এরা কি মানুষ না মানুষের রূপে দেবদূত ? সকলের মনের মধ্যে এক-ই জিজ্ঞাসা ঘোরাফেরা করে। কয়েকজন অচেনা-অজানা অনাত্মীয় লোকের জন্য এরা যা করলো , সাধারণ কোনো মানদন্ডে তার বিচার করা যায় না। আজকাল ক'জন আছে এরকম নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের জন্য করে ? এই তিনটি যুবক কে দেখলে নতুন করে ভরসা হয় মানুষ এখনো আছে পৃথিবীতে। একেবারে শেষ হয়ে যায়নি মনুষ্যত্ব ! ঘটনাটা পুরোটা শুনলে , সকলের-ই সেই ধারনা হবে মনে হয় । সেদিন , রাত তখন নটা হবে , এই ছেলেগুলো গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল,ছেলেরা যেমন করে। নিজেরদের মধ্যে হাসি মশকরা, এওর পিছনে লাগা, এসব'ই চলছিল ................
বেশ ফুর্তিতেই ছিল তিনজন। নিজেদের মধ্যে মশগুল, জগত সম্মন্ধে নির্বিকার। অনেকের'ই পছন্দ হচ্ছিল না
ওদের এই রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে হাসি- রসিকতা । অনেকেই পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিরক্তির দৃষ্টি দিয়ে পাশ কাটাচ্ছিল। এই সব হয়েছে আজ-কালের ছেলে-ছোকরা, কারোর কোনো কাজে লাগে না , দিন-রাত শুধু হ্যা হ্যা করা ! অনেকে তো বিড় বিড় করে দু-এক কথা বলেও দিচ্ছিল। তখন কে জানে একটু পরেই সকলের ধারনা মিথ্যে প্রমাণ করবে এই ছেলেরাই !
দিব্যি আড্ডা দিচ্ছিল ওরা, হঠাত খুব জোরে একটা শব্দ। দুটো গাড়িতে ধাক্কা লাগলে যেমন আওয়াজ হয়, তেমন জোর আওয়াজ, আর তার পর-ই হই হই করে লোকের ছোটাছুটি। ছেলেগুলো মোড় ছেড়ে একটু এগিয়ে এসে দ্যাখে একটা লরি উল্টে গেছে , আর একটা এম্বুলেন্স তুবড়ে ছোট হয়ে গেছে। দুটো গাড়ির মুখো-মুখি ধাক্কা। লরি-র ড্রাইভার বেপাত্তা, যথারীতি বিপদ বুঝেই লাফ দিয়ে নেমে পালিয়ে গেছে। এম্বুলেন্স-এর ভিতরে কয়েকজন আটকে আছে মনে হয়.. ........কান্না কাটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
এইড দিয়ে দিয়েছে, চোট খুব একটা গুরুতর নয়, তাই অসুবিধা হয় নি। কিন্তু বাচ্চা এবং পুরুষ দুজনের কোনরকম চিকিতসা করতে সে রাজি নয়, বলে .........." এক্সিডেন্ট-এর কেস, পুলিশের ঝামেলা হবে, আমি ওসবের মধ্যে নেই "........."যত তাড়াতাড়ি হয় এদের হাসপাতালে সরিয়ে নিয়ে দোকান খালি করে দেন আপনারা।"
ছেলেগুলো অবশ্য ততক্ষনে একটা গাড়ি যোগাড় করে ফেলেছে, টাটা সুমো.......ওদের-ই কোনো বন্ধুর গাড়ি, এরা ফোন করতেই সে গাড়ি নিয়ে হাজির ! যাই হোক ধরাধরি করে, একে একে পুরুষ দুজনকে গাড়িতে তুলে পিছনের সিট গুলোয় শুইয়ে দেয় , একটি ছেলে থাকে ওদের দায়ীত্বে। মহিলাটিকে মাঝখানের সিটে বসিয়ে বাচ্চাটাকে তার মা'র কোলে দিয়ে দেয়। তারপর গাড়ির মালিক আর বাকি দুটি ছেলে সামনের সিটে বসে রওনা হয়।
কাছেই যে বড় হাসপাতাল, সেখানে নিয়ে যায়। বলে দেয় পুলিশকে ওরা সামলাবে , এদের চিকিত্সার ব্যবস্থা যেন তাড়াতাড়ি করা হয়। হাসপাতালের কর্মচারীদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি দেখে আসল ব্যাপারটা বুঝে যায় , আশ্বাস দেয় ......" কোনো ভয় নেই টাকা-পয়সার দায়িত্ব তারা নিচ্ছে। বাড়িতে খবর দিয়েছে , টাকা নিয়ে লোক এসে পৌঁছে যাবে যেকোনো মুহুর্তে".,নিজেদের অফিসের কার্ড দেখায় , .
