পাড়ায় আমি প্রতিদিন আসি। গলির মোড়ে গীতা মাসিদের বাসার সামনে বসার যে জায়গাটা সেখানে বসে আড্ডা দেই।কখনো কখনো গীতা মাসি ডেকে পাঠায়,চা খাওয়ায়।পাড়ার অনেক কথা গীতা মাসির গল্পে বেরিয়ে আসে,আমি শুনি।কখনো কখনো গীতা মাসি আমার ভবিষ্যত নিয়ে হাহুতাশ করে,উপদেশ দেয় তারপর কাঁদতে থাকে।গীতা মাসি আমার মার বান্ধবী আমার প্রতি তার স্নেহ অনেক বেশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার দুই ছেলের চেয়েও বেশি।গীতামাসির চিকন সুতার মতো পলা আলুভাজা আমার খুব প্রিয় তাই কোন কোন দিন চায়ের সাথে বেশ কিছু আলুভাজাও আমার কপালে জুটে যায়।এই গীতা মাসির কাছেই প্রথম বৈদেহীর কথা শুনি।বেশ কিছুমাস পর গীতা মাসির গল্পের রাজকন্যা বৈদেহীর সাথে আমার পরিচয় হবে।
শরতের আকাশ জুড়ে পেঁজা তুলার মতো মেঘ।নদীর পাড়ে কাশের বনে হাওয়ার দোল।বর্ষা শেষের সজীবতায় সবুজগাছপালা যেন টগবগে তারুন্য নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আমি হেঁটে যাই গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে।তখনো আমি জানিনা এই স্কুলটায় বৈদেহী পড়ায় অথচ আমি স্কুলটার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে জয় গোস্বামীর বেনীমাধব আওড়াই আপনমনে।আমার তখনো জানা নেই বৈদেহী সাহিত্যের ছাত্রী। বৈদেহীর সাথে আমার এখনো পরিচয় হয়নি।অথচ রোজ বিকেলে সাদামাটা সাজে কাঁধে কালোব্যাগ খুব মার্জিত শাড়ি,মুখে একরাশ গাম্ভীর্য নিয়ে যে মেয়েটি গলি দিয়ে ঢুকে যায় বিবর্ণ সাদা বাড়ীটির ভেতর অনেক পরে জেনেছি সে মেয়েটি বৈদেহী,আরো অনেক পরে জেনেছি গাম্ভীর্যের নীচে তার দুঃখের কথা।তারও অনেক পরে খুঁজে পেয়েছি বিবর্ণ চুনরঙের মাঝে ছোপ ছোপ বেদনার ফ্যাকাশে নীল।
শরতাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা,বলা নেই কওয়া নেই ঝুম বৃষ্টি।চোখ ঝাপসা,ঠোঁটে জীবনানন্দের বনলতা সেন।কে জানতো এমন দিনে বৃষ্টিভেজা কোনো জীবন্ত বনলতা রিক্সা থেকে নামবে কাকভেজা হয়ে আর তার শ্রাবস্তীর কারুময় মুখে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু জলে মিশে থাকবে গোপন কান্নারা সংগোপনে। বৈদেহীর সাথে এখনো আমার দেখা হয়নি।তবু আমি গীতা মাসির মুখে শুনে শুনে বৈদেহীকে অনেক বেশি চিনি এবং জানি।যদিও সংশয় থেকে যায়, কতটুকু?তবুও আমি আনমনে বৈদেহীর পাশে দাঁড়াই নির্মলেন্দু গুণ তন্নতন্ন করে বলি-'বলছি না ভালোবাসতেই হবে।'ওর ভাই হারানোর দুঃখে অসুস্থ বাবার পাশে মায়ের উদ্বিগ্নতা,মার সযত্নে গড়ে উঠা বৈদেহীর চোখ জুড়ে দিদার স্নেহ ভালোবাসার আড়ালে যে নীল বৈদেহীর বাস আমি তাকে ছুঁয়ে যাই বারবার।কিন্তু কি আশ্চর্য এখনো বৈদেহীর সাথে আমার সরাসরি দেখা হয়নি,কথা হয়নি অথচ স্বপ্নে বহুবার।
শিউলি ফুলের গন্ধ মাখা সকাল।এমন সকালগুলোয় কেমন যেন অচেনা অজানা একটা মন কেমন কেমন করা অনুভূতি ছড়িয়ে থাকে।বৈদেহীর সাথে আমার এখনো দেখা হয়নি।তবু গত রাতে একটা কবিতা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো এটা বুঝি আমার কথা ভেবেই শৌনক দত্ত লিখে গেছেন।বৈদেহীকে আমি এমন কথাই হয়ত বলবো কিংবা বলতে চাই।শৌনক দত্ত তনু র কবিতাটা চোখের সামনে মেলে ধরি- যদি কোনোদিন ইচ্ছে হাওয়ায় তুই মরে যাওয়া চিঠির খামে ছুঁয়ে থাকার ঘোরে,অক্ষরে পায়ে-পায়ে ফিরে আসিস রাতজাগা চোখে যদি আসিস কোনোদিন নেশাতুর লেখার টানে গাছের ছায়ার নীচে চুপচাপ বহুদূর ধুলোবালি পথ ও পথিক চয়িত ফুল রক্তিম যীশুর বেশে যদি রবিপরিক্রমায় কোনোদিন ঝিঁঝিঁ পোকার কাছে রাতকে রেখে আবছায়া অনুরাগ নিয়ে ডেকে যাস ভেজা চোখে যদি কোনোদিন পাতায় পাতায় ছবি ফুটে ওঠে শ্রান্ত জলের গভীরে যদি কোনোদিন আমি নেই কোথাও মরা নদীদের মতো তুই আসিস যদি তখন কোনোদিন উজাড় করা রঙের আকাশ কেড়ে নেয় যদি কংক্রিট নগরী বারুদগন্ধ নিয়ে যদি জেগে থাকে আধমরা মানুষের দল সেখানেই খুঁজিস বুকের উঠোন আর্দ্ররেখার উন্মনা উপহার তোকে লেখা আমার তাবত কবিতা অস্ফুটে,অজ্ঞাতে! আজকের বিকালটা যে আমার জন্য একটু অন্যরকম হবে তা জানা ছিলো না।গীতা মাসি যখন ডাকলেন তখনো আমি জানিনা ব্যতিক্রম কিছু আজ হতে যাচ্ছে।এখনো সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসেনি চারিদিকে,আবছায়া ধুসর আলো।আড্ডার ফাঁকে গীতা মাসি ডেকে উঠলেন।বৈদেহীর ছাত্রছাত্রীদের ছুটি হয়ে গেছে পাখির মতো তারাও ফিরছে।বৈদেহীর সাথে এখনো আমার পরিচয় না ঘটলেও তার ছাত্র ছাত্রীরা আমার বেশ পরিচিত।গীতা মাসির ডাকে ঘরে গিয়ে যা শুনলাম তা আজকের বিকাল ও সন্ধ্যাকে করে তুললো অন্যরকম একটা দিনে।গীতা মাসি চায়ের সাথে আজ যে কাঁদলেন তা আমার সাথে বৈদেহীর তুলনা করে।বৈদেহীর মতো একা একটা মেয়ে বাবার অসুস্থতা,মার উদ্বিগ্নতা বুকে চেপে নিজের সাধ আহ্লাদ দূরে রেখে সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে সকাল থেকে বিকাল স্কুলে পড়িয়ে আবার বাসায় ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছে আর সেখানে আমি বাউন্ডুলের মতো সারাদিন রাত আড্ডা আর কবিতা নিয়ে কাটাচ্ছি।আজ গীতামাসি এই তুলনা করে যখন কাঁদলেন তখন মনে হলো একটা মেয়ের এত ভাল হবার,এত সংসার নিয়ে ভাবার কি এমন প্রয়োজন ছিলো?এই প্রথম বৈদেহীর উপর আমার খুব রাগ হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এখন রাত।মোড়ের মুদিখানা পেরিয়ে একবার মনে হলো বৈদেহীদের বাসায় ঢুকে যাই কিছু বলে আসি বৈদেহীকে।কয়েক পা এগিয়ে ফিরে এলাম ছোট্ট খয়েরী রঙের গ্রীলের পাশে কে যেন ছিলো বৈদেহী নয়ত?অন্ধকারে দাঁড়ানো বৈদেহীকে আমি হয়ত ঠিক ঠাহর করতে পারিনি কিন্তু স্ট্রীটলাইটের আলোয় বৈদেহী তো নিঃশ্চয় আমাকে দেখেছে।তখন লজ্জায় মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করলেও কিছুটা ভালো লাগছিলো এই ভেবে বৈদেহীকে তো দেখলাম,সেও দেখলো।যদিও পরে জেনেছিলাম বৈদেহী সেখানে ছিলো না সেইদিন।
