শ্রীশুভ্র

১৫ই আগস্ট! ভারতের স্বাধীনতাদিবস! ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতাদিবস! দুই দেশেই বিপুল উৎসাহ ও উদ্দিপনার মধ্যে দিয়ে উদ্জাপিত হয় দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আনন্দ! আর সেই আনন্দ উদ্দীপনার সরিক হয়ে বিশেষত একজন ভারতবাসী হিসেবে আমরা বিস্মৃত হই, ১৪ই আগস্ট অখন্ড বাংলার দুই খন্ড হওয়ারও দিন! বাঙালি জাতি ও বাংলার ইতিহাসের চরমতম কলঙ্কজনক দিন! কলঙ্ক আরও এইজন্য যে আমরা এই দুই খন্ড বাংলার অধিবাসীরা আজও সেই কলঙ্ককে বহন করে নিয়ে চলেছি, সেই ঘটনার সাতষট্টি বছর পরেও, অথচ আমরা কেউই সেই কলঙ্কে আদৌ লজ্জিত নই! কলঙ্ক এখানেই! একটি জাতি সমগ্র জাতিসত্তার মধ্যে কোথাও যখন আপন জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়ে ওঠে না, তখন সেই জাতির মেরুদণ্ড বলে কোনো বস্তু থাকে না, থাকতে পারে না! আমাদেরও নেই!

অনেকেই প্রতিবাদ করে উঠবেন! কে বলেছে আমাদের জাতীয়তাবোধ নেই? কে বলেছে আমাদের মেরুদন্ড নেই? প্রত্যেক ভারতীয় বাঙালি ভারতীয় জাতিয়তাবাদে দীক্ষিত! বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত! আবার ধর্মভীরু ধর্মপ্রাণ বাঙালিরা বলবেন কেউ হিন্দু জাতীয়তাবাদে, কেউ ইসলামি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত! খুবই সত্যি কথা। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেউ কি আছেন, যিনি বলবেন; তিনি বাঙালি! তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদেই দীক্ষিত? সকল বাঙালিই তাঁর স্বজাতি! অখন্ড বাংলাই তাঁর হারিয়ে যাওয়া সেই দেশ, যে দেশের সাথে ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল? যে অভিশাপে কবিগুরুর সোনার বাংলা আজও দ্বিখন্ডিত! আমাদের মধ্যে কার মেরুদণ্ড এত দৃঢ়, যিনি দ্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করবেন, হ্যাঁ তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই নিজ জীবনে স্বীকার করে নিয়ে গর্বিত? ঠিক যেমন ভাবে স্ব স্ব জাতীয়তাবোধে গর্বিত প্রতিটি জার্মান। ফরাসী। বৃটিশ। রুশ। পর্তুগীজ। ওলোন্দাজ। আমেরিকান। জাপানী। চীনা। প্রভৃতি অসংখ্য জাতির নাগরিকবৃন্দ!

না দুঃখের কথা, পরিতাপের বিষয় আমরা কেউই ঠিক তেমনটি নই! নই ঐ জার্মান, ফরাসী, রুশ, পর্তুগীজ, ওলোন্দাজ, আমেরিকান, জাপানী কিংবা চীনাদের মতো আপন জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত কিংবা গর্বিত। আমরা দ্বিখন্ডিত বাঙালি জাতি কেউ হিন্দু কেউ মুসলিম; কেউ ভারতীয়, কেউ বাংলাদেশী! কিন্তু কেউই কেবলমাত্র বিশুদ্ধ বাঙালি নই! ঠিক ঐ উন্নত জাতিগুলির প্রতিটি নাগরিকবৃন্দের মতো। ওদের মতো আমাদের নেই কোনো অখণ্ড মাতৃভুমী! নেই অখন্ড জাতিসত্তা। নেই স্বাজাত্যপ্রেম। নেই আপন সমগ্র জতীয়তার প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা। নেই জাতীয় সংস্কৃতি ও মাতৃভাষার প্রতি ওদের মত ঐকান্তিক ভালেবাসা, অখন্ড গর্ববোধ!

