মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিতে পারেনি বলে আটদিনের না কামানো বাবার গালে সুবল ঘড়িয়াল সপাটে চড় মেরেছিল। চড়টা এসে পড়েছিল আমার শিশুগালে। সুবলের সারাদিন উদয়াস্ত কাপড় নিয়ে নাড়াচাড়া করা হাতের পাঁচ আঙুলের দাগ কেটে বসেছিল আমার গালের নরম চামড়ায়। অজান্তেই নিজের গাল চেপে ধরেছিলাম আমি। ফ্রী গালিগালাজগুলো আর গায়ের চামড়ায় নকশা কাটেনি।
স্কুলের শেষ গন্ডীর দড়িটা ছোঁয়ার আগেই স্বেচ্ছা অবসর নিতে হয়েছিল যখন বাবার কাশিটা ভয়ংকর হয়ে উঠলো। সারারাত বুক চেপে ধরে কাশতে কাশতে মনে হতো বুকের মধ্যে থেকে ফুসফুসটা মুখের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। অথচ পড়তে কোনোদিনই খারাপ লাগতো না আমার। ভুগোলের ম্যাপের ওপর আঙুল রেখে আমিই হয়ে যেতাম মার্কো পোলো। আমিই তখন আমেরিগো ভেসপুচি, আমিই কলম্বাস। সারা পৃথিবী টং টং করে ঘুরে আসতাম লহমায়। একশো ঘোড়সওয়ার নিয়ে ঢুকে পড়তাম ইউরোপের সীমানা টপকে। আমি তখন মোঙ্গল সর্দার। ভীতু সাদা চামড়াগুলো ছুটে পালাতো আমাকে দেখলেই। আমাকে ওরা ভয় পেতো শমনের মত। আর তারপরেই ভুগোল কিম্বা ইতিহাস স্যারের গাট্টা খেয়ে নেমে আসতাম আমাদের জরাজীর্ণ অবৈতনিক স্কুলের বেঞ্চিহীন মেঝের ওপর পেতে রাখা অজস্র কালির দাগ লাগানো বাতিল ছেঁড়া আলুর বস্তার ওপর।
সকাল হতো হুশহুশ পান্তা খেয়ে একটা বিড়ি ঠোঁটে চেপে বাবুদের গরু নিয়ে বাবার মাঠে যাবার আওয়াজে। লুঙ্গিটা গুটিয়ে হাঁটুর ওপরে তোলা, খালি গায়ে দারিদ্রের চাবুকের অসংখ্য আঁকিবুঁকি। বাবাকে খুব বেশী কথা বলতে শুনিনি কখনো। এমনকি আশেপাশের বাড়ির কর্তারা যখন সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি উশুল করতো আকন্ঠ দেশি মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে সগর্বে বউ পিটিয়ে, তখনও দেখতাম আমার নির্বিকার বাবা রাতের একটা পেঁয়াজ আর এক খাবলা নুন দিয়ে আধপেটা ভাত খেয়ে দাওয়ায় বিড়ি খেতে খেতে একমনে আকাশ দেখে চলেছে। সংসারের হাজারো অনটন তখন ছুঁতে পারতো না আমার সেই আত্মভোলা বাবাকে।
মেঘ আসে, মেঘ যায়। দিন ও রাত্রির সাদা কালো কাব্যের সূক্ষ অনুভূতি জড়িয়ে থাকতো আমাদের পরিবারের গায়ে। গ্রামের পুরোনো বটতলা সিঁদুর মাখামাখি হয়ে প্রচুর ভাঙাচোরা মাটির ঘোড়া সঙ্গী করে বেড়েই চলতো এদিক ওদিকে প্রশাখা ছড়িয়ে। পরিত্যক্ত ইটভাটায় একটু একটু করে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসতো ভয়ংকর বিষাক্ত খরিশ সাপের ক্ষুদে ক্ষুদে কিলবিলে বাচ্চারা। আমের বাগানে বোল আসে, বহু মুকুল ঝরে যায় সময়ের ঝড়ে। লড়াইয়ে টিকে থাকারা শেষমেষ আলো করে স্বচ্ছলদের ডিনার টেবিল। আমাদের যেখানে যত ফেলাকড়ি সোনা হয়ে ফলতো জীবনের উষ্ণতায়। “চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে...”। আমাদের দেখার জন্য কোনোদিনই রে ব্যানের চশমা লাগেনি।