নীল আকাশের বুকে ছানার মতো মেঘ।কয়েকটি চিল নীল মাখবে বলে যেন পাখা মেলে উড়ছে।একঝাঁক চড়ূই কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেলো।বৈদেহীর প্রতি রাগটা অনেক কমে এসেছে।গীতা মাসির সেদিনের কথার পর গত এক সপ্তাহ আমি ঐ দিকে যাইনি।এর মাঝে একদিন আমি বৈদেহীকে দেখছি তার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।খুব ইচ্ছে করছিলো গিয়ে বলি,তুমি বৈদেহী?আমার নাম পুরাণ।গীতামাসিদের বাসার সামনে বসি।আমি তোমার সব জানি এমন কি আজকের আকাশের মতো তোমার যে নীল তুমি তোমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখো আমি সে নীলের কথাও জানি।কিন্তু তখনই রিক্সায় চেপে বেরিয়ে গেলো বৈদেহী।বৈদেহীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার আনমনে হেলাল হাফিজ বলে উঠলেন-'নিউট্রন বোমা বোঝো মানুষ বোঝো না।' বৈদেহীর সাথে আমার পরিচয়টা এখনো হয়নি।অথচ কখন যেন মনের কোণে বৈদেহী তার জায়গা করে বসে গেছে।স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের যেমন হয় পছন্দের মানুষটিকে একটু দেখবে বলে সুযোগ খোঁজে আমার অবস্থাও এখন তেমন।আমার চরিত্রের সাথে কিংবা বয়সের সাথে
যা যায়না আমি এখন তাই করছি।রোজ সকালে স্কুল শুরুর আগে আর বিকেলে স্কুল ছুটির পর আমি বৈদেহীর স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।বৃষ্টির প্রার্থনা করি বৃষ্টি ভেজা বনলতা থুক্কু বৈদেহীকে দেখবো বলে।কিছুদিন আগেও যদি আমায় কেউ বলতো ভালোবাসায় মানুষ এমন অবুঝ হয়ে ওঠে নির্ঘাত তাকে আমি হ্যাবলা নয়ত গাধা বলতাম।আমার এই অবস্থা কেউ না জানলেও গতকাল একবন্ধু স্কুলের সামনে দেখে বেশ অবাক হয়ে বললো'কি রে তুই এখানে কি করিস আরে ব্যাটা সময় মত বিয়ে করলে তোর মেয়ে এখন এখানে পড়তো আর তুই ব্যাটা এখানে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের সাথে টাংকি মারতে চাস।কি লজ্জার কথা চল শালা।'বন্ধুটিকে বলতে পারিনি বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো না রে আমি বৈদেহীকে দেখতে ওখানে দাঁড়াই। বাবার অসুস্থতা।মা ও দিদার কাছে বড় হওয়া বৈদেহীর মাঝে উচ্ছ্বলতা অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে অনেক কম।তার একটা কারণ হতে পারে বাবার কাছ থেকে যতটুকু আদর যত্ন পাওয়ার কথা তা বৈদেহী পায়নি।বৈদেহীর চোখে তাকালে আমার বারবার মনে হয় বৈদেহীর চোখ যেন রবীন্দ্রনাথ আমার আগেই দেখেছেন আর তাই লিখেছিলেন'চোখে আমার তৃষ্ণা'। দুপুর গড়িয়ে বিকাল।কমলারঙা আভায় পশ্চিমের আকাশকে ম্লান করে সন্ধ্যা নামছে।দিনের শেষে পাখির ডানায় যতটুকু ক্লান্তি থাকে তার সব মুছে জ্বলে উঠছে স্ট্রীটলাইট।
কয়েক রাতের বিনিদ্র চোখে যেভাবে ঘুম আসে।যেভাবে সুখস্বপ্নে রাত কেটে ভোর হয়।তেমনি করেই প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছি।এ কয়টা লাইন লিখে মনে হলো বড্ড বেশি ছেলে মানুষী হচ্ছে।এ চিঠি বৈদেহীর ব্যক্তিত্বকে যদি আঘাত করে।ছিঁড়ে ফেলি চিঠি,উড়িয়ে দেই হাওয়ায়। বৃষ্টি নামে।শরতের এই দিনে বৃষ্টি বর্ষার মতো মায়া ছড়ায় না তবু আমার ভালো লাগে কেননা বৈদেহীকে প্রথম দেখেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজে রিক্সা থেকে নামতে।পরে অবশ্য জেনেছিলাম বৃষ্টি বৈদেহীর খুব প্রিয়।বৃষ্টি মাথায় করে বের হতে মন চায় না।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হলো বৈদেহীর স্কুল ছুটি হবে এখন।যদি বৃষ্টিতে বৈদেহী রিক্সা না পায়।ক্যামেলিয়া কবিতা মনে মনে বলতে বলতে গিয়ে দূর থেকে দেখি বৈদেহী সত্যিই রিক্সার জন্য এদিক ওদিক তাকিতুকি করছে।নিজেকে প্রস্তুত করি কি বলবো।বৈদেহীর সামনে গিয়ে রিক্সা থামাই।এতদিন যাবত কিংবা একটু আগেও যত কথা বলেছি বলবো বলে অবিশ্বাস্য ভাবে আমি তার একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারিনি।বোকা হ্যাবলা পাঁঠার মতো রিক্সা থেকে নেমে পড়ি।রিক্সাওয়ালার অদ্ভুত চাউনি আমার দৃষ্টি এড়ায় না।আমি মন্ত্রপুত মানবের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভাড়া মিটিয়ে দিলে স্কুল গেটের ছাউনি থেকে দৌঁড়ে বৈদেহী রিক্সায় চেপে চলে যায়।আমার মনে হয় চোখের সামনে দিয়ে প্রজাপতি উড়ে গেলো।ঘোর কেটে গেলে আমার নিজেকে বড় বেশি বোকাবোকা লাগে আর তখনই খেয়াল হয় রিক্সায় আমার ছাতাটা রয়ে গেছে।
