অমলেন্দু চন্দ


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের নায়ক আন্যকিয়াদের নিয়ে অনেক গল্প অনেক কথা অনেক ইতিহাস রচনা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সে ইতিহাস তো এমন হয়েছে যেন স্বাধীনতা এদের বদান্যতায় এসেছে। আজ এদের কথা নয়, এমন কিছু লোকের কথা বলব যাদের নিয়ে কেউ ইতিহাসের এক লাইন লেখেনি। তাড়া পায় নি কোন তাম্রফলক বাঃ সম্মান। অথচ তাড়া ছিল সেই যাকে বলে মিরিয়াডস অফ ফাইটার্স যাদের সদর্প উপস্থিতির ভিড় লড়াই কে বরাবর জোরদার করেছে।

এমনই একজনের নাম পদ্মাশিনি আম্মা। জায়েগাটার নাম  মায়িল্লাদুথুরাই, তামিল নাডুর থাঞ্জাভুর জেলা। সেটা ১৯২৮ সাল। লাহোর কনভেনসান শেষ হয়েছে। সম্পুর্ন স্বরাজের লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডাক পড়েছে, তাই মানুষ ঘোর দোর ফেলে রেখে রাস্তায় ঘাত নামছে মিটিং মিছিলে। এরকম সময়ে ঘরের বউ  পদ্মাশিনি আম্মা পথে নামলেন – স্বরাজ চাই, পুর্ণ স্বরাজ। স্বামী সেই সময়ের তামিল নাদু কংগ্রেসের একজন নামই কর্মকর্তা – শ্রিনিবাসা ভরদান। এমন বিশেষ কিছু ঘটনা নয়। পুলিশের লাঠি আর লাথি দুইই খেলেন। দু দু বার আইন অমান্য আন্দোলনের দরুন জেল খাটলেন। সেরকম বিরাট কিছুই নয়। ১৯২৯ সালে দিলেন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম। আবার আন্দোলন – স্বামির পেছন পেছন ঘর সন্তান ফেলে রেখে। শিশুটি কয়েক বছর পর মারা যায়, অপুষ্টি আর যত্নের অভাবে। আম্মা কিন্তু লড়াই চালিয়ে গেছিলেন, শেকল ভাঙার লড়াই। 

আল্লাহ বক্স, তৎকালীন সিন্ধ প্রান্তের চীফ মিনিস্টার, প্রভিন্সিয়াল গভর্নমেন্টের, ইংরেজের প্রিয়পাত্র, ইত্তেহাদ পার্টির অন্যতম কর্নধার। তিনিও চেয়েছিলেন, পুর্ণ স্বরাজ, আনদলনে নামেননি, কিন্তু পত্র পত্রিকায়, বিভিন্ন সভায় এবং ইত্তেহাদ পার্তির মুখপত্রে স্বরাজে স্মর্থক ছিলেন। সেটা ১৯৪২ সাল, ইংরেজ ভারত চার আন্দোলন চলছে, এরকম সময়ে উইন্সটন চার্চিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্তে দাঁড়িয়ে ভারতের আন্দোলন সম্বন্ধে অকথ্য কুকথা বললেন, বললেন একটা ভিকিরিদের দেশ, একটা নেংটি পরা লোকের নেতৃত্ত্বে ইংরেজ কে তাড়াতে চায়। চার্চিলের সেই রাগ কোনদিন পড়ে নি, তাই এটা বলা হয় যে তেতাল্লিশ' এর মন্বনন্তরের অময়ে চার্চিল প্রত্যক্ষ সমর্থন করেন সেই সমস্ত ব্যাপারের যার ফলে অস্ট্রেলিয়া থেকে চাল গম আনা সম্ভব হয় নি, বলা হয় যে মন্বনন্তরের প্রকোপ চার্চিল চাইলেই অনেক কম হত, সেই চার্চিলের ভুমিকার জন্য সেই মন্বনন্তরে হিতলারের ইহুদি নিধনের থেকেও বেশী সংখ্যক লোক মারা গিয়েছিল। যাই হোক, এখানে গল্পটা চার্চিল কে নিয়ে নয়, আল্লাহ বক্স কে নিয়ে। তিনি তো বেজায় ক্ষেপে গেলেন, রেগে মেগে চিফ মিনিস্টারি ছেড়ে দিলেন, ফিরিয়ে দিলেন ইংরেজের দেওয়া অনেক সুযোগ সুবিধে আর টাইটেল, দিয়ে স্বরাজের পুর্ণ সমরথনে মাঠে নেমে পড়লে। যেটা অনেকেই জানে না, এই আল্লাহ বক্স সেই সময়ের কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের রাজনীতির শিকার হন। ১৯৪৩ সালে তিনি খুন হয়ে যান, এই রাজনীতির পরিনামে। তার এই খুন হয়ে যাওয়া কে কেউ শহিদের তকমা দেয় নি। সেও আর এক রাজনীতি, যে নোংরা রাজনীতির আর এক শিকার সুভাষ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের এই রকম আর একজনের নাম রাজ কুমারী গুপ্ত, ১৯২৭ সালের কাকরি ট্রেন ডাকাতির সময়ে একটি সতের বছরের মহিলা তার অন্তর্বাসের ভেতরে শাড়ির নীচে পরিধেয়র ভেতরে সেলাই করে দেশী রিভলভার আর পিস্তল নিয়ে যান রাম্প্রসাদ লাহিড়ী, চন্দ্র শেখার আজাদ, আস্ফাকউল্লাহ দের জন্য। কানপুরের বান্দা জেলার এই মহিলা আর তার স্বামী মহাত্মা কে দেখে এতই অভিভুত হন যে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। কথিত যে এই মহিলা যখন কাকরি ঘতনার কুশীলবদের কাছে ফায়ার আর্মস পৌছে দিতে গেছিলেন, সঙ্গে তার তিন বছরের পুত্র সন্তান ছিল, সে গেছিল তার মায়ের পেছন পেছন আর মহিলার তাকে কোথাও রেখে যাওয়ার কেউ ছিল না। তাকে যখন পুলিশ পরে গ্রেপ্তার করে তিনি তার স্বামির পরিজনদের দ্বারা পরিত্যক্তা হন, তাকে বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয় নি মুক্তি পাওয়ার পর। 