বাবা বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই মাও বেরিয়ে যেতো গামছায় দুটো ভাত একটা পোড়া লংকা আর নুন একটা তোবড়ানো এলুমিনিয়ামের বাটিতে বেঁধে নিয়ে। সারাদিন তার কেটে যেত মাটি মেখে মাটিরং ইট তৈরীতে। ইটভাটার কালো কালো গুনতির মাথাদের একজন হয়ে সপ্তাহ শেষে ঘরে আসতো কয়েকটা নোটের সুরাহা। এদিকে মা ও রোগা হতে হতে, রোগা হতে হতে ক্রমশ হাওয়ার টানে ভেসে যাওয়ার দাখিল। সবকটা পাঁজর দিব্যি দেখা যেত। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো হচ্ছিল আস্তে আস্তে। অথচ পুরোনো রংচটা তোরঙ্গে রাখা মা আর বাবার বিয়ের পরে রথের মেলায় তোলা তাজমহলের পাশে লাজুকলতা ছবিতে মা কে কিন্তু বেশ সুন্দরীই লাগতো। মা র রঙ রূপ কে যে কেড়ে নিলো! কে যে উপহার দিলো বাবার আরাত্রি কাশি! সুবলের বিরাশি সিক্কার চড়!
একটা ফেলে দেওয়া ছেঁড়া ক্যালেন্ডার কুড়িয়েছিলাম শৈশবের অনন্ত কৌতূহল বশে। কৃষ্ণ-রাধার পায়ের অংশ ছিলনা সেখানে। তবুও আমার বিবর্ণ শিশুবেলায় সেই রঙটুকু এনেছিল এক আকাশ আনন্দ। দিগন্তবিস্তৃত ভালোলাগায় সেই ছেঁড়া ক্যালেন্ডার কুড়িয়ে নেবার পরেই ছিটকে পড়েছিলাম মৈত্রবাড়ির দারোয়ানের লাথির দমকে। পথকুকুরের বিশেষণ পেয়েও হাত থেকে ফেলিনি সদ্য পাওয়া মিশরের গুপ্তধন। খৈনির থুতু আমার দেহের ওপর ছিটিয়ে দারোয়ান ফিরে গেছিল তার বিশ্বস্ততার শেকলের গন্ডীতে। আর আমি বিজয়গর্বে বাড়ী ফিরে যত্নে লুকিয়েছিলাম সেটা ঘুঁটে রাখার ঘরের এককোনে আমার রাজকীয় কোষাগারে।
অর্জুন গাছের পাতার ফাঁক গলে যাবার সময় হাওয়ারা এক অদ্ভুত সুরেলা মায়াবী সুর বাজিয়ে যেত। বাঁশির সেই সুরের কাছে এই নষ্ট জীবনের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা সব রক্ত, সাততারা গিটারের বাজনা, কোটি টাকার ওয়ার্ল্ড কাপ ধাষ্টামো। বাবুদের বাড়ীর টিভিতে গানে গানে নাচে নাচে অনুষ্ঠানের ঝলকানি সব, সব মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত। সেই সুর ধরতে পেরেছিলেন যারা, তাঁরা আজ আকাশের তারা হয়ে ফুটফুটে সাদা আলো বিকীরণ করেন। অমর্ত্য ধারার সুখ বিচরণে সেই জলতরঙ্গে কি অপরিসীম মায়া, সব দুঃখ, ক্লান্তি, চাওয়া না চাওয়া, পাওয়া না পাওয়ার গল্প নিমেষে ভুলিয়ে এলিসের দেশে নিয়ে যেত আমাকে, যেখানে ইউক্যালিপ্টাস পাতার মুকুট পরে গলায় নয় রঙ মুক্তোর মালা, অপেক্ষায় থাকত শুধু আমারই জন্য- সিন্ডারেলা।
