মুনীব রেজওয়ান





আসলে গল্প নয়— প্রত্যক্ষ করা করুণ এক কাহিনী। ডুবন্ত নৌকোয় সাঁতার না জানা মায়ের সাথে সাঁতার না জানা দুই ছেলের সে এক ভীষণ অভিজ্ঞতার গল্প !

নৌকোটা একটু বড়ই ছিল। চারটা পরিবারের নারী-শিশু আর মাঝি মাল্লার মিলিয়ে প্রায় কুড়িজন মানুষ আমরা। তখন কতই বা বয়স আমার ! আটের সামান্য উপরে হবে। জীবনের অনেক স্মৃতি, অনেক কথাই তেমন আর মনে পড়ে না। যৌবনে টগবগে ঘোড়া ছোটানোর অনেক গল্পই ভুলেছি। হয়তো ক'দিন আগের কোন ঘটনাও আর মনে নেই তেমন কিন্তু সেই অতি বালক বয়সের নৌকাডুবি আজো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।

১৯৭১। মাসের নামটা মনে নেই। সর্বাত্মক যুদ্ধ চলছে। আমাদের গৌরবের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাবার কর্মক্ষেত্র তখন ধান নদী আর খালের দেশ বরিশাল। আমরা শহর ছেড়েছি বেশ ক'মাস আগেই। যদ্দুর মনে পড়ে চরবাড়িয়া লামছড়ি কিম্বা এরকম একটি নাম ছিল গ্রামটির। আমরা তখন দুই ভাই এক বোন । আমার পিঠাপিঠি ছোট বোনটা মারা গেল মাত্র দুদিনের ডায়রিয়ায়। তাকে ঠিকমত সমাহিত করতে না করতেই খবর এলো মিলিটারি আসছে এই গ্রামেও। শান্তি কমিটির সদস্য ছাড়া ওরা সবাইকে মেরে ফেলছে । মা তখন দিশেহারা। বাবা আমাদের নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। আমিও তখন আমার খেলার সাথী মাত্র বছর দুই ছোট সদ্যপ্রয়াত বোনটির বিয়োগে কাতর। চোখের জল গোপন করে আবার ছোটো---

আমরা সবাই নোকোয় উঠেছি প্রায়। বাবা এবং চার পরিবারের পুরুষেরা তখনো ওঠেন নি। বাবাকে দেখতে পাচ্ছি সন্ধ্যার ঘণায়মান অন্ধকারে ঐতো দাঁড়িয়ে আছেন। এরকম সময় কোত্থেকে ঝড়ের মতো ছুটে এলো কিছু মানুষ ! তারা সবাই মৃত্যু তাড়িত। হুঁস নেই। যেখানে যেটুকু অবলম্বন দেখছে আঁকড়ে ধরছে। আমাদের ছোট সে তরী ! অতোগুলো মানুষের তুলনায় নৌকোটা আর বড় রইল না। প্রায় ডুবুডুবু অবস্থায় কিছু মানুষ তীরে রেখেই মাঝি নৌকো ছাড়লেন। কেউ কেউ খানিকটা সাঁতরে এসেও নৌকোয় উঠলেন।

আমরা আকূল দরিয়ায় ভাসতে লাগলাম। এই বুঝি ডুবল আমা্দের নৌকো! নারী শিশুদের আর্তনাদে ছিন্ন ভিন্ন রাত আরো ভয়ঙ্কর হল আমরা যখন মাঝ নদীতে। দূর থেকে ধেয়ে আসছে পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ। মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছে। বৃষ্টির মত গুলি। আন্ধকার রাতে যেন শত শত জোনাকি ছুটে চলেছে। আমাদের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সেইসব গুলি। কারো একজনের কান ছুঁয়ে গেল একটা গুলি। সবাই ভয়ে মাথা নুইয়ে রাখছি যতটা সম্ভব। আল্লাহ ভগবানের প্রার্থনায় সে এক সর্বধর্ম ভাসমান উপাসনালয়। সেই সময়ের অনুপুঙ্খ বর্ননা দেয়া আমি কেন কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ভয়ে তখন প্রতিটা মানুষ নিজের ভিতরে সেঁধিয়ে আছি কচ্ছপের মত । শুধু চোখজোড়া  বাইরে---

এবার নৌকো টলোমলো ! গোপনে অনেক জল ঢুকেছে। মাঝি টের পেলেও কিছু করার নেই। সবাই বুঝতে পারছি আমরা এখন ডুবে যাবো। নিশ্চিত মৃত্যু আমাদের থেকে মাত্র কয়েক নিঃশ্বাস দূরে ! আমাদের নৌকো ডুবতে শুরু করেছে যখন ততোক্ষণে আমরা  তীরের থেকে দশ পনেরো হাত দূরত্বের মধ্যে চলে এসেছি। তীরে এসে তরী কেন ডোবে সেটা সেবার জানা হয়েছিল। তীর যতোই কাছে আসতে লাগল মানুষ ততোই অধীর আকূল হতে শুরু করল। ডুবন্ত নৌকো থেকে লাফিয়ে নামতে লাগলেন তারা যারা সাঁতার জানেন। এভাবেই সহসা ডুবে গেল একটি নৌকো প্রায় তীরে এসে।

আমার মা সাঁতার জানতেন না। আমিও না। আর আমার কেবলমাত্র মাত্র ছোট ভাইটি তখন অনেক ছোট। সে মায়ের কোল আঁকড়ে রাইল। আমাদের ডুবে মরে যাবারই কথা ছিল কিন্তু আমরা ডুবলাম না। এক আশ্চর্য ব্যাপার ! দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন গলা পর্যন্ত জলে আমাদের সাঁতার না জানা মা তার দুই হাতে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের নৌকোর মাঝি—তার মাথায় আম্মার একটা ট্রাঙ্ক। এতো ঝড় ঝাপটাতেও সেই ট্রাঙ্ক আনতে ভোলেন নি সেই মাঝি। কী কী ছিল ওতে জানিনা শুধু জানতাম রুটি/ভাত সহ কিছু রান্না করা খাবার ছিল ওতে। আমার বাবা সেই নৌকোয় আর উঠতে পারেন নি। আমাদের কাছ থেকে বাবা বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। মাথার উপর কালো আকাশ। অনেক তারা জ্বলছে। আমরা সবাই ন্যুয়ে আছি। মাথার উপর দিয়ে, আমাদের কানের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে শত শত উল্কাপিন্ডের মতো শত্রুবাহিনীর গুলি-----আমরা কানের ভিতরে আঙ্গুল দিয়ে ন্যুয়ে আছি। মাথার উপর তারা ভরা আকাশ---


লেখক পরিচিতি
- জার্মানি - 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.