সেদিনের বৃষ্টিতে ভিজে খুব জ্বর এসেছিলো জ্বর থেকে উঠে নয়দিন পর আজ আবার বেরিয়েছি।দুপুরের রেশ এখনো কাটেনি,রাস্তা প্রায় ফাঁকাই বলা যায়।এই কয়দিন শুয়ে থেকে বেশ কিছু বই পড়া হয়েছে কিন্তু মনটা পড়েছিলো দৌঁড়ে যাওয়া বৈদেহীর কাছে।এতদিন ধরে আমি গীতামাসির বাড়ী যাইনা বৈদেহী কি আমাকে মনে মনে খোঁজে কিংবা কারো কাছে কি আমার কথা জানতে চেয়েছে?আমার নিজের ভাবনায় নিজেরই হাসি পায়।বৈদেহী তো আমাকে চেনেই না।তবুও নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেই হয়ত চেনে।এতদিন ওপাড়ায় যাই ধুলোবালিগুলো পর্যন্ত চেনে জানে।বৈদেহী এটলিস্ট নাম না জানলেও মুখটা তো চেনে।পরক্ষণেই হতাশ হই এই ভেবে বৈদেহী কোনদিন আমাদের আড্ডার দিকে ফিরেও তাকায়নি কোনো দিন মুখ চিনবে সে আশাও ক্ষীণ। বৈদেহীর স্কুল ছুটি হয়েছে।এক পলক স্কুল গেইটের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকি।বৈদেহীকে দেখতে একটু দাঁড়াবো নাকি ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমার বন্ধুর সেই বলা কথাগুলো কানে বাজে।হাঁটা থামিয়েও আবার হাঁটতে থাকি। -এই যে শুনছেন? আবেগী ডাকটা কানে আসে।ইশ যদি এভাবে বৈদেহী আমায় একবার ডাকতো কোনোদিন। -এই যে শুনুন। মেয়েটার মিষ্টি ডাকটা যতবার শুনছি বৈদেহীকে তত অনুভব করছি।আর মনে মনে ভাবছি।যাকে মেয়েটি এভাবে ডাকছে সে যদি ছেলে হয়,ছেলেটা খুব লাকি তখনই মনে হলো যদি ছেলে হয় ছেলেটা একটা গাধা।এভাবে একটা মেয়ে ডেকে যাচ্ছে গদর্ভ একটু দাঁড়িয়ে পিছনে দেখ।আমার মনে হলো আমার সামনে হেঁটে যাওয়া ছেলেটিই হয়ত সেই গাধা।নাকি পেছনেও কেউ আছে।থেমে গিয়ে ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখলাম কেউ নেই হাঁটতে শুরু করতে গিয়ে মনে হলো বৈদেহী দৌঁড় আর হাঁটার মাঝামাঝি এক গতিতে এদিকেই আসচ্ছে। -আরে দাঁড়ান,দাঁড়ান। আমাকে ডাকছে বৈদেহী!নয়দিন পরেও কি আমার জ্বরের ঘোর কাটেনি,নাকি মাথায় বৈদেহী ঘুরছে বলে সিনেমার মতো সবকিছুতেই বৈদেহী দেখছি। -একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে।আপনি সেদিন বৃষ্টির সময় স্কুল গেইটে নেমে গেলেন তার পর থেকেই আপনাকে খুঁজচ্ছি। মনে মনে ভাবলাম এটা তো ঘোর নয়।বাস্তব কিন্তু আমি এমন কি করলাম যার জন্য আমাকে বৈদেহী খুঁজচ্ছে।হেসে বললাম কেন রিক্সার জন্য ধন্যবাদ দেবেন বলে বুঝি? -না,আপনার ছাতার জন্য -আমার ছাতা মানে?এই ক'দিনে আমার খেয়ালই ছিলো না সেইদিন রিক্সায় আমি ছাতা রেখেছিলাম যা বৈদেহী চলে যাওয়ার পর মনে হয়েছিলো। -সেদিন রিক্সায় রেখে গেছিলেন। -ও হ্যাঁ হ্যাঁ,আপনি পেয়েছেন বুঝি? -হুম।তা এ কয়দিন গীতাদির ওখানে যাননি যে? -জ্বর ছিলো। -এই নিন আপনার ছাতা ছাতাটা হাতে দিয়ে একটা রিক্সা থামিয়ে বৈদেহী উঠে পড়লো।হুডটা তুলতে তুলতে একটা হাসি দিয়ে বললো বৃষ্টি যখন গায়ে সয় না তখন এত বীরপুরুষ সাজার কি দরকার ছিলো।হি..হি..হি..রিক্সা চলে যায় আমি ছাতা হাতে হাঁটতে থাকি আর কানে বাজতে থাকে বৈদেহীর হাসি আর কথা'বৃষ্টি যখন গায়ে সয় না তখন এত বীরপুরুষ সাজার কি দরকার ছিলো।'
গতকালের ঘটনাটা এখনো আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না।সারারাত ঘুমাতে পর্যন্ত পারিনি।বারবার ছাতাটা নাড়ছি শুঁকছি মনে হচ্ছে বৈদেহীর স্পর্শ নয় বৈদেহী লেগে আছে। বিকাল গড়িয়ে এলো।এই প্রথম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো লুকটা একটু চেঞ্জ করা দরকার।এলোমেলো চুলগুলোকে কতদিন পরে যে চিরুনী দিলাম মনে করতে পারলাম না।আলমারী খুলে মনে হলো আমার ভালো কোনো ড্রেস নেই পড়ার মতো।অনেক গুলো জামা এলোমেলো করে আকাশীরঙের শার্ট পড়ে বের হলাম।নিজেকে একটু বোকা বোকা লাগলেও মনে মনে বেশ হিরো হিরো অনুভূতি।বৈদেহীর স্কুলের দিকে হাঁটছি গতকাল অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে বৈদেহীকে ধন্যবাদটা দেয়া হয়নি। স্কুল ছুটি হয়েছে।ছাত্রীরা সব বের হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেও শীতল স্কুলটা এখন কথায় কথায় মুখোরিত যেন রাতের আঁধার কেটে ভোরের পাখিদের উড়ান কলতান।আমার বুকের ভেতর ঘন্টা বাজচ্ছে গলা শুকিয়ে আসচ্ছে।স্কুল দালান পেরিয়ে সমুদ্রনীল শাড়িতে গেইটের দিকে এগিয়ে আসচ্ছে বৈদেহী।কথাগুলো যত গুছিয়ে নিতে চাইছি ততই গুলিয়ে যাচ্ছে।গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো বৈদেহী মনে হলো আমায় একপলক দেখলো।রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম।
-কাল ছাতার জন্য আপনাকে ইয়ে মানে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। বৈদেহী একটু হাসলো তারপর ধীর গলায় বললো,ইটস ওকে।তা বীরপুরুষ এত সাজুগুজু করে কোথায় যাচ্ছে?পাত্রী দেখতে? -না,মানে ইয়ে আপনাদের দিকেই যাচ্ছি। -তা এতো সাজুগুজু কেন? -এমনি।অনেকদিন এগুলো পড়া হয়না তো তাই আজ পড়লাম। -বেশ।তবে কি জানেন আপনার ন্যাচারাল লুকটাতেই অনেক হ্যান্ডসাম লাগে আপনাকে। বৈদেহী হাতের ইশারায় একটা রিক্সা ডাকলো। -হাঁটলে হয় না।মানে আপনার যদি কোন সমস্যা না থাকে। -আপনার জ্বরের খবর কি? -সেরে গেছে। -হুম।এবার একজন পাগলের ডাক্তার দেখান। -কেন?আমাকে কি পাগল মনে হচ্ছে? -পুরোপুরি না,তবে কিছুটা।কথাটা বলেই হাসতে হাসতে রিক্সায় উঠে গেলো বৈদেহী। মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো।আমি পাগল!সত্যিই কি আমি পাগল?কিন্তু কাকে জিজ্ঞাস করি।কাউকে তো বলা যাবেনা বৈদেহী আমাকে পাগল বলে গেছে।গতরাতে লেখা কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করলাম- আজ আমি খুন হয়ে যাবো গোপনে সব নষ্টা দিনের চাঁদ ফেসবুকের ওয়েবক্যামেতে রেখে গভীর ও গোপন অসুখগুলো রক্তের বানে একগুচ্ছ গোলাপ হবে আজ আমি খুন হয়ে গেলে বিমানের হেডলাইটে রেখে যাবো মনের কথা,সাদা থান আজ
