পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত




কৃষিবউ 






কথাক্ষুধা ক্রমশ বাড়লো ...
শীত শেষ, গ্রীষ্মের বিকেল, বাতানুকুল এই চতুষ্কোণ গৃহে
মাখনের মতো নরম বিছানায় ভাতঘুম অপরিহার্য ছিলো ।
ঘুমের রূপসি-পরিরা ঝিলমিল এই বাঙলোয় এসে ফিরে গেছে ।
নিভৃতে ঝিলের জলে নৌকো ভাসাবে তাই দিবা স্বপ্নের মধ্যেও
ভেসে এসেছিলো কতো মাছ,রূপোলি রঙের সব মাছ...
স্লিপিং-সিকনেস দিয়ে আমাকে মেঘ ও কুয়াশায় ঢাকা
পাহাড়ের ওপাড়ে নিয়ে যেতে চায় ঘুমের রূপসী পরিরা ,
আমি তছনছ করি এই দিবা ঘুম । আরাম চেয়ারে বসে
অবিশ্বাস্য আরবরজনী আমার হালফ্যাশনের কফিশপ যেন!
কিছু আগে নোলক পরা নাকে কৃষিবউ
আইস্ক্রিমের বাটি রেখে গেছে ফ্যটলেস হাল্কা টেবিলে ।
বই-কাননের ঘ্রাণ শেষ করে
আমি আজ কথা সাগরের জলে সাঁতার কাটবো।
রংচঙে খেলনার মতো অনন্ত সুখের এই বাড়ি
আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো নিরন্তর,
ইয়োলো দোপাট্টা এলো হাতে চা কাচের বাটিতে,
যেন চোখের পলকে মৎস্যকুমারী এক
নেমে এলো ওই চাঁদ থেকে। ওর গা থেকে ভেসে আসছে
চমৎকার সুগন্ধ ,ঘুম জড়ানো গলায় ফিসফিস করে বললো-
‘প্যারিসের বিকেল,বুঝেছো হে পুণ্যশ্লোক, গন্ধের সৌকর্যে বসে আছি,
একবার ,শুধু একবার,স্ফূর্তিতে গায়ে মাখো,এই গন্ধবিলাস
আপেলের ফলন্ত বাগিচা হবে তুমি।‘
মনে হলো ফুরফুরে বাতাস বইছে তার চোখে মুখে।
আমি তার গান শুনলাম হাওয়ায় এলোমেলো চুল
রান্নার মেনু শুনলাম আর ট্যুর-প্লান শুনতে শুনতে মনে হলো
পাহাড় ডাকছে, আর আমি শুনতে পেলাম যেন, কৃষিবউ গাইছে...
‘তাদের গাছে গায় যে রবিন পাখি তাহার গানে নাচে আমার বুক’-
কিছুপরে ঘুঙুর-পর্দায় শব্দ মেলে কৃষিবউ চলে গেলো ভিতরের ঘরে ।

নরম গালিচা বুঝি পারস্যের ! বেলজিয়াম থেকে আনা ঝাড়বাতি!
বুঝি বিছানার ঘ্রাণেও জেগে আছে প্যারিসের বিকেল ।
মৃদু আলো আসছে জানালার কাচ বেয়ে
আর এই একবারই ওকে আমি মনে মনে আনারকলি বলে কেন ডাকলাম ।
দেয়ালে দেয়ালে কতো ছবি, অবকাশ একাকীত্বের সাথী এরা,
উজ্জ্বল কুশনে পিঠ রেখে উপভোগ করি ।

আমি তার সাথে চাষবাস নিয়ে কথা বলি,
সে বলে মণিকাঞ্চন কথা
উষ্ণ-উৎসাহ তার ক্রমশ এগুচ্ছিলো ভোগবাদে ,
সে দ্রুত মাইক্রোভেন খুলে বের করে নিতে চায় চিকেন কাবাব বিরিয়ানি পোলাও
ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা কোকাকলা তন্দুরি চুল্লিতে ধান সেদ্ধ,কৃষিবউ ভাবতেও পারে না।
মুহূর্তে প্যাটিস কেক পুডিং পকোড়া ফিস-রোল কৃষিবউ দেখালেন সব,
অলৌকিক ক্ষমতা তার কতো মাছ ,রূপলি রঙের মাছ অ্যাকুরিয়ামে,
মৎস্য কুমারীর মতো... আহা তুমি কতো জানো কৃষিবউ –
গাজরের হালুয়া তুমি দিলে রূপোর বাটিতে কি মিষ্টি,
কি মোহনীয় তার স্বাদ গন্ধ মোহ দিয়ে বুঝি তৈরি করেছো ! কৃষিবউ ।
কথা শুনতে শুনতে ফেস্টিভ-টিপট থেকে কৃষিবউ ঢাললেন ব্ল্যাককফি
বাদাম কুঁচির সাথে দারুণ কিশমিশ খৈ খৈ হালকা ভুট্টার সাদা বিস্কুট।
খেতে খেতে ওয়াকিটকিতে বললেন কথা কৃষকের সাথে।
ধান-কাটা নিয়ে কথা ,বুঝি অভিমত দিলেন স্বামীকে...