দুঃখের বিষয় তবু আমরা বাঙালি। কবিগুরু বলেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি!’ সত্যিই তাই! তাই বিভক্ত জার্মানীর এক হয়ে মিলে যাওয়ার পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও আমরা বাঙালিরা আজও কেমন দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্তায় গর্বিত ও আনন্দিত! হায়রে দুর্ভাগা বাংলা! হায়রে দূর্বল বঙালি!

সত্যিই বড়োই কপাল মন্দ এই বাংলার। সেই পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ক্রমাগত বিদেশীদের দ্বারা শাসিত হতে হতে ঐতিহাসিক ভাবেই বাংলায় কোনোদিনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোনোরূপ চর্চাই গড়ে ওঠেনি! এর বিবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ প্রথমাবধি বর্ণাশ্রম ভিত্তিক শ্রেণী বিভক্ত সমাজ বন্দোবস্ত! এবং পরবর্তীতে বৃটিশের প্রবর্তিত কেরানী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই আধুনিক বাংলার বিকশিত হয়ে ওঠা। এই দুই যাঁতাকলের মধ্যে পড়ে গিয়ে বাঙালির আর মানুষ হয়ে ওঠা হল না! সে হয়ে উঠল হিন্দু। সে হয়ে উঠল মুসলমান। সে হয়ে উঠল ভারতীয়। সে কিছুদিনের জন্য হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানী। তারপর হয়ে উঠল বাংলাদেশী। এই খন্ড খন্ড সত্ত্বাগুলির চর্চায় তার আর কখনই অখণ্ড বাঙালিয়ানার জাতীয়তাবাদের চর্চা করা হয়ে উঠল না। বারাবর পরাশ্রয়ী জীব হিসেবেই আমাদের যাবতীয় অর্জন। তবু তার মধ্যে পাঁকের ভিতর পদ্ম ফুলের মতোই বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন পাক অধিকৃত অঞ্চলের স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ!

শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ইউরোপেরও প্রতিটি দেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। কিন্তু সেই কারণটি সেখানে জাতীয়তাবাদের চর্চার অন্তরায় হয়ে ওঠেনি কখনো। অথচ বাংলায় সেই কারণটিই প্রথমাবধি জাতীয়তাবাদের চর্চার প্রধান অন্তরায়। এর কারণ ঐ বর্ণাশ্রম ভিত্তিক সামাজিক শ্রেণী বিভাজন। যেখানে সেই শ্রেণী বিভাজন শুধুই বংশানুক্রমে চলে তাই না, সেই শ্রেণী বিভাজন গোষ্ঠী ভিত্তিক ধর্মানুসারী সামাজিক বিভেদের অলঙ্ঘনীয় দূর্ভেদ্য অচল  অটল প্রাচীর তুলে দেয়। যে প্রচীরের ঘেরাটোপ পেড়িয়ে অখন্ড জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে না কখনোই। প্রতিটি গোষ্ঠী আপন আপন ধর্মানুসারী সামাজিক কৌলীন্য অনুযায়ী গোষ্ঠীবদ্ধ একাত্মতার গর্বে বা অগৌরবে অন্যান্য গোষ্ঠীগুলি থেকে বংশানুক্রমেই সতত বিচ্ছিন্ন থাকে। সেই বিচ্ছিন্নতার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে প্রতিটি বাঙালি। যে বিচ্ছিন্নতার বোধ গোটা জাতিকে কখনোই সমগ্রতার সূত্রে বাঁধতে পারে না। গড়ে ওঠে না সমগ্র জাতির মধ্যে জাতীয় একাত্মতা। আর ঠিক এই কারণেই আবহমান বঙ্গসমাজ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈদ্য শুদ্র শিয়া সুন্নি খৃষ্টান বৌদ্ধ বিভিন্ন জাত পাতের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। যে কারণে এই বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সামাজিক মেলামেশা কখনোই সহজ স্বচ্ছন্দ নয়। সামাজিকতার পরিসরে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীবদ্ধতা গোষ্ঠীগুলিকে  পরস্পরের থেকে সতত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার অনুভবের সৃষ্টিই হয় না। আর তাই গড়ে ওঠে না বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোনো ভিত্তিভুমি। বঙ্গসমাজে তাই পরস্পর বিচ্ছিন্ন এই গোষ্ঠী ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক চেতনাই জাতীয়তার সরূপ বলে বিবেচিত হয়।

