বিগত ১৫ই আগস্ট সারা ভারতে ৬৯তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হল। সেই উপলক্ষে রাজধানী দিল্লী সহ সারা ভারত জুড়েই নানা রকম জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল,যেমনটি প্রতিবার হয় আর কি। তারপর, আরও কিছু কমন ফ্যক্টরও যথাবিহিত মর্য্যাদা সহকারে পুনঃপ্রদর্শিত হল, যেমন,সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ সহ নানা ধরনের সামরিক যন্ত্রপাতি সর্ব সাধারনের জানার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শিত হল, আমরা জানলাম আমাদের সামরিক শক্তি কতটা, আমাদের বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চারা স্বাধীনতা কতটা বোঝে এবং নাচগান করে অন্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল আবার 'হ্যাপী ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে' বলে শুভেচ্ছা জাননোটাও সভ্যজনের এটিকেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে ঢেলে বিকোচ্ছে 'হ্যাপী ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে' গ্রীটিংস কার্ড। স্বাধীনতা দিবসে সারা ভারতের সরকারী অফিস-আদালত, জেলখানা থেকে পাগলাগারদ সব জায়গাতেই একটা খুশির আমেজ দেখা যায়। ব্যক্তিগত উদ্দোগ্যে ভাল খাবার-দাবার,কখনো সখনো নতুন পুরানো জামাকাপড়, শীতবস্ত্র পরিবেশন করা হয় অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, কিছু হাসপাতাল, অর্থনৈতিক অনগ্রসর মহল্লায়। সুবেশা মহিলারা সেজে-গুজে অমুকবাবু তমুকবাবুর সাথে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দান-ধ্যান করেন ও মিডিয়াকে জানান দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চমকায়। পরেরদিন খবরের কাগজ জানায় ১৫ই আগস্ট বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত ‘যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৬৯তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছে’ এবং এই উপলক্ষ্যে ‘সারা ভারতে এক অপরিসীম আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে’।
রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হলেও ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীরে। বেশকিছু আঞ্চলিক গোষ্ঠী এই দিনটাকে ' স্বাধীনতা দিবস' মানতে চায় না, তাদের ন্যায্য বা অন্যায্য দাবীদাওয়া সরকারীভাবে মানা না হলে তারা 'স্বাধীনতা দিবস' উদযাপন বয়কট করে এবং এইভাবে চেষ্টা করে তাদের দাবী বাস্তবায়ন করার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ও কাশ্মীরে ২০টির বেশি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন’ স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন করে যাচ্ছে। এ কারণে তারা প্রতিবছরই স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবসে সব ধরনের সরকারি কর্মসূচি বয়কটের ঘোষণা করে, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তা সে উৎসব জিনিষটাই এমন। ইচ্ছা হলে আনন্দ করে অংশ নাও নয়ত মুখগোমড়া করে নিজের মনে নিজে থাকো। নো প্রবলেম। ছোটবেলা থেকেই জানি প্রজাতন্ত্র দিবস বা স্বাধীনতা দিবস মানেই একটা গোটা ছুটীর দিন।ইচ্ছামত চলার দিন, পিকনিক , থিয়েটার,কি সিনেমা দেখার দিন,তাছাড়াও আছে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের মাঠে, তেরঙ্গা পতাকা তোলার ভীড়ে দাড়াঁলেই দুটো লজেন্স, কি একমুঠো বোঁদে,সাথে ফ্রী ভাষণ। অঘোষিত স্বঘোষিত এবং ঘোষিত নেতা নেত্রীদের খুচরো ভাষণ, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা আজাদি-র ভাবসম্প্রসারন,নেতাজী, গান্ধী, জহরলালের ছবিতে টাটকা ফুলের মালা।প্রভাত ফেরী, বাচ্চাদের মুখোশ নাটক,বসে আঁকো প্রতিযোগীতা, পথনাটিকা। খবরের কাগজের বিশেষ ক্রোড়পত্র, বাচ্চাদের হাতে তিনরঙ্গা ফেস্টুন,বাবা- কাকার শার্টে সেফটিপিনে আটকানো কাগজের তেরঙ্গা,স্বাধীনতা দিবস মানেই মাইকে বা টিভিতে তারস্বরে দেশভক্তির গান বা সিনেমা ,এছাড়াও আছে লালকেল্লার সরকারী অনুষ্ঠান, সামরিক বা বেসামরিক কুচকাওয়াজ, স্কুল বা বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠানের তরফে প্যারেড। আমার কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দেয়, সেটা হল, একদিন মাইক বাজিয়ে আর প্যারেড করে কি সত্যিই স্বাধীনতা উদযাপন করা যায়? আরে বাবা নাচাগানা তো শোনপুর মেলাতেও হয়, অমুকবাবু তমুকবাবু হাতে মাইক পেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও মুখস্থ করা রক্ত গরম করা ভাষণ দিয়ে পরক্ষণেই পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে নাক ডাকাতে পারেন,তারজন্য ‘স্বাধীনতা’দিবসে’র বাহানাটা খুব জরুরী কি? 'জনগণমন' ইস্কুল থেকে শুনতে শুনতে মনের ওপর এমন ঘূণধরা এফেক্ট করেছে যে এখন গানটা বাজলে আমাদের মধ্যে কতজন হাতের কাজ ফেলে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ার সৌজন্যটুকু দেখান সেটাও প্রদীপ হাতে খুঁজে দেখতে হয়।বন্দেমাতরম গানটাই বা আজকাল কি দাম? ছোটবেলায় রেডিওতে যে বন্দেমাতরম-র সুর শুনে বড় হয়েছি তার থেকে এ.আর.রহমানের 'মা তুঝে সালাম' –এর বন্দেমাতরমের সুর আজকের প্রজন্মের কাছে বেশী পরিচিত নয় কি? এই সুরের বন্দেমাতরম কি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত? বিতর্কিত বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু আরো বিতর্কিত বিষয় হল, স্বাধীনতা বাপারটা কি? খায় না মাথায় দেয়? এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর পাই কোথায়?
