বর্তমান বিশ্বে বেশীরভাগ মানুষেরই জীবন বিবর্তিত হচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর ধারায়। ভোগবাদি দর্শনের প্রভাবে সমাজ জীবনে আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানুষ আজ ইদুর দৌঁড়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ব্যতিব্যস্ত। বাঙালি সমাজও এর ব্যত্যয় নয়।
আবহমান বাঙালি সমাজের মূল দর্শন ছিল আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় ভিন্নতার মাঝেও যুথবদ্ধ জীবনে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্ট্রান এবং সমাজের শ্রেণীভেদ সত্ত্বেও গ্রামে এবং শহরের মহল্লায় মহল্লায় মানুষে মানুষে সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক অন্তরঙ্গতাবোধ কাজ করতো। ধর্ম বিশ্বাসে পার্থক্য সত্ত্বেও বাঙালির এই ভ্রাতৃত্ববোধের মূলে সম্ভবতঃ কাজ করতো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মরমিবাদ, যা লালন এবং অন্যান্য সুফিসাধকেরা সুদীর্ঘকাল প্রচার করে গেছেন।
বাঙালি সমাজের সেই ভ্রাতৃত্ববোধের ভিতে ঘুণ ধরেছে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। আমরা যদি গভীরভাব সমাজ পর্যবেক্ষণ করে দেখি তবে নিঃসন্দেহে উঠে আসবে নৈরাশ্যজনক চিত্র। সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবার এবং ব্যক্তি মানুষ আজ আত্মকেন্দ্রিক। শহরে তো বটেই, গ্রামীন সমাজও ক্রমান্বয়ে অবক্ষয়িত হতে চলছে। দার্শনিক নীরোদ চন্দ্র চোধুরীর সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায় বাঙালি সত্যিই সত্যিই এবার আত্মঘাতের দিক অগ্রসর হচ্ছে।
বলাই বাহুল্য, ভোগবাদি দর্শনজাত এই আত্মকেন্দ্রিকতা ব্যক্তিমানুষের সুকোমলবৃত্তিকে নষ্ট করছে এবং বলা যায় ব্যক্তিমানুষ হারিয়ে ফেলছে তার ভেতরে বহমান সুন্দরকে ধরে রাখার ক্ষমতা। আর এ কারণে বাহ্যিক উন্নতি, ধন-সম্পদ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসনদও শেষটায় তাকে শান্তি দিতে পারছে না, বরং বলা চলে একধরণের দুঃখবোধ এবং হতাশায় গ্রাস হচ্ছে বিচ্ছিন্ন মানুষ।
শুরুতেই বলেছি মানবসভ্যতার বর্তমান বিবর্তনের বড় নিয়ামক হচ্ছে ভোগবাদ দর্শন। বাঙালি উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সমাজ অতি দ্রুত ভোগবাদকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করায় এ বিপত্তি তা বলাই বাহুল্য। কর্পোরেট বাণিজ্যের স্বার্থে ভোগবাদ মানুষকে লালায়িত করছে বিভিন্ন পণ্যের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন। এসব পণ্য যে শুধু বস্তুগত তা বলা যাবে না, এমনকি শিক্ষাকেও রূপান্তরিত করা হয়েছে ভোগ্যপণ্যে। যেভাবেই হোক ভোগ করতে হবে, এ মানসিকতার কারণেই সমাজের মানুষ নেমেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। আর এ চক্রে পড়ে সমাজে বেড়েছে দূর্ণীতি, অসততা, কালোবাজারী, কপটতা, শোষণ-নির্যাতন যা আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না।
মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। বাঙালি সমাজের এই অধোঃগতির শুরুও সমাজের নেতৃস্থানীয়দের দিয়েই। সাধারণভাবে বলা যায় আমাদের রাজনীতি এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মাফিয়াগোষ্ঠী দ্বারা। রাজনীতি এখন কোন সেবামূলক কার্যক্রম নয় বরং এটি পরিণত হয়েছে শর্টকাট মেথডে অবৈধ অর্থ অর্জনের বড় হাতিয়ার। নির্বাচন এবং গণতন্ত্র ভেস্তে যাচ্ছে অবৈধ কালো টাকার খেলায় এবং যোগ্য ও সৎ লোক এবং সেই সাথে আমজনতাও হয়ে পড়ছে রাজনীতি বিমুখ। শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজের অন্যান্য পেশাজীবি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অবস্থাও ত থ বৈ চ। বিশিষ্ট ভাষাবিদ এবং সমাজ বিশ্লেষক ডক্টর হুমায়ুন আজাদের ভাষায় আজ বলা চলে সব কিছুই নষ্টদের দখলে চলে গেছে।
মানুষের মাঝে অতিরিক্ত ভোগবাদ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় সমাজে শোষণের মাত্রাও বেড়ে গেছে, যার ফলে ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের মাত্রা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানীতে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে, সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়ের উপরে নির্যাতনের মূল কারণ যে অর্থনৈতিক, বিশেষ করে তাদের জমাজমি হাতড়িয়ে নেওয়া তা বিভিন্ন সমীক্ষায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সমাজ অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় শিকার নতুন প্রজন্ম। আপাত দৃষ্টিতে শিক্ষাব্যবস্থার সংখ্যাগত উত্তরণ ঘটলেও গুণগত মানের ঘটেছে চরম বিপর্যয়। এছাড়া, লেখাপড়া শেষে চাকুরীর কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই যুবসমাজের একটি বড় অংশ আজ হতাশায় পর্যুদস্ত। দূর্বিসহ বেকারত্ব এদেরকে ঠেলে দিচ্ছে মাদকাসক্তির দিকে। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এখন নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্যের অভয়াঞ্চল। দূর্ণীতিবাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে এ অসাধু ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।