সোনালী জড়িপাড় শিফন দুপাট্টা হাসলো চোখে মুখে
কৃষিবউ শুনবেন কথা তাই গালে হাত দিয়ে ডিভানে ডোবালেন কাঁধ থেকে পা...
আমিও শোনালাম আমার গ্রামের কথা ,
তিস্তার পাকদন্ডী বেয়ে আমাদের গ্রাম চুপটি করে বসে আছে কাঠের ডাকবাংলো
আর ভাসমান কুয়াশায় উধাও পানিসাজ গাছের জঙ্গল
আমি শোনালাম গৃহস্থ জীবন ,রাখলের বাঁশি,গরম দুধের ফেনা,
মাখন কুমড়োর খোলে ঝুলন্ত-কুলুঙ্গি লাউ মাচানের লতাগৃহ,
লেপাপোছা উঠোনের পাশে হাঁস-মুরগির ঠোঁট খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে সব দানা
গমের ভুট্টার আর ভাতের... শুনেই চিৎকার কৃষিবউ,
কি বললে- হাঁস-মুরগি বাড়ির উঠোনে? লাউমাচা?
তবে কি আমার পিতামহ পাতকুঁয়া থেকে নালা কেটে জল নিয়ে যেতো ধান ক্ষেতে?
তবে কি আমার পিতৃকুল লাঙল কাঁধের থেকে ফেলে গরুর গাড়িতে যেতো বুধ হাঁটে?
হায় হায় , তবে কি আমার পিসি ঢেঁকি ও ঘানির যাঁতাকলে তিলে তিলে দিয়েছেন প্রাণ?
চোখে তার জল ভেসে এলো , থমথমে অদৃশ্য কোথাও কেউ এখন
অম্লানবদনে আব্বাসের গান গাইছে ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে রে তুই আল্লা...’
আমি আসলে এলিগ্যান্ট আর গর্জাস এই দুইয়ের মধ্যেই বসেছিলাম ,
আমার ভাবনার মধ্যে কখন যে কৃষিবউ এসে দাঁড়ালেন !
সিফন জর্জেটে তার মুগ্ধতা বুঝি এই মাত্র বিউটিপার্লার থেকে এলো
ভাসমান কুয়াশার মতো মুহূর্তে উধাও হলো তার বিষন্নতা
আড়চোখে সে আমাকে একবার দেখলো মূল্যবান পাথরে সাজানো তার খোঁপা,
জমকালো মণিমুক্তার, মাছরাঙা পাখি হয়ে সোঁ করে নিয়ে এলো
চমৎকার ভেল্ভেটে জড়ানো অ্যালবাম। কতো দৃশ্য
ভেনিস স্কটল্যান্ড প্যাগোডার ছড়াছড়ি
কৃষিবউ বললেন ,যা কিছু চিরকালীন হওয়া দরকার ।ছিমছাম নিখুঁত।
আমি চুপি চুপি হাত বাড়ালাম যেই, কৃষিবউ রূপসী নক্ষত্র হয়ে উড়ে গেলো টিউলিপে।
তোমায় শোনাবো কতো কথা, এই যে আমার ছবি দেখো পুণ্যশ্লোক ,
সুইমিং কস্টিউমে আমি যেন মাছ খোলা অ্যাক্যুরিয়ামে ,
আর এই দেখো আরবি-হর্স কৃষকের সাদা ঘোড়া ইস্তানবুল থেকে আনা
 আমাদের এই হেভি জুয়েলারি। আমি দেখলাম ,সাদা ঘোড়ায় চেপে ছুটে যাচ্ছে তার স্বামী ।
হঠাৎ অন্যমনস্ক আমি হাল্কা ভেসে যাচ্ছি প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে মাইক্রোওভেনে...