আমি ঘুমিয়ে যাবো তীব্র পাগলামিতে পাখির ডানায় পাগলী,তুই থাক সদ্য ভাঙা এরিকসন মিনি প্রো মোবাইলে মিসড কলে আমি আজ খুন হয়ে যাবো ব্যাগ ভর্তি অভিমান আর মিশরীয় নীল চুম্বনে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিতে ভুল ঠিকানায়,ভুল বিপ্লবে..! হুবুহু মনে পড়লো,পাগলরা কি কবিতা লেখে!লিখলেও কি এভাবে হুবুহু সব মনে করে বলতে পারে?গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলাম।এই জট বৈদেহীই খুলতে পারবে।নাকি পাড়ার মোড়ের পাগলা দাদুর কাছে যাবো?সব গুলিয়ে যাচ্ছে কানের কাছে কেবল শুনছি- 'এবার একজন পাগলের ডাক্তার দেখান।'
রিক্সায় ফিরতে ফিরতে বৈদেহীর মনে হলো গত দুই দিনের অস্বাভাবিক এই আচরণ তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না।তার এই অস্বাভাবিকতা কি অন্যকিছু ইংগিত করছে?কোথাও ছেলেটি কি তার মনের কোণে দাগ কেটে আছে।কিন্তু নামটাই তো জানা হলো না।নাম না জানা একজন কে বীরপুরুষ বা পাগল বলা কি ঠিক হলো?হাসিখুশি মুখটায় বর্ষা দিনের মতো বিষন্নতা ছেয়ে গেলো।একরাশ দ্বিধার সাথে বাড়ি ফিরলো বৈদেহী। সন্ধ্যায় আমার ডাক পড়লো।গীতামাসি আমায় দেখে বেশ উচ্ছ্বাসিত। -এই তো আজ তোকে দেখতে রাজপুত্তরের মতো লাগছে।কি একটা পাগল পাগল চেহেরা বানিয়ে রাখিস সবসময়। আমার মনের জিজ্ঞাসাটা আবার জেগে উঠলো।তোমার কি মনে হয় আমি পাগল? -বালাই ষাট তা হবি কেন? -এই যে বললে তুমি। -আরে পাগল সেটা তো তোর বেশভূষার কথা বললাম।তা এতদিন আসিসনি যে,রাগ হয়েছে? -না।জ্বর ছিলো না,তাই আসিনি।আচ্ছা মামন,না থাক। -কী? -না,কিছু না।
-বল,কি বলতে চাইছিলি? -আলু ভাজা খাওয়াবে আজ। -সে খাওয়াবো।কিন্তু তুই অন্যকিছু একটা বলতে চেয়ে থেমে গেছিস।সেটা বল আগে। -না তো এটাই বলতে চেয়েছিলাম। -পুরাণ,তোকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু তোকে তোর মা র চেয়ে আমি কম চিনি না।কি হয়েছে বল বাবা? গীতামাসিকে বলাটা কি ঠিক হবে?অনেক ভেবে চিন্তে বলেই ফেলাম।মামন তোমার বৈদেহী কিছুক্ষণ আগে বললো আমার নাকি পাগলের ডাক্তার দেখানো দরকার।তার মানে কি আমি পাগল। গীতামাসি একটু গম্ভীর হয়ে হেসে উঠলো।তা তুই বৈদেহীকে কোথায় পেলি। -ওর স্কুলের সামনে। -তা বৈদেহীর স্কুলে তুই কেন গেলি? -ধন্যবাদ জানাতে। -তুই তো ওকে চিনিস না।তো ধন্যবাদ জানাতে মানে? -ধুর!তোমাকে বলাটাই ঠিক হয়নি।উকিলের মতো জেরা করছো। -বারে কাল যদি বৈদেহীর মা কিংবা বৈদেহী এসে বলে তুই বৈদেহীকে বিরক্ত করছিস।তখন আমি কি বলবো?কি মুখ দেখাবো?তুই তো এমন ছিলিনা রে বলেই গীতামাসির আঁচল চাপা কান্না শুরু হয়ে গেলো। একটু উচুঁ গলাতেই বললাম।মামন আমি কান্নাকাটির মতো কিচ্ছু করিনি।সেদিন ভুলে ছাতাটা ফেলে গেছিলাম বৈদেহী পেয়ে ফেরত দিয়েছে তাই ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম আপনার সমস্যা না থাকলে চলুন হাঁটি আর বৈদেহী রিক্সায় চেপে বসে বললো মাথার ডাক্তার দেখাতে ব্যাস। অবাক কান্ড কান্না থামিয়ে গীতামাসি হেসে উঠলো।আমার পাগল ছেলে তুই যে কবে বড় হবি।একজন স্কুলশিক্ষিকা স্কুলের সামনে একজন অপরিচিত কিংবা পরিচিতের সাথে হেঁটে আসবে এটা ভাল দেখায় কি?পাগল -কিন্তু মামন জয় গোস্বামী যে লিখেছেন 'দিদিমনির পাশে দিদিমনির স্বামী' -ধ্যাত।বলে হাসতে হাসতে মামন কিচেনে ঢুকে গেলো। আমারও খুব হাসি পেলো।বৈদেহীর মুখটা ভেসে উঠলো,কানে বাজলো বৈদেহীর কন্ঠ 'বীরপুরুষ'।
তুমি এলে মাটি কেঁপে ওঠে হাওয়ার আবির সামনে পেছনে মাঠ মাঠ আর মাঠ মাঠের ওপারে নামে সন্ধ্যা আর সেঁজুতির বারণ, তরাস দুলে ওঠে ঘর বাড়ি চোখের পাতায় তমিস্ত্রা ভাঙার দারুণ আহ্বান তুমি এলে শহর সাজিয়ে রাখি রাত্রি হীনযান
২।
তোমাকেই ছুঁয়ে বসে থাকি নিষ্পন্দ শরীরে বরফের কুঁচি আকাশ আবার এক অন্ধকার নিয়ে দ্রাঘিমায় লাফ দিল আগুন বলয়ে কারা খুঁজেছিল নাভি, প্রিয়তমা নারী ? আমি তবু অন্ধকারে শব্দের কাণ্ডারী ! বিদিশা সরকারের এই কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হলো আজ যদি বৈদেহীকে দাঁড় করিয়ে বলি,প্রিয়তমা নারী ? আমি তবু অন্ধকারে শব্দের কাণ্ডারী!বৈদেহী কি বুঝবে আমার রাত জাগা চোখে ওর নিদারুন উত্পাত।বুকের ভেতর সাহস সঞ্চয় করি। স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটছি আবার দাঁড়াছি আসলে কি করবো বুঝতে পারছিনা।বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে আসলে এই বয়সে এসে ভালোবাসি কি বলা যায় এটা কি শোভনীয় হবে?স্কুলের বেলের চেয়ে বেশি আওয়াজ এখন বুকের ভেতর।ঘুরে আবার হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়িয়েছি স্কুল গেইটের পাশে।'আরে দাদা এখানে প্রায়ই দেখছি ব্যাপারটা কি?'দারোয়ান এর কথায় ভড়কে গেলাম।কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে একটু গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলাম দিদিমনির সাথে একটু কথা আছে।দারোয়ানটা আরো কিছু হয়ত বলতো তক্ষুনি কলাপাতা রঙের শাড়িতে বৈদেহী একপলক তাকিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলো।বৈদেহীর এই আচরণটা ঠিক মাথায় ঢুকলো না।মন বললো হয়ত দেখেনি কিন্তু চোখ বলছে দেখেছে। এই যে দাদা সব দিদিমনি তো বেরিয়ে গেছে আপনি কাকে খুঁজচ্ছেন বলুন তো? দারোয়ানের কথায় ঘোর কাটে আসেনি বোধ হয় আজ বলেই আমি হাঁটতে থাকি।বৈদেহী এমন করলো কেন? নিজের সাথে নিজের প্রশ্ন উওরের খেলা খেলতে খেলতে স্কুল পেরিয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে হাসপাতাল মোড়ের কাছে এসে দেখি বৈদেহী ট্রাফিক পুলিশের ডান পাশে কমিনিউটি সেন্টারের নীচে দাঁড়িয়ে আছে।পলকে মনে হলো এ প্রতীক্ষা আমার জন্য নয়।ইচ্ছে করেই একটু আড়াল করে দাঁড়ালাম।বৈদেহী ঘড়ি দেখছে আর রাস্তার এদিক ওদিক দৃষ্টি রেখে কাকে যেন খুঁজচ্ছে।আমার খুব কষ্ট লাগছে বুকটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এলো।বৈদেহী এই জন্যই আজ আমায় দেখেও দেখেনি?কার জন্য আজ এতটা পথ হেঁটে এসেছে বৈদেহী?কে সেই যুবক যার জন্য বৈদেহীর চোখ প্রতীক্ষা করছে?আমার মনে তখন জীবনানন্দ দাশ কথা বলে ওঠেন 'ফিরে এসো এই মাঠে,ঢেউয়ে, ফিরে এসো হৃদয়ে আমার দূর থেকে দূরে-আরো দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।'