২৬ বছরের অওধ বিহারী, হার্ডিঞ্জ হত্যা ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশিলব রাস বিহারী বোসের শাগরেদ ফাঁসি কাঠে ঝুললেন ১৯১৫ সালে। তিনি নাকি আরও একটা বোম ফাতানর মামলার আসামী ছিলেন। জন্ম সুত্রে দিল্লীর লোক, উত্তর প্রদেশ আর পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংসর্গে আসেন, সেই সুত্রে রাস বিহারী বোসের সান্নিধ্যে আসেন। তারপর এক বছর ধরে কারাবাসের পর ১৯১৫ সালে তার ফাঁসি হয়।

এই পর্যায়ে আর একজনের কথা বলে গল্প শেষ করব। পণ্ডিত হরি কিশেন সিংহ। পাঞ্জাবের বাতালা জেলার লোক। স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু বার জেল খেটেছেন, গান্ধীজীর দেওয়া বহু ডাকে সাড়া দিয়ে। স্বাধিনতার পর তিনি নানকানা সাহেবের রিফিউজি ক্যাম্পে জায়েগা পান, তার বিভাজনের পর পাকিস্তানে ফেলে আসা জমির বিনিময়ে পরে ভারতের পাঞ্জাবে র বাতালা তে জমি পান। এই লোকটা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেওয়া পেনশন নিতে অস্বিকার করেন, কারন তাকে মুচলেকা দিতে হত সেই ১৯৫৭ সালে যে তার বার্ষিক রোজগার ৫০০০ হাজার তাকার কম। তিনি মিথ্যে কথা বলতে অস্বিকার করলে তৎকালীন পাঞ্জাবের এক মন্ত্রী নিজে এসে তার হয়ে ফর্ম ভরে দিয়ে সই করে দেন। দুঃখের কথা হল ১৯৮৬ সালের পাঞ্জাবের সেই দুঃসহ সময়ে জলের দরে সেই জমি বেঁচে দিতে বাধ্য হন। আজ সেই ভদ্রলকের বয়েস নব্বইয়ের ঘরে, আর তিনি থাকেন নাকি সেই জেলার কংগ্রেস ভবনের একটা চিলেকোঠার ঘরে, তার বরাদ্দ পেন্সনের জোরে, একবেলা খেয়ে। রাতে তিনি কিছু খান না, আর তার ব্রেক ফাস্ট যোগায় সেই ভবনের বাইরের জনা কয়েক চা ওয়ালা। 

লেখক পরিচিতি
কটক / উড়িষ্যা 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.