মৌ দাশগুপ্তা



রথের দিন ,.আষাঢ়ের আকাশে মেঘের ঘনঘটা।ঘড়িতে সকাল ছ’টা কিন্তু বাইরে আলো একদম নেই। রাত রাত লাগছে। নিমাইয়ের চায়ের দোকানের পিছনে বাঁশের বাখারী দেওয়া চার দেওয়ালের ওপর খড়ের চাল, গতকাল মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা হয়েছে বলে আজ জল টপকাচ্ছে না তবে জলের ছাঁট আসছে। ঘরে সাকুল্যে একটা তক্তাপোষ তাতেই কাকা ভাইপোর সংসার। ছোট্ট অনি পাড়ার দেবুদাদার গত বছরের বই নিয়ে দুলে দুলে ইতিহাস পড়ছে, ‘মানবসভ্যতার প্রথম অবদান চাকা আবিস্কার।‘ 

পড়তে পড়তে আড়চোখে কাকা কোথায় দেখতে গিয়ে আনমনা হয়ে যায় অনি, এবারের রথের কি খবর ওদের নয়ানপুরে ?। পুঁটে মাধুদের জন্য রথ কি কেনা হয়েছে? আর রঙিন কাগজ, রাংতা, ফুলমালা ? প্রসাদের চিনি আর কলা? ওখানেও কি আজ বৃষ্টি হয়েছে? ঠাকুমা যে বলতো,রথের দিন নাকি বৃষ্টি হবেই। এবারও রথের মেলায়  গাছ বিক্রি হবে নিশ্চয়ই? সবেদা পেয়ারা জামরুল লেবু রক্তচন্দন, সাথে জবা, গন্ধরাজ, রঙ্গন, আর স্থলপদ্মের চারা । রথের মেলা জুড়ে দেদার বিক্রি হবে পাঁপড়, নিমকি, কুচো গজা, ফুটকড়াই, ফেনী বাতাসা,বাদামভাজা, গরম জিলিপি। এছাড়াও আসবে বাঁশীওয়ালা সনাতনদাদু, কমল নামের হাসিখুশী বেলুনওয়ালা দাদাটা , মাধোপুরের করিমচাচা আসবে বুড়ির চুল নিয়ে , চৌকানো কালো কাপড় ঢাকা বাক্স নিয়ে রহিমদাদা দেখাবে আজব সিনেমা, থাকবে রঙ বেরঙা কাগজের চরকি. লাট্টু, সাবান ফেনার বুদবুদ, কত যে মজা হবে। পুঁটে মাধু বিন্তি সোনু কানাই মান্তিরা কি মজাটাই না করবে আজ, আচ্ছা ওদের কি আজ একবারও অনির কথা মনে হবে?

অনির বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করত, গত বছর এই রথের দিনেই বাড়ী ফেরার পথে লরী চাপা পড়েছিল, চাকার তলায় পিষে রক্তমাখা দেহটা চেনার উপায় ছিলনা। অনিকে তাই কেউ দেখতেও দেয়নি। অনি মাকে দেখেনি কোনদিন। ওর ঠাকুমা বলতো ‘জন্মকালে মরে মা তার দুঃখ ঘোচে না’। সে ঠাকুমাও তো নেই। মরে হেজে থাকার মধ্যে এই এক কাকা। গত কয়েকমাস কাকার চায়ের দোকানেই কাকা ভাইপোর সারাদিনের সংসার। আজ রথ কিনা,আজ ওদের পথশিশুদের ইস্কুলেও ছুটি তবে খুব কাজ আজ দোকানে, বড় কড়া চাপবে, বেগুনী পেঁয়াজী পাপড় ভাজতে হবে। সকাল থেকেই খাটতে হবে। কাকা কাল রাত থেকেই পাখীপড়া করে বলে দিয়েছে। সব যোগাড়-যাগার করে হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে তারপর শুয়েছে গতকাল। আজও অনি ঘুম ভেঙে ওঠার আগে থেকেই দোকান খুলে একা হাতে চা বানাচ্ছে কাকা। এবার না গেলে বকা দেবে। অনি উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাইরে থেকে নিমাইয়ের গলা ভেসে আসে
- বলি ও নবাবপুত্তুর, আর কত পড়ার কেত্তন করবি ? উনুন যে নিভতে চললো, বলি সুজ্জি যে মাথার ওপর উঠলো সে খেয়াল আছে? হতচ্ছাড়া ছেলে, আয় বলছি।

একফালি জানলায়  দাঁড়িয়ে জলে ভেজা পথ দেখছিল ছেলেটা। আর রথ সাজানো নেই, মেলায় যাওয়া নেই। কাকার মৃদু বকুনি কানে আসতেই  যন্ত্রচালিতের মত হাতের বই তক্তাপোষের নীচে ঢুকিয়ে রেখে দেওয়ালে টাঙানো পুরানো জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার ক্যালেন্ডারে ঢিব করে প্রনাম ঠুকেই দৌড় লাগালো ।

 - কলকাতা - 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.