বৈদেহী রাস্তা পার করে আমার দিকেই আসচ্ছে।আশপাশে বেশ কয়েকজন রয়েছে।এদের কাউকেই কি এক্সপেক্ট করছিলো বৈদেহী।আমি ছাড়া আরো চারজন এখানে তার মধ্যে ব্ল্যাক টি শার্টে চোখে রেবনের স্নানগ্লাস পড়া ছেলেটাকে আমার বেশ লাগলো।ছেলেটা মাত্র এসে দাঁড়ালো।মন বললো এই ছেলেটাই হবে।একটা অজানা কষ্টের মাঝেও আমার কেন জানিনা খুব ভালো লাগা কাজ করছে।বৈদেহীর রুচির দাদ দিতে হবে।গুড চয়েস।একটু সরে গিয়ে ওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। গীতামাসিকে এই ঘটনাটা বলতে হবে।না,বলা যাবে না।মামন জেরা শুরু করবে।এতক্ষণে নিশ্চয় ওরা চলে গেছে।ঘাড়টা আলতো ঘুরিয়ে দেখলাম ছেলেটা নেই।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াতেই ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলাম। -আ..আপনি এখানে? -হুম। -বাসায় যাননি এখনো? -না। -কেন,কোনো সমস্যা ?
-না।আপনাকে আমার কিছু বলার ছিলো। আমার মনে বাহারী রঙের বেলুনের ওড়াউড়ি।বৈদেহী কি আমার বলতে চাওয়া কথাটাই আমাকে বলতে চাইছে? -এখানে এভাবে কথা না বলে,কাল তো ছুটি আমরা কোথাও মিট করি।নদীর পাড়ে বিকেলে।কিংবা অন্য কোথাও। -না। -দেখুন বৈদেহী এখানে অনেকে দেখছে।কেউ কিছু ভাবতে পারে। -আপনি
সেটা বোঝেন? কথাটার মাঝে কেমন জানি একটা ঝাঁঝ ঝরে পড়লো।
-শুনুন মিস্টার। -পু..পুরাণ।আমার নাম পুরাণ।আমি বুঝতে পারছি আপনি কি বলতে চাইছেন।এখন রাগের মাথায় ঐ কথাটা নাই বা বললেন। -আই এম সরি।মানছি আপনার সাথে ঐভাবে কথা বলা উচিত হয়নি দুদিন।কিন্তু তাই বলে রোজ এভাবে বাচ্চা ছেলেদের মতো আপনি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন?আজ দারোয়ান প্রশ্ন করেছে কাল অন্য কেউ জানতে চাইবে।এটার মানে বোঝেন? আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।বৈদেহীর দিকে তাকাতে পারছিলাম না।বৈদেহী ক্ষাণিক দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। -বৈদেহী কাল বিকালে আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।আমি জানি কাল বিকাল চারটায় আপনি আসবেন ব্রীজের কাছে। বৈদেহী ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে রিক্সায় চেপে বসলো।আমার এত আত্মবিশ্বাসী কথাগুলো কি আমিই বলেছি।আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না কিছুতেই ।
এই প্রথম আমার মনে হলো সময় খুব ধীরে চলছে অথচ কাল ও আমার মনে হতো সময় খুব দ্রুত পালাচ্ছে আমার কাছ থেকে।অন্যসব ছুটির দিনের চেয়ে আজকের দিনটা আমার জন্য অন্যরকম।আজ বিকেল চারটায় বৈদেহী আসবে তো?মন সায় দেয়।বৈদেহী আসবে।সকালের রোদের মতো আমার চোখে মুখে আলো। বৈদেহীর কানে গতকাল থেকেই শুধু একটি কথা বাজচ্ছে'আমি জানি আপনি আসবেন'কিসের টানে,কোন অলৌকিক শক্তি পেলে একটি সদ্য পরিচিত মানুষ এত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে?বৈদেহী কোনভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না।কাল সারা রাত তার চোখে ঘুম আসেনি।জীবনের কোন সিদ্ধান্তই সে একা নেয়নি।তার মা ও দিদা তার সিদ্ধান্তকে দৃঢ় করেছেন।আজ কি
করবে বৈদেহী।মা কে বলবে?কিন্তু কি বলবে?তার চোখে মুখে যে অস্থিরতা।মা কিকিছু বুঝতে পেরেছে?নিজেকে সহজ রাখার চেষ্টা করে বৈদেহী।সময় এত দ্রুত ছুটছে।সময় যত যাচ্ছে বৈদেহীর অস্থিরতা তত বাড়ছে।মা কে বললে মা কিভাবে নেবে বিষয়টা বৈদেহী ভেবে পায় না।নিজের ওপর তার রাগ হয়।কি দরকার ছিলো দুদিন এভাবে ইয়ার্কি মারার?ইয়ার্কি মেরে ছিলো তো ছিলোই কাল এভাবে অপেক্ষা করে কথা না বললে তো এতটা সাহস পেতো না পুরাণ।বৈদেহীর কান্না পায়। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।তারপরই বৈদেহীর মুখোমুখি দাঁড়াবো আমি।ভাবতেই কেমন শিহরণ জাগছে।মনে মনে আমি কথা সাজাই!বৈদেহীকে নিয়ে কোথায় বসবো ঠিক করি।বৈদেহীও নিশ্চয় আমার মতোই কথা সাজাচ্ছে।নিজের সাথে নিজে বাজী রাখি।বৈদেহী আজ শাড়ী পড়বে না সালোয়ার?কি হবে তার রঙ?ফেরার সময় কি বৃষ্টি হবে এক পশলা,একসাথে ভিজে ফিরতে ফিরতে কি আপনি শব্দটা ধুঁয়ে তুমি হবে কিনা?নিজের ছেলেমানুষীতে নিজেই একা একা বোকার মতো হাসি। মা র প্রশ্নে বৈদেহী নিরুত্তর।কি করবে বুঝতে পারেনা সে।মা কে কিভাবে বলবে সে গত কয়েকদিন আগে ছাতা ফেরত দিতে গিয়ে সে দুইদিন একটা ছেলের সাথে ইয়ার্কি মেরেছে,গতকাল তার নাম জেনেছে।আজ তার সাথে দেখা করতে বলছে সেই ছেলে।না,এটা মা কে বলা যাবে না।তবে কি বলবে পুরাণ নামের একটি ছেলে প্রতিদিন তার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।আজ একটু পরে গিয়ে তাকে কিছু বলতে যাবে সে।না,এটাও বলা ঠিক হবেনা তবে হয়ত মা ই ছুটবে পুরাণকে কিছু বলতে।কি বলবে বৈদেহী তার মা কে?কি উত্তর দেবে সে মা কে তার অস্থিরতার কারণ হিসেবে?নিজেকে এতটা অসহায় এর আগে আর কখনো লাগেনি বৈদেহীর। ঘড়ির কাটায় এখন তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট...
