৈরী করা হবে, ঐ তৈল এক বিশেষ জটিল রোগ নিরাময়ে বিদেশীরা ব্যবহার করবে, বিদেশে এই তৈলের দাম অনেক; তোমরা যদি আমাকে ঐ বানর ধরে দিতে পার, তাহলে আমি প্রতি ১টি বানরে ৫০ টাকা দাম দিতে পারি। এ কথা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। সারা দিন লোকেরা গাছপালা, বন বাদার থেকে অনেক বানর ধরে ঐ লোকের কাছে নিয়ে আসলো, আর উনি তাদেরকে প্রতি ১টা বানরে ৫০ টাকা হারে দাম পরিশোধ করলো, লোকটি শ তিনেক বানর ৫০ টাকা হারে সংগ্রহ করতে পারলো। গ্রামের লোকরাও মহা খুশি বিনা পুঁজিতে তারা দুষ্ট বানরদেরকে বিক্রি করতে পেরে। এ দিকে ঐ লোক আবার ঘোষনা করলো আরো যদি কেউ বানর দিতে পারে, তাহলে সে প্রতি বানরে ১০০ টাকা করে দাম দেবে। সাথে সাথে কিছু অতিলোভী লোকজন বানর ধরতে বেড়িয়ে পড়ল। লোকেরা পরের দিন আরো শ তিনেক বানর ধরে লোকটিকে দিলো এবং বানর প্রতি ১০০ টাকা হারে ইনকাম করলো। একই ভাবে লোকটি সব বানর কেনার পর ঘোষনা করলো যে, সে আরো বানর কিনতে চায়, কারন বিদেশে থেকে আরো বেশি বানর কেনার অর্ডার এসেছে। আগামি কাল কেউ যদি আরো বানর দিতে পারে তাহলে তাকে বানর প্রতি ৩০০ টাকা দেয়া হবে। প রের দিন আরো ৫/৭টা বানর ধরা পরল এবং লোকেরা বিক্রি করলো। এবার ঘোষনা আসলো তাদের আরত্ত বানর দরকার যদি কেউ বানর দিতে পারে তাহলে ১০০০ টাকা করে দাম দেওয়া হবে। কিন্তু এতো দিনে বানর ধরতে ধরতে গ্রামে আর কোন বানর অবশিষ্ট থাকলো না। লোকেরা আর কোথায় বানর পাবে, অনেকে তন্ন তন্ন করে গ্রামের বন জঞ্জলে বানর খুঁজে বেরালো কিন্তু কোন বানর পেল না।
গ্রামের এক চতুর লোভী ব্যক্তি ছিল সে বেশী টাকার আশায় কোথাত্ত বানর খুঁজে না পেয়ে অবশেষে সেই বানরের খাঁচার কাছে এল এবং ওই খাঁচার পাহারাদারকে অনুনয় বিনয় করলো যে ভাই আমাকে ৫টা বানর দেন, এতোগুলো বানরের মধ্যে ৫টা বানর না থাকলে আপনার মালিক বুঝতে পারবে না। কিন্তু পাহারাদার বানর দিতে অস্বীকার করলো। লোকটা পাহারাদারকে বুঝালো ভাই কেউ বুঝতে পারবে না আপনি ৫টা বানর দিলে আমি আপনাকে ৪০০০ টাকা দেব, আমি সকালে আপনার মালিকের কাছে ৫০০০ টাকায় বিক্রি করে মাত্র ১০০০ টাকা আয় করতে পারবো আর আপনি ফাও ৪০০০ টাকা আয় করতে পারবেন, আমি কথা দিলাম আর কাউকে এ কথা বলবো না, শুধু আপনি আর আমি ছাড়া কেউ জানবে না। এরপর ওই পাহারাদার তার কাছে ৫টা বানর বিক্রি করে দিল। এদিকে ওই লোক যখন বানর নিয়ে তার বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলো তখন পথিমধ্যে তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথে দেখা হল; বন্ধু বললো, কিরে বানর কোথায় পেলি, আমি তো এতো খুঁজলাম যে কোথাও কোন বানর দেখতেই পেলাম না, অথচ তুই কি করে বানর খুঁজে পেলি? সে বলল, এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু নাছোড় বান্দা বন্ধু বানরের খবর না বলা পর্যন্ত ছাড়ল না। চা-পান, সিগারেট খাইয়ে, ভুলিয়ে ভালিয়ে বানরের খবর আদায় করে ছাড়ল। সে বললো, বন্ধু এ কথা যেন কোন কাক-পক্ষিও না জানে, তুমি পটিয়ে পাটিয়ে যদি পাহারাদারের কাছ থেকে বানর আনতে পারো তাহলে, তোমারই লাভ; কিন্তু কেউ যেন না জানে।
এদিকে, এ কথা আর গোপন থাকলো না। গোপনে সবাই লাভের আশায় একই ভাবে নিজেদের বিক্রি করা বানর আবার নিজেরাই ক্রয় করে আনলো; পরের দিন ক্রয় করা বানর বিক্রি করে কিছু টাকা ফাও লাভের আশায়। একে একে সব বানর রাতের অন্ধকারে বিক্রি হয়ে গেল। যথারিতি সকালে সবাই তাদের বানর বিক্রি করতে আসলো; এসে দেখলো- পাহাড়াদার বা বানর কেনার মালিক কেউ সেখানে নাই, কে তাদের বানর কিনবে? বানরের খাঁচা খালি পড়ে আছে। যতই সময় বাড়তে থাকলো, বেলা বেড়ে সূর্য যখন মাথার উপর এসে দাড়ালো তখন কারো বুঝতে বাকি থাকলো না যে তারা ধরা খেয়েছে আর সেই লোক ঠকবাঁজ ছাড়া কেউ না! গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারলো অতি লোভে কি হয়; কথায় আছে- “অতি লোভে তাতি নষ্ট, বলে যে কথায়।’’ এখন বন্ধু তুমি কি করবা এটা তোমার নিজের ব্যাপার। গোল্ড মাইন টোল্ড মাইন বাদ দে। সব মাল্টি পারপাস কোম্পানিইর একই লাইন শুধু পাবলিক ঠকানো। রফিকের এই সব সহজ পন্থায় টাকা উপার্জনের সব পথই এক সময় উধাউ হয়ে গেল। কেউ কেউ একে হায় হায় কম্পানির নাম দিল।
এখন রফিক পরিশ্রান্ত ভারাকান্ত; কি করবে? কি করবে না? দিশাহারা হয়ে গেল। বিদেশে লোক পাঠানো টাকা সহ সব পাওনাদাররা এসে হাজির হল, কেউ কেউ বিচার-শালিশি বসালো, যেন তাদের টাকা যত তারাতাড়ি সম্ভব উঠিয়ে নিতে পারে। সে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে করতে নিঃশ্ব হয়ে পড়ল। এখনো প্রতিদিন কেউ না কেউ তাদের টাকা পাবার প্রত্যাশায় তার খোঁজে আসে। শেষমেষ রফিক একটা চায়ের দোকান দিল এবং নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়তে থাকলো আর সব দায় আল্লাহ্ উপর রেখে দিন যাপন করতে লাগলো। এখন তার মুখে সবসময় আল্লার নাম আর নির্ভরতা প্রকাশ করতে থাকলো। যা কিছু হয়েছে- হয়তো আল্লাহ তার সামনে কোন মঙ্গল লিখে রেখেছেন, এই ভেবে মনে একটু প্রশান্তি লাভ করলো।
Tags:
গল্প