আগ্রাসী ভোগবাদের কারণে বাঙালি নারী সমাজও পর্যুদস্ত। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদির মাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেশী বেড়ে গিয়েছে। তবে বাংলাদেশের নারী সমাজ প্রসংগে বলা যায় শত হতাশার মাঝেও রয়ে গেছেআশার আলো। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের নারী সমাজের অভূত প্রগতি সাধিত হয়েছে এ দাবি অনায়েসেই করা যায়। নারী শিক্ষার হার এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহন আগের চেয়ে অনেক বেশী। জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন সংস্থার জরিপে জানা যায় এ উপমহাদশে নারী প্রগতির সূচকে বাংলাদেশ অগ্রগামী।
এখন আলোকপাত করা যাক বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় মোকাবেলা করার পদক্ষেপের বিষয়ে। অবক্ষয়ের কার্যকারণ উদঘাটন করা গেলেও এ থেকে পরিত্রাণের শর্টকাট কোন পথ নেই। বিষয়টা মূলতঃ বৈশ্বিক ভোগবাদের সাথে সম্পর্কিত, এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে সমাজের সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বিমুখতার কথা উল্লেখ করেছিলাম। সৎলোকদের এই রাজনৈতিক বিমুখতা বস্তুতঃ এই সামাজিক অবক্ষয়কে ত্বরান্তিত করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনীতির কলুষ চিত্র পাল্টাতে হলে 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর' মানসিকতা নিয়েই সৎ লোকদের এগিয়ে আসতে হবে রাজনীতিতে। এজন্য প্রভূত ত্যাগ শিকার করতে হবে সে তো জানা কথাই। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা ভেবেই তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের পূর্বসুরী রাজনীতিকদের মতোন।
শুধু রাজনীতিতে নয়, যে যে পেশায় থাকুক না কেন সৎলোকদের হতে হবে সক্রিয়। শুধু নিজে সৎ থাকা নয়, অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে সৎ হতে এবং প্রয়োজনে জোট বেঁধে সমাজে ক্রমপ্রসারমান দূর্ণীতি বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে।
এ কথা সত্য, রাতারাতি কোন সমাজের উত্তরণ ঘটে না। তবে সমাজের চিন্তাশীল সৎ ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে তারা নতুন প্রজন্মের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হলে আখেরে এই প্রজন্মই সমাজকে উত্তরণের পথে কাজ করে যাবে।
ভোগবাদি দর্শনকে রুখতে হলে এর বিপরীতে জাগ্রত করতে হবে নতুন কোন দর্শন। আশার কথা, আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ভোগবাদি দর্শনের বিপরীতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। বাঙালি সংস্কৃতির বড় একটি উপাদান হচ্ছে সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং এ চেতনা ফিরিয়ে আনলে নিঃসন্দেহে আমরা আবারো অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বিভিন্ন মরমি সাধক (যেমন লালন শাহ) সহ রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তকে যদি আমাদের চিত্তে জাগরিত করতে পারি তবে সমাজ অবক্ষয়ের অনেক উপাদান দূর করা যাবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ জন্য প্রয়োজন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সমাজের সাংস্কৃতিকমনা ব্যক্তিবর্গকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামে ও শহরে চালাতে হবে এ আন্দোলন।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়াও ভোগবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করা আশু প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই এ বিষয়ে চিন্তা করে থাকেন। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকরী উদ্যোগ না নিতে পারলে ভোগবাদকে প্রতিরোধ করা সম্ভব না। যারা সমাজ প্রগতির কথা ভাবেন তাদেরকে ভোগবাদ বিরোধী সংগঠনের কথা ভাবতে হবে।
আরেকটি বিষয়, সমাজের এ অবক্ষয় রোধে নারীরা সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। নারীরা শুধু মেয়ে নয়, তারা মা-ও বটে।একথা অনস্বীকার্য সন্তানদের মানস গঠনে মায়েদের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। আগেই উল্লেখ করেছি, নারী শিক্ষার ব্যপক অগ্রগতি হয়েছ। এই শিক্ষিত মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে ভোগবা্দী বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলতে এবং সেই সাথে তাদেরকে বাঙালি সংস্কৃতির আলোকে আলোকে উজ্জীবিত করে তোলতে পারেন।
- নিউজিল্যান্ড -
সুচিন্তিত মতামত দিন