আমার সময় আজ কাটছে না কিছুতেই।দুপুরের খাওয়া শেষ করে।ঘড়িতে চোখ রেখে দেখি তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট।বেরিয়ে পড়া উচিত।ব্রীজের দিকে যাবো নাকি বৈদেহীর বাসা হয়ে তারপর ব্রীজের দিকে যাবো?ঠিক করতে পারিনা।যদি ঐদিকে গেলে বৈদেহীর সাথে দেখা হয় একসাথে অন্তত ব্রীজের দিকে গেলে কিছুটা সময় বেশী কাটানো যাবে।পরক্ষণেই মনে হয় ওর বাসার সামনে আমাকে দেখে যদি বৈদেহী গতকালের মতো রেগে যায়?থমকে দাঁড়াই।ফুলের দোকানের দিকে তাকিয়ে মনে হলো কিছু অর্কিড কিনি যদিও বৈদেহীর প্রিয়ফুল কি আমি জানিনা।কিন্তু মাথায় যখন অর্কিডের কথা এলো অর্কিডই নিলাম।সঙ্গে একবাক্স চকলেট আর কয়েকপ্যাক চিপস আর আফ লিটার কোল্ড ড্রিংক নিয়ে ব্রীজের দিকে হাঁটতে লাগলাম।বৈদেহী যদি আমার আগে পৌঁচ্ছে যায়,একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ওর হয়ত খারাপ লাগবে।মনে হতেই একটা রিক্সা ডেকে চেপে বসলাম। মা কে সত্যিটা বলতে পারেনি বৈদেহী।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বৈদেহীর অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো।সাড়ে তিনটার কাটা ছুঁই ছুঁই করছে ঘড়িটা।কি করবে বৈদেহী?নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে বৈদেহী সিদ্ধান্ত নিতে।কয়েক মুহুর্ত চোখ বুঝে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করে বৈদেহী কিন্তু চোখ দুটো বন্ধ করতেই পুরাণের মুখটা ভেসে উঠে তার বন্ধ চোখের অন্ধকারে।পলকেই আতংকিত চোখ খুলে বৈদেহী সিদ্ধান্ত নেয়।সে যাবে না।ঘরে এসে শুয়ে পড়ে।আবার উঠে বসে,মোবাইলটা হাতে নেয় কিন্তু তক্ষুনি মনে পড়ে তার কাছে তো পুরাণের সেল নম্বর নেই।কি মনে হয় কে জানে বৈদেহী তার ব্যাগ হাতড়ে একটি কয়েন বের করে। এই একটা কারণেই নিজেকে প্রেম ভালোবাসা থেকে এতদিন দূরে রেখেছি।অপেক্ষা আমার বড্ড অপছন্দের।স্কুল কলেজ লাইফে বন্ধুদের সাথে তাদের ডেটিং এ গিয়ে অপেক্ষা করার বেশ কিছু অভিজ্ঞতার পর আমি বন্ধুদের ঘোষনা দিয়েছিলাম এ জীবনে প্রেম ভালোবাসায় আমি নেই।যদি কোন দিন কোনো মেয়ে প্রোপজ করেও তবে ডেটিং এ আমি দেরীতে যাবো।ওদের মতো বক সেজে দাঁড়িয়ে থাকবো না কোনোদিন।আজ সেই আমি বক সেজে তালগাছের মতো এক পায়ে না হলেও দুপায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি।নিজের এই হাল দেখে নিজের প্রতি নিজেই বিদ্রুপের হাসি হাসলাম।
ঘড়িতে এখন বিকাল চারটা বিশ.. আমার আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা একটু একটু করে গলছে।গতকাল বিকাল থেকে আজ সারাদিনে এই প্রথমবার আমার মনে হলো বৈদেহী আসবে না।না আসার যথার্থ কারণগুলো নিজেকে যত বোঝাবার চেষ্টা করছি।আমার ভেতরে ততটাই মনখারাপের অন্ধকার নেমে আসচ্ছে।দূরে তাকিয়ে হাতের অর্কিড আর অন্যসব কিছুর দিকে তাকিয়ে মনে হলো চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসচ্ছে। চারটা বেজে তেতত্রিশ... আমার বুকের ভেতরটায় অচেনা আজানা এক শূন্যতা এতটা ফাঁকা আগে কোনোদিন লাগেনি।এমন কি গতকাল বিকালেও না।গত বিকালের কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো বৈদেহীকে তো আমি ব্রীজের এদিকে না ঐদিকে কিছু বলিনি।এমনো তো হতে পারে বৈদেহী আমার জন্য ব্রীজের ঐদিকটায় অপেক্ষা করছে কিংবা অপেক্ষা করে এখন ফিরে আসচ্ছে!পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ব্রীজের ঐদিকটায় এলাম।নেই।বৈদেহী কোত্থাও নেই। পাঁচটা বেজে পাঁচ... নীল ঝকঝকে আকাশটার ঈশান কোণে কখন মেঘ জমেছে খেয়াল করিনি।ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘে পশ্চিমের কুসুমরঙা আকাশ অদ্ভুত এক রঙে সেজেছে।ব্রীজটার ঐদিক থেকে এদিকে আসতে আসতে দেখছি সোনারঙের আকাশটা পলকে পলকে কালো হয়ে আসচ্ছে।
বৈদেহী টস করে!টসে হেরে যায় পুরাণ।এবার কিছুটা স্বত্তি ফিরে পায় বৈদেহী। শুয়ে পড়ে সে।পুরানের গতকালকে বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন চোখজুড়ে ঘুম নেমে আসে বৈদেহী বলতে পারেনা।কিছুক্ষণ পর লাফ দিয়ে উঠে বসে হাঁফাতে থাকে সে।ঘড়ির দিকে তাকায় বৈদেহী,ঘড়ির কাটায় চারটা বেজে ত্রিশ।তার চোখে মুখে অজানা এক আতংক।সে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখে নেয় একপলক।ঘরের কোথাও মা কে দেখে না বৈদেহী।রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে মা কে দেখে সে। তার চোখে মুখে গাঢ় অস্থিরতা। আমি বুঝে পাইনা।এখন আমার কি করা উচিত?ফিরে যাওয়া নাকি আরেকটু অপেক্ষা!ধীরে ধীরে আমি ব্রীজ পেরিয়ে আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম,সেখানে এসে দাঁড়াই। আমার যে মন একটু আগেও বলছিলো বৈদেহী আসবে,সেই মনটাই এখন আকাশের মত রঙ পাল্টে বলছে বৈদেহী আসবে না। হাতের জিনিষগুলো নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