.....আশ্বস্ত হয়ে হাসপাতালের কর্মীরাও দ্রুত কাজ শুরু করে। ইমার্জেন্সি-র জন্য যা যা ব্যবস্থা থাকে সেসব প্রয়োগ করে , অজ্ঞান দুই পুরুষ মানুষের চিকিত্সার ব্যবস্থা করে। তারপর বাচ্চাটার অপেরাশন -এর ব্যবস্থাও হয়। গ্রামেই চোট পেয়ে মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে , তার চিকিত্সার জন্যই শহরে আনছিল বাবা-মা , তার মধ্যেই এই বিপত্তি ! যাই হোক, সব ব্যবস্থা করতে করতে কখন যে রাত কাবার হয়ে সকাল হয়, কেউ বুঝতেই পারেনা। ছেলে তিনটি কিন্তু তারপর-ও বাড়ি যায় না। অজানা , অচেনা রুগীর জন্য খাওয়া-দাওয়া , ঘুম বিসর্জন দিয়ে , তারা সারা রাত হাসপাতালেই কাটিয়ে দেয়। সকালে সব খবর ভালো, পুরুষ দুজনের জ্ঞান ফিরেছে, বাচ্চাটার সফল অপারেশন হয়েছে, সে ভালো আছে, ঘুমোচ্ছে। চারজন-ই শান্তিতে ঘুমোচ্ছে দেখে , টাকাপয়সা যোগান দিয়ে তারা হাসপাতাল ছাড়ে।
সারা রাত অনিদ্রার পর সেদিন আর অফিস করা হয় না। ........বাড়ি ফিরে , ভালো করে স্নান করে, খেয়ে ঘুম লাগায়। তার পর-ও যতদিন সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে ওই পরিবার আর এম্বুলেন্স ড্রাইভার বাড়ি না ফিরেছে , রোজ বিকেলে ওদের কাজ ছিল হাসপাতালে গিয়ে তাদের দেখা। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানা , থাকলে সেসব দূর করার ব্যবস্থা করা। .............দিন দশ -বারো পরে, সবকজন হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে , বাড়ি ফিরে গেলে ওদের-ও ছুটি হয়। সারা হাসপাতালে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে ইতিমধ্যে। এদের উদাহরণ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডাক্তার অপারেশন-এর ফী নেন না, হাসপাতাল-এর তরফ থেকেও যতটা সম্ভব কম টাকা নেওয়া হয়। অতএব....... "মধুরেণ সমাপয়েত " !
কিন্তু এই ছেলেগুলির সুন্দর মন আর উদার চিত্তের পরিচয় পেয়ে ভরসা হয় আশা আছে, সবশেষ হয়ে যায়নি। এরকম আরো কিছু যুবক থাকলে (নিশ্চয় আছে), আমাদের ভয় কি ?
লেখিকা পরিচিতি
- কলকাতা -
কিন্তু এই ছেলেগুলির সুন্দর মন আর উদার চিত্তের পরিচয় পেয়ে ভরসা হয় আশা আছে, সবশেষ হয়ে যায়নি। এরকম আরো কিছু যুবক থাকলে (নিশ্চয় আছে), আমাদের ভয় কি ?
লেখিকা পরিচিতি
- কলকাতা -
সুচিন্তিত মতামত দিন