 ঝিম ভেঙে দেখি ,লাজে রাঙা কনে বউ দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার পাশটিতে
ওর গা থেকে ভেসে আসছে চমৎকার সুগন্ধ,’ প্যারিসের বিকেল,বু
ঝেছো হে পুণ্যশ্লোক । গন্ধের সৌকর্যে বসে আছি,
একবার শুধু একবার স্ফূর্তিতে গায়ে মাখো এই গন্ধবিলাস,
আপেলের ফলন্ত বাগিচা হবে তুমি।“ ভালো লাগলো তার কথা
সাজসজ্জা অন্দরমহল,ফুটেছে রুচির পরিচয় অল্প দূরে সংগীত ভবনের ডাক এলো ,
আমি উঠে দাঁড়ালাম ,কৃষিবউ ডালা খুলে শোনালো কতো গান
সুমনের বাবা সায়গল আর মেহেদি হাসান সব শেষে এলো জলতরঙ্গের মতো মিষ্টি গলার গান ,
কৃষিবউ বললো ,এই আমি , গাইলাম রেকর্ডে।
আমি অভিভূত,কৃষকের বউ ,এতো আধুনিক সুরম্য সুন্দর!
আমি তাকে শোনালাম ডলফিন লেক আর সামসিং ভ্রমণের কথা
হ্যান্ডগ্লাইডারে উড়ে যাওয়া যুবতী পরিদের কথা ,উড়ন্ত যুবকের কথা
ভাসতে ভাসতে তারা তারা গান গায়, খেলা করে,
ভাসতে ভাসতে তারা চলে যায় পাহাড়ের কুয়াশায় ।
কৃষিবউ, আয়নার ভিতরে তার প্রতিচ্ছায়া ওষ্ঠ রঞ্জন শেষে
মৃদু হেসে বললো আমাকে তুমি বন্ধু আমার,আমি কৃষিবউ কৃষকের বউ
আমার স্বামীর দু’টো ট্র্যাকটর নিজে চাষ করে
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে শিখেছে
ও জানে ভালো বীজধানে সাফল্য এসেছে আমাদের ঘরে
সার আর জলসেচে রূপান্তর আছে চমৎকার-
কতো টমাটোর লাল ক্ষেত গাজর বেগুন ।
মূল্যবান পাথরে তার খোপা জমকালো মণিমুক্তার আনন্দে ছলকে উঠলো
আয়নার ভিতরে তার ছবি মৎস্য কুমারীর মতো ভসোমান,
স্বর্গের পরি চোখের পলকে নেমে এলো ঝলমলে ওই চাঁদ থেকে।
আমি ভালোবাসি তার কথা গন্ধ-গুণপনা, সে বড় নিষ্পাপ,
শুধুমাত্র মোহ তাকে দূরবর্তী নক্ষত্রের কাছে নিয়ে যেতে চায়...
কৃষিবউ হেসে বললেন, চা খাবে,নাকি দক্ষিণের ব্ল্যাককফি।
আমি চা কফি দুই ভালোবাসি । আমি ওর নাম জানি
তবু ডাকি কৃষিবউ বলে ডাকি,কেননা এমন লিরিকস আমি আর কোথায় পাবো!
কৃষিবউ কতো গর্ব তোমার, তুমি কৃষকের বউ তোমার স্বামীর ঘোড়াগাড়ি,
ফলের বাগান। নিজে কথা বলেনা কখনো, শুধু ছুটে যায়...
আমি সাধারণ ফ্যাকাল্টি, কবিতাও লিখি মাঝে মাঝে আর কৃষিবউ
কথাসাগরের নৌকো হয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার স্বচ্ছল সংসার
জলে আমি মিষ্টি জলের মাছ, গাঢ় লোনা জলে অতি কষ্টে পান করি ব্ল্যাককফি,
আর কেন কষ্ট পাই ভিতরে ভিতরে , কৃষিবউ? তোমার ঔজ্জ্বল্যে আমি কি ঈর্ষান্বিত?
তবে উচ্চকিত এই ভেবে, আমিও কৃষক হবো, আমিও ট্রাক্টর নেবো দিগন্তের মাঠে...
এবার উৎসবে আমার নন্দিনীও যাবে কালিঝোরা-লাটপাঞ্চোর
কৃষিবউ বলো, তোমার অলক্ষ্যে যদি স্বপ্ন দেখি,শুধু স্বপ্ন, শুধু স্বপ্নের ঢেউ
ডালা খুললাম ফ্রিজটির ঠান্ডা শীত শীত বরফের ক্রিম
বুঝি নাকে চোখে মুখে কেউ লেপটে থেবড়ে দিয়েছে
যেমনটি কমেডি সিরিয়ালে দেখি ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.