কি করবো বুঝতে পারি না।যেখানে বৈদেহীকে নিয়ে বসবো ভেবেছিলাম,ব্রীজের পাশের সেই রাস্তাটা দিয়ে আমি নীচে নামতে থাকি।কাশ ফুলের ঝুপটার কাছে এসে মনে হলো। হাতের অর্কিড আর বাকীসব এখানে ফেলে দেয়াটাই ভালো।সবকিছু ঝুপটার কাছে ফেলে রেখে আমি কাশফুলের ঝুপটা পেছনে রেখে এগিয়ে যাই নদীর দিকে। বৈদেহী যা কোনদিন করেনি আজ সে সেটা করলো।মা কে মিথ্যা একটি জরুরী কাজের কথা বলে সে বেরিয়ে পড়লো।মনে মনে তার দেখা স্বপ্নটা যেন সত্যি না হয় সেই প্রার্থনা করতে করতে সে রিক্সায় চেপে বসে। তার চোখে মুখে অস্থিরতা।আকাশে মেঘ জমছে।পুরাণ যদি এতক্ষণে ফিরে গিয়ে থাকে?কিংবা সে যেটা স্বপ্নে দেখেছে তা যদি সত্যি হয় কি করবে বৈদেহী?তার কান্না পায়। ব্রীজের কাছে এসে নামে বৈদেহী।কোথাও পুরাণ কে দেখতে পায়না সে। ঘড়ির কাটায় পাঁচটা পনের।বৈদেহীর অস্থিরতা আরো বাড়ে,কি করবে কিছু বুঝতে পারেনা সে।পুরাণ কি তবে ফিরে গেলো।কাশবনের দিকে আছে কি পুরাণ?আলো কমে এসেছে।কিছু একটা ভাবে বৈদেহী,তারপর নিচের দিকে নামতে থাকে।কাশফুলের ঝোপের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়ায়।কনে দেখা আলোয় সে অর্কিড,চকলেট,টিপস আর কোল্ড ড্রিংকসের বোতল পড়ে থাকতে দেখে।এদিকে সেদিকে তাকায় বৈদেহী। কোথাও পুরাণ নেই।সে ডাকে পুরাণ..পুরাণ..পুরাণ সাড়া না পাওয়া বৈদেহী কেঁদে ওঠে। পাখিরা দল বেঁধে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।আকাশ কালো কালো মেঘে ছেঁয়ে গেছে।সন্ধ্যার অনেক আগেই তাই অন্ধকার নেমে এসেছে।বৈদেহী বুঝতে পারে না কি করবে সে।এভাবে ফিরে যাবে?এই অর্কিড আর চকলেটগুলো কি পুরাণই নিয়ে এসেছিলো?কাঁদতে কাঁদতে আবার বৈদেহী কান্না কান্না গলায় আবার ডাকে পুরাণ..পুরাণ..প্লীজ সাড়া দাও পুরাণ বলেই আরো জোরে কেঁদে ওঠে।
কি করবো বুঝতে পারি না।যেখানে বৈদেহীকে নিয়ে বসবো ভেবেছিলাম,ব্রীজের পাশের সেই রাস্তাটা দিয়ে আমি নীচে নামতে থাকি।কাশ ফুলের ঝুপটার কাছে এসে মনে হলো। হাতের অর্কিড আর বাকীসব এখানে ফেলে দেয়াটাই ভালো।সবকিছু ঝুপটার কাছে ফেলে রেখে আমি কাশফুলের ঝুপটা পেছনে রেখে এগিয়ে যাই নদীর দিকে। বৈদেহী যা কোনদিন করেনি আজ সে সেটা করলো।মা কে মিথ্যা একটি জরুরী কাজের কথা বলে সে বেরিয়ে পড়লো।মনে মনে তার দেখা স্বপ্নটা যেন সত্যি না হয় সেই প্রার্থনা করতে করতে সে রিক্সায় চেপে বসে। তার চোখে মুখে অস্থিরতা।আকাশে মেঘ জমছে।পুরাণ যদি এতক্ষণে ফিরে গিয়ে থাকে?কিংবা সে যেটা স্বপ্নে দেখেছে তা যদি সত্যি হয় কি করবে বৈদেহী?তার কান্না পায়। ব্রীজের কাছে এসে নামে বৈদেহী।কোথাও পুরাণ কে দেখতে পায়না সে। ঘড়ির কাটায় পাঁচটা পনের।বৈদেহীর অস্থিরতা আরো বাড়ে,কি করবে কিছু বুঝতে পারেনা সে।পুরাণ কি তবে ফিরে গেলো।কাশবনের দিকে আছে কি পুরাণ?আলো কমে এসেছে।কিছু একটা ভাবে বৈদেহী,তারপর নিচের দিকে নামতে থাকে।কাশফুলের ঝোপের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়ায়।কনে দেখা আলোয় সে অর্কিড,চকলেট,টিপস আর কোল্ড ড্রিংকসের বোতল পড়ে থাকতে দেখে।এদিকে সেদিকে তাকায় বৈদেহী। কোথাও পুরাণ নেই।সে ডাকে পুরাণ..পুরাণ..পুরাণ সাড়া না পাওয়া বৈদেহী কেঁদে ওঠে। পাখিরা দল বেঁধে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।আকাশ কালো কালো মেঘে ছেঁয়ে গেছে।সন্ধ্যার অনেক আগেই তাই অন্ধকার নেমে এসেছে।বৈদেহী বুঝতে পারে না কি করবে সে।এভাবে ফিরে যাবে?এই অর্কিড আর চকলেটগুলো কি পুরাণই নিয়ে এসেছিলো?কাঁদতে কাঁদতে আবার বৈদেহী কান্না কান্না গলায় আবার ডাকে পুরাণ..পুরাণ..প্লীজ সাড়া দাও পুরাণ বলেই আরো জোরে কেঁদে ওঠে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসচ্ছে।বহতা জলের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলে নাকি জল নিজের দিকে টানে।আমিও এতক্ষণ তাকানোর পর সেই টান অনুভব করছি।যদি ডুবে যাই জগত সংসারের এমন কিছু হবে না।বৈদেহীও জানবে না হয়ত কয়েকদিন দেখবে আমি স্কুলের সামনে নেই,গীতামাসির বাড়ীতে নেই।তারপর একসময় ভুলে যাবে।গীতামাসি,বাবা মা আর বন্ধুরা হয়ত কাঁদবে।আমার জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে ট্রামের নীচে নিজেকে সঁপে দেবার আগে উনার কি আমার মতোই মনে পড়েছিলো সবার কথা,নাকি কোনো কবিতার কথা ভেবেছিলেন তিনি সেইদিনের কুক্ষণে! আলো কমে আসচ্ছে।বৈদেহী বুঝতে পারেনা সে কি করবে।আবার কান্না চোখে সে এদিক ওদিক তাকায়।কোথাও কেউ নেই।এমন শুনশান জায়গায় দাঁড়ানোটা তার উচিত মনে হয়না কিন্তু পা যেন চলছে না তার।অর্কিডগুলো তুলে নিয়ে আবার ফেলে দিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে অর্কিডগুলো তুলে নিয়ে আরো জোরে কেঁদে ওঠে।