অঙ্ক কষে কখনোই পা রাখিনি সাদা ধুলোর রাস্তায়। সংখ্যারা জ্যোতিষের বিকট আকার চিহ্ন হয়ে তাড়া করতো আমাকে। আর আমি কোনোরকমে ডজ করে পাশ কাটাতাম তাদের। হিসেব করে চলা বোধহয় আমার হতভাগ্য মা বাবাও রপ্ত করেন নি। আসলে হিসেব করার মত পর্যাপ্ত কড়িই তাঁদের ছিলনা। প্রয়োজনের ফাইনালের ফিতে স্পর্শ করার সৌভাগ্য তাঁদের কোনোদিনই হয়নি। বিপুল ঘাটতি সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল জন্ম থেকে মৃত্যু ফিতেক্রিমির মত। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, অন্য দুনিয়ার সেই রঙহারা জগতে তাঁদের পরস্পরের প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না। অনুরাগের প্রকাশও ছিলনা যেমন, তেমনি বিদ্বেষও ছিলনা। কাশতে কাশতে যেদিন নিথর হয়ে চোখ বুজলেন সেই লড়াইএ হেরে যাওয়া পুরুষ, পাথর হয়ে সেদিন মা কে বিড়বিড় করতে শুনেছিলাম। ছোট্ট অনুযোগ, একা ফেলে চলে যাওয়ার জন্য। তার একমাসের মধ্যে মা ও যখন চলে গেলেন সেই দূর সফরে বাবার সঙ্গী হতে, নিজের অপুষ্ট ক্ষয় আক্রান্ত খোলস টা ছেড়ে, তার পরদিনই আমার একমাত্র বন্ধু হয়ে গেল ওই সাদা ধুলোর রাস্তা, ওই দূরের আবছায়ারা, ওই হ্যামলিনের বাঁশির সুর।
আজ যখন বিকেলের ঝরা পাতারা উড়ে বেড়ায় যত্রতত্র, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা কখন যেন মিলিয়ে গেছে ছায়া ছায়া অতীতের গোপন গহ্বরে, আমিও বিড়ির শেষটান দিয়ে বাবার মতোই খুকখুক কাশি আর রাতের আকাশের দিকে চেয়ে প্রাণপনে খুঁজে ফিরি আমার সেই ফেলে আসা নিস্পাপ শিশুবেলাকে। এই স্বাধীন স্বাদহীন প্রজাতন্ত্রে আমিও কি সত্যিই কোনো এক নথীভূক্ত প্রজা? তাহলে এত বৈষম্য কেন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আজও? কেন এখনো বিরাশি সিক্কার চড়ের দাগ লাল হয়ে ফুটে থাকে আমার গালে? কেন আমার পিঠের ওপরে আজও আছড়ে পড়ে স্বচ্ছল লাথি? প্রশ্নগুলো ব্যর্থমনস্কতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে নির্দয় সময়ের রাস্তার দুপাশে। আমি হাঁটি। কেবলই হেঁটে যেতে থাকি অবিরাম খোঁজি হয়ে। যেভাবেই হোক আমাকে খুঁজে পেতেই হবে সেই বাঁশির সপ্তসুরের আবাস। আমার শেষ এবং একমাত্র আশ্রয় সিন্ডারেলার সেই মকরক্রান্ত আশ্বাস।
![]() |
~ লেখক পরিচিতি ~ |
অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা শব্দের মিছিল।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন