মধুছন্দা মিত্র ঘোষ

modhu

একরত্তি সেই ছোট্ট শিশু বয়সে,যখন খাওয়ার সময় কেবলই বায়না করতাম, আর মায়ের মনি-মা মানে আমার মনি দিম্মা ভাতের গ্রাস তুলে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিস্তর ছেলে ভুলানো গল্প ছড়া শুনিয়ে সাধ্য সাধনা করে খাওয়াতে চেষ্টা করতেন। তখন বুদ্ধু ভুতুম , লালপরী নীলপরী ,রাক্ষস খোক্ষস - এর গল্পের সাথে আরও কচিকাচা ছড়া শোনানোর সাথে সাথে এই ছড়াটাও মণি দিম্মা প্রায়ই বলতেন -
' তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ কর তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো- তার বেলা? তার বেলা ?'
তো সেই পুঁচকে বেলায় ছন্দ মিলিয়ে অন্নদাশংকর রায়ের ঐ নামকরা কবিতার কথাকটির অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটুকু না বুঝলেও ছড়াটা শুনতে ভারি মজা লাগতো। ওদিকে মণি দিম্মাও বায়না ভুলিয়ে খাইয়ে দাইয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। স্বাধীনতা/দেশভাগ এসব নিয়ে লিখতে বসে 'ধান ভাঙতে শিবের গীত' এর মত উপক্রমণিকা হয়ে গেলো তা আবার নিজের আত্মকথনে । 

পাকা আটষট্টি বছর পার করে এসেছি আমরা স্বাধীনতা অর্জনে । সেই দুবছর কম সত্তর বছর আগে মহাত্মাজী, মৌলানা আজাদ, নেহেরু প্রমুখ নেতাগণ জাতীয় আন্দোলন শুরু করেছিলেন দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে । একবারও এটা ভাবেননি যে তাঁদের দ্বিখণ্ডিত ভারত্রের স্বাধীনতাকেই ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মেনে নিতেই হবে। তাঁরা কিন্তু স্বতন্ত্র সংগ্রামে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এক অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার আশায়।

১৯৪৭-২০১৫, একটু অন্যরকম ভাবে যদি ব্যাখ্যা করি, সেই ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করা ব্যাক্তিদের বয়সটাও আজ অনেকটা সময় পার করা বার্ধক্য ।আসলে এখন যা ভারতকে অভ্যস্ত নজরে দেখছি সেখানে আটষট্টি বছর আগে ধর্মের নামে দেশভাগ ঘটে যাওয়ার পরও কখনও ভাষা , কখনও ধর্ম , কখনও সমাজ, কখনও প্রাদেশিকতার নামে অশুদ্ধ ভাবনার প্রতিফলন হচ্ছে। অন্ধ ভাবাবেগের দ্বারা চালিত কিছু শ্রেণীর মানুষ সমস্ত কিছু কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে তার নিজস্ব অঞ্চলগত কোটরের মধ্যে ।

সাহিত্য, শিল্পে্, চলচ্চিত্রে উদ্বাস্তুদের জীবন যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এসবও লেজুড় হয়ে জুড়ে গেছিলো দেশ ভাগের কালিমার সাথে সাথে । দেশ বিভাজনের রসদের সাথে সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধিকে তাতিয়ে যে ছেদ-বিচ্ছেদের দ্বন্দ্ব বারবার সত্য হয়ে উঠেছিলো তাকে মূল উপজীব্য করে শিল্পে , গল্পে, সিনেমায়, সাহিত্যে প্রকাশ করতে চেয়েছেন আধুনিক ভারতের কথা সাহিত্যিকেরা , শ্রেষ্ঠ প্রতিভারা , শ্রেষ্ঠ রূপকাররা ।
সর্বভারতীয় সাহিত্যের সুচারু মেধা যারা , তাদের লেখনী থেকে বার হয়েছে গল্পের ছাঁচে যে সময়কার তথা দেশভাগের সময়কার জীবন্ত দলিল।

"ড্রেসিং টেবিল" নামের অসাধারণ গল্পটিতে সলিল চৌধুরীর উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় ফুটে ওঠে এক শোকবিহ্বল পরিণতির চালচিত্র। শিল্পী রহিমুদ্দিন বাল্যবন্ধু অমলকে স্ত্রী সহ সদ্য পার্টিশান হওয়া পাকিস্তান থেকে মালপত্র বাঁধাছাঁদা করে কলকাতার দিকে যাওয়ার তোড়জোড় করতে দেখে বলে " তোমরাও শেষকালে চললে বৌদি?" বৌদি অসীম ক্ষেদের সাথে বলে "তোমাদের দেশে তো আমাদের জায়গা হবে না ঠাকুরপো। আজকাল মোছলমানের দেশ পাকিস্তান আর হিন্দুদের দেশ হিন্দুস্থান।"- নিলাম থেকে অতি সস্তায় কেনা ড্রেসিং টেবিলের দেরাজ থেকে পাওয়া চারটে চিঠির পরতে পরতে উজাড় হয়ে ওঠে সব হারানোর যন্ত্রণা ।