...লেট করে ঘুম থেমুকে উঠে টিভিতে দেশাত্মবোধক সিনেমা বা ‘ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স’,কি ‘সারেগামাপা’র ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে স্পেশাল দেখা, পাড়ার মোড়ে, ক্লাবে, ইস্কুলে কর্নবিদারী মাইকে সোচ্চারে বাছাবাছা কিছু গানের রিপিটেশন শোনার (ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়ে) মত পাড়াতুতো দেশপ্রেমের জোয়ারে নিজেকে ভাসানো ছাড়া কোন রাজকাজটাই বা করছি আমরা? পতাকা উত্তোলন? লজেন্স বোঁদে জিলিপি বিলি? পিকনিক? পিকেটিং? গেট-টুগেদার? ছুটীর দিনের আড্ডা? দুপুরে মাংসভাত শেষে জমাটি দিবানিদ্রা? পতাকা তুলে জাতীয় সঙ্গীত?নাকি সেপ্টেম্বরের শেষের পূজোর বাজার? দেশাত্ববোধ জাগে এই উপায়ে? জানি না। ঠিক যেমন জানি না ইতিহাস বইয়ের পাতা ছাড়া সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর কোথায় আছে?
স্বাধীনতা মানেই তেরঙ্গা আর এই তেরঙ্গা প্রসঙ্গে মনে এল, গত কয়েকদিন মানে এই আগস্ট মাস পড়তে না পড়তেই ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপর মত সোস্যাল নেটওয়ার্কে লোকে প্রোফাইল পিকচারে পশু প্রাণী ফুল লতা পাতা কোটেশনের মত, নিজের শ্রীমুখের বদলে জাতীয় পতাকা লটকে রাখছে। এটা কি জাতীয় পতাকার অবমাননার স্বাধীনতা? এই বিষয়ে একটা ছোট্ট ইনফরমেসন কোট করার লোভ সম্বরন করতে পারছি না।
Indian Constitution doesn't allow us to make Indian Tricolour as Profile Pic or Stitch or Paste it anywhere. Indian Tricolour should only be unfurl to fluttest freely in air and as an Indian its our Fundamental Duty to give all due respect to the Tricolour.... Provisions of the Emblems and Names (Prevention of Improper Use) Act, 1950 (No.12 of 1950) and the Prevention of Insults to National Honour Act, 1971 (No. 69 of 1971)
আর কিছু বলার স্বাধীনতা আছে?তাহলে কলমের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বলি-
“জাতীয় ফুলটা হাতে চটকালেও সম্প্রীতির গন্ধ আর বের হয় না ,
‘সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক ভারত’ শব্দটা রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
পতাকার ভাঁজে দামিনীদের চিৎকার ,নারীমাংসভোজীর উল্লাস,
কন্যাভ্রূন বিসর্জনের আর সতীদাহের নিদারুন কাহিনী,
জাতপাত,ভোটযুদ্ধে বা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে নিহতদের রক্তের দাগ ,
সীমান্ত বা সীমান্তের ভেতরে উর্দিপরা,উর্দিছাড়া দেশপ্রেমিকদের বলিদানের গল্প,
সব বুকে বয়েও আকাশে সগৌরবে উড়ছে জাতীয় পতাকা।
দিনের শুরুতে স্বচ্ছ নীল আকাশের বুকে উদীয়মান সূর্য লাল রং ছড়াচ্ছে,
সেই লাল রঙ সর্বাঙ্গে মেখেও কিন্তু আমাদের জাতীয় পতাকা তেরঙ্গাই আছে।‘
আত্মসমালোচনার স্বাধীকারটাও থাক, আমার, আপনার, সবারই। ভাবনার স্বাধীনতাও খুব জরুরী। আসলে কি জানেন তো?
“”স্বাধীনতা ছোট্ট কথা,অনেক রকম অর্থবাহী,
সুযোগ বুঝে লোকের চোখে ভিন্ন রঙের ধ্বজাবাহী।
স্বাধীনতা, ইচ্ছেপাখী,মনের আকাশ তার ঠিকানা।
অভিধানে যাই মানে থাক, আসল অর্থ?কেউ জানে না।“”
![]() |
~ কবি পরিচিতি ~ |
সুচিন্তিত মতামত দিন