নিজেকে তার খুনী মনে হয়।আত্মবিশ্বাসী একটা মানুষকে সে নিজের খামখেয়ালীতে মেরে ফেলেছে মনে হতেই সে জোরে চিত্কার করে ওঠে পুরা..ণ। আমি ভরা নদীটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে তৈরী করতে থাকি।একটা লাইন আমার মাথায় ঘুরপাক খায় 'নিজেকে লিখতে গিয়ে দেখি শব্দ নিরুত্তর-' এই নিরুত্তর শব্দটা কি বৈদেহী?আমি বুঝতে পারিনা।জীবনানন্দ দাশের ও কি আত্মহননের আগে এমন কোনো কবিতার লাইন মাথায় এসেছিলো?কেউ জানেনা।আমারটাও কেউ জানবেনা।আমার আজ মৃত্যু হলেও তো কেউ জানবে না আমি আত্নহত্যা করেছি।জানলেও কেউ জানবে না বৈদেহীর আজ আসার কথা ছিলো এইখানে।হয়ত বৈদেহীও আমার মৃত্যুর কারণ বুঝবে না।সবার মতো সেও হয়ত প্রশ্নের গভীর অন্ধকারে থেকে যাবে সারাজীবন!প্রেম করে কেন মানুষ মরে যায় এটা এতদিন আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হতো!এখন আমার মন যেন তা বুঝতে পারছে।প্রত্যাখান,আশাভঙ্গের বেদনা মানুষকে একা করে দেয় এখন আমি বুঝতে পারছি।বুঝতে পারছি জীবনানন্দ দাশ এতকিছুর মাঝেও কতটা একা হয়ে গেছিলেন।কতটা প্রত্যাখান আর আশাভঙ্গের বেদনা তাকে নীল করে দিয়েছিলো। ইলশে গুড়ি বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে।চারপাশে আবছায়া আলো।কাশফুলের শুভ্রতা বদলে গিয়ে ধুসর।নদীর টলটলে জলে গুটি বসন্তের মতো কালশিটে দাগ।
মেয়ে কন্ঠে পুরাণ ডাকটা কানে বাজলো।আমার খুব হাসি পেলো।মৃত্যু ভাবনার সাথে ইলুউশান এভাবে মিলেমিশে থাকে তা জানা ছিলো না।জীবনানন্দ দাশ ও কি মৃত্যুর সময় এমন করুণ কান্না মেশা কন্ঠে কি ডাক শুনেছিলেন?আবার ডাকটা কানে এলো বেশ জোরে।এবার একটু ঘাবড়ে গেলাম মৃত্যু কি আমায় ডাকছে?নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।নদী কি আমাকে তার বুকে টেনে নিতে এভাবে করুনকন্ঠে ডাকছে?ইশ!বৈদেহী যদি একবার এভাবে ডাকতো!আমি নদীর জলের খুব কাছাকাছি।নীরবতা বাড়ছে।এখন আর কোনো ডাক শুনতে পাইনা।তবে কি এতক্ষণ এই ডাকটা আমার ভ্রম ছিলো? বৈদেহী অর্কিডগুলো বুকে চেপে ধরে আবার চিত্কার করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।বৈদেহীর মনে হয় এই শাস্তিটাই তার প্রাপ্য ছিলো হয়ত!সারাটা জীবন তাকে এই বৃষ্টির মতোই কাঁদতে হবে,কাউকে বলা হবে না।পুরাণের মৃত্যুর জন্য তার খামখেয়ালীপনা দায়ী।এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে বলতে পারে সে একটু ধৈর্য্য ধরতে পারলো না।বৈদেহীর খুব রাগ হয় পুরাণের উপর,তারপরই নিজের উপর রাগ হয় গতকাল না বললেই তো পারতো সে পুরাণ কে,যে আমি আসবো না পুরাণ। ডাকটা আবার কানে আসে।আওয়াজটা তো নদী থেকে নয় মনে হয় পেছন থেকে কেউ ডাকছে। আবছায়া অন্ধকারে ধুসর কাশ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনা।আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি মেখে হাঁটতে থাকি।কিছুটা এগিয়ে একটা ছায়া চোখে পড়লো কাশবনের ফাঁকে।এটাও কি আমার ইলিউশান?আমার ভেতরে বৈদেহী এতটা জায়গাটা করলো কোন অবসরে?নাকি গভীর আত্নবিশ্বাসে আঘাত পেলে মানুষ এমন ইলিউশনে ঢুকে যায়?ছায়াটা নড়ছে।আমি কি সন্ধ্যায় ভূত দেখছি!ছায়ার মতো কিছু একটা যে হাঁটছে আমি বুঝতে পারছি।ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম।পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা কি ঠিক হবে? বৈদেহী কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যাচ্ছে ব্রীজের দিকে।হঠাত্ তার মনে হলো কেউ পেছন পেছন আসচ্ছে।সে থামলে পেছনের আওয়াজটা থেমে যায়।হাঁটলে আওয়াজটা আবার কানে আসে। কোন বদমতলবে কোন বদলোক তার পিছন নেয়নি তো?তার অস্থিরতা আর কান্না আরো বেড়ে যায়।কি করবে বৈদেহী ভাবতে ভাবতে চমকে ঘুরে দাঁড়ায় আর তার হাতের ব্যাগটা দিয়ে জোরে জোরে এলোপাথারি মারতে থাকে লোকটির ওপর।
-আরে মারছো কেন? -আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কন্ঠটা শুনে আমার বৈদেহীর মতো লাগলো কিন্তু এই সন্ধ্যায় বৈদেহী এখানে আসবে কিভাবে?ইলিউশন,আবার ইলিউশন! চকিতে বৈদেহীর মনে হয় পুরাণ নয়ত?না। -তুমি কাঁদচ্ছো কেন?ভয় পেয়েছো?এই সন্ধ্যায় এখানে কেন একা একা। -মরতে। -আজব।মরতে চাইছো কেন! -আমার
ইচ্ছা।আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান তো। -এভাবে একটা মেয়েকে রেখে কি করে যাই।যদি মরে যাও তখন কি হবে? -প্লীজ যান তো। -তোমার সমস্যাটা আমায় বলো আমি সমাধান করে দিচ্ছি। -আপনি যাবেন। -আচ্ছা তুমি যে মরতে এলে তোমার কি ইলিউশন হচ্ছে! -মানে! -যেমন আমি বারবার শুনছি নারী কন্ঠে কে যেন ডাকছে পুরাণ। আমাকে চমকে দিয়ে ছায়াটা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে,পুরাণ তুমি কোথায় ছিলে আমাকে কাঁদিয়ে...
![]() |
~ লেখক পরিচিতি ~ |
সুচিন্তিত মতামত দিন