আবার লাহোর থেকে আগত অগণিত উদ্বাস্তুদের নরকজাত পরিবেশের হাহাকারসর্বস্য নগ্ন চলচ্ছবিকে মেলে ধরে ঋত্বিক ঘটকের 'স্ফটিক পাত্র' ।  গল্পের উত্তমপুরুষ বিবৃতি দেয় "এই সেই নতুন জাতের ভিক্ষুকদের দেখতে সেদিন দিল্লীর রিফিউজি ক্যাম্পে চলে গেলাম । জীবনে ভুলতে পারবো না সে পরিবেশ । একটা মাঠের মধ্যে নতুন খাড়া করা ছাউনি , বাস্তুহারাদের বস্তি । উৎখাত বাস্তুহারা শরণাগতের দল ।"
অমলেন্দু চক্রবর্তীর ' অধিরথ সুতপুত্র ' গল্পে সদ্য কলকাতায় রিফিউজি হয়ে আসা সনাতন ঘোষ দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে তার ওপার বাংলার বাল্যবন্ধু আব্দুল আহাদ কে চিঠি লেখে "আমি ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব লাভ করিয়াছি ।এই দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি. এ. ডিগ্রী ছাড়াও আরও একটি নতুন সার্টিফিকেট জুটিয়াছে -' রিভিউজি'। ডিগ্রীতে যোগ্যতা প্রমাণিত না হলেও নতুন সার্টিফিকেটে বেশ করুণা ভিক্ষা করা যায় ।" 

দেবেশ রায়ের উদ্বাস্তু গল্পে বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত স্কুল শিক্ষক সত্যব্রত ও স্ত্রী অনিমাকে উদ্বাস্তু জীবনের সব্রকম গ্লানি নিয়ে এদেশের গর্ভমেন্টের কাছ থেকে সঠিক পরিচয়পত্র পেতে নাজেহাল হতে হয় । "এই আমি যে সেই আমি" প্রমান করতে।

প্রফুল্ল রায়ের 'রাজা আসে রাজা যায়' গল্পে হতাশ রাজেক নিজেকে আপন মনে প্রবোধ দেয় "দেশখান দুভাগ হয়, দ্যাশের এক রাজা আসে , এক রাজা যায় তাতে তর কি রে তর কি ?"

দেশভাগের ওপর এমনই কত ছোটো গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গল্পকাররা দেশভাগের ক্ষত , ঘাত প্রতিঘাতের যন্ত্রণা নিজের মনন ও লেখনীর সংমিশ্রণে সেই সময়কার নিদারুণ কঠিন বাস্তবকে নিজস্ব উপস্থাপনার রূপকল্পে এক অন্য মাত্রা দিয়েছেন । ইতিহাস অজ্ঞ মন ভারতভঙ্গ বা বঙ্গভঙ্গ-এর প্যাঁচপয়েজার ভালোভাবে বোঝার চেষ্টাই করিনি কখনো। তাছাড়া ব্যাক্তিগত ভাবে খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয় হওয়ায় নিজের পরিবারের কাউকেই দেশ ভাগের যন্ত্রণার কথা বলতে শুনিনি কখনো। তাই শিকড় উপড়ে অন্য দেশে চলে আসার যে দগ্ধতা, সে সব নিয়ে নিরেট ধারনাও গড়ে ওঠেনি কখনো। বরং আমরা ঢের পরবর্তী প্রজন্মরা স্কুল কলেজ বন্ধু মহলের আড্ডায় ‘বাঙাল – ঘটি’র ভালোত্ব মন্দত্ব নিয়ে চিরাচরিত ঠাট্টা ইয়ার্কি থেকে তর্ক পর্যন্ত চালিয়ে গেছি। চিংড়ি মাছের মালাইকারী, নাকি চিতল মাছের ম্যুইঠা, বিউলি ডাল আলু পোস্ত নাকি কচুর লতির ঘন্ট কোনটা বেশি সুস্বাদু এসবই ছেলেমানুষি তর্কাতর্কিতে বিপরীত দলের কাছে গো হারান হেরেও গেছি।

তবু দেশভাগের ভয়াবহ অতীতকে স্মরণ করে লেখাগুলি পড়লে কেমন স্তম্ভিত হয়ে যাই ।  আগস্ট মাস পরলেই ওই স্বাধীনতা দিবসের ছুটির কথা প্রথমেই মনে হয়। ইদানীং যদিও আগস্টের প্রথম রবিবারে বন্ধুত্ব-দিবস বলে নতুন একটা দিনকে আদিখ্যেতা করে খুব কাছে টেনে নিয়েছে একালের প্রজন্ম । কবিগুরুর বাইশে শ্রাবণ , ঝুলন উৎসব , রাখী এসব তো আগস্ট মাসে আছেই। আমাদের দুই-আড়াই প্রজন্মের আগে যে সব স্বতন্ত্রতা সংগ্রামের বীরগাঁথা কেবল ইতিহাসের পাতায় , স্কুলের পাঠ্য বইতে, তথ্যচিত্র , সিনেমা বা কিছু দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমেই জেনেছি। বহুবার বহুশ্রুত এবং এখনও প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হতে দেখি- সেই সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যদি ভারতকে নির্ভেজাল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার জন্য যদি সত্যি সত্যিই সচেষ্ট থাকতেন, তাহলে কাগজ কাটার মত কাঁচি দিয়ে রাতারাতি দেশটাকে টুকরো করা হত না ।

modhusmall
পরিচিতি 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.