ইউরোপের সামাজিক শ্রেণীবিভাজন আদৌ এই গোত্রের ছিল না। সেখানে আর্থিক কৌলীন্যই মূলত শ্রেণীবিভাজনের মাপকাঠি ছিল। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, যেহেতু সেই শ্রেণীবিভাজন বংশানুক্রমিক ধর্মীয় গোষ্ঠীকেন্দ্রিক কৌলিন্য ভিত্তিক ছিল না বাংলার মতোন; তাই পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধে ও শিক্ষার্জন সাপেক্ষে মানুষ নীচুতলার শ্রেণী থেকে উঁচুতলায় উঠতে পারত। বাংলার মতোন সামাজিক বিধিনিষেধ পথরোধ করে দঁড়াত না! উপরন্তু পর্যাপ্ত শিক্ষার দীক্ষার অভাবে উচ্চ শ্রেণীর মানুষও নীচু শ্রেণীতে নেমে যেতে পারত। বাংলায় যা সম্ভব ছিল না। তাই সেখানে এই শ্রেণীবিভাজন অলঙ্ঘনীয় না থাকার কারণে পরস্পরের সম্পর্ক দূর্ভেদ্য জাতপাতের সীমানায় এসে ঠেকে যেত না বাংলার মতো। শিক্ষাদীক্ষা মেধা বুদ্ধিবৃত্তির সম্মানটাই সেখানে প্রধান ছিল। বাংলায় যেটা বংশ কৌলীন্যে এসে ঠেকেছিল। এই বংশ কৌলীন্য ভিত্তিক অলঙ্ঘনীয় সামাজিক পরিচয়ের ভিত্তিই বাঙালির আবহমান অভিশাপ। যে কারণে বিশেষত কর্নাটক আগত সেন বংশের সময় থেকে বর্ণভেদ প্রথার বাড়াবাড়ি বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় এই উচ্চ ও নিম্নবর্ণের বিভাজনকে জাতপাতগত বিভাজনে রূপান্তরিত করেছিল। বর্ণহিন্দুদের হাতে বাংশানুক্রমিক ভাবে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার হওয়ায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যখন মুসলিম শাসন আমলে দলে দলে ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হতে থাকল; তখন এই জাতপাতগত বিভাজন নতুন মাত্রা পেল। তাই শ্রেণীবিভাজনের প্রকৃতি ভিন্ন হওয়ার কারণে, ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হলেও বাংলায় তা ঘটল না।

এরপর বৃটিশের হাতে পরাধীনতার আমলে ইংরেজের প্রবর্তিত রাজকর্মচারী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্ণহিন্দুরা ইউরোপের জাতীয়তাবাদের সাথে পরিচিত হলে ঘটল আরেক দূর্ঘটনা! যেহেতু বৃটিশ তার শোষণ ও শাসনের স্বার্থে প্রশাসনিক কর্ম সম্পাদনার জন্যে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে একটিই রাজনৈতিক মানচিত্রে বেঁধে ফেল্ল; তারই কুফল সরূপ, সদ্য ইউরেপীয় জাতীয়তাবাদের সংস্পর্শে আসা বাঙালি বর্ণহিন্দুরা ভারতীয় উপমহাদেশকেই আপন মাতৃভূমিসরূপ অনুভব করা শুরু করল। আর এই বিষয়ে তাদের সহায় হল ভারতবর্ষব্যাপি বিস্তৃত হিন্দু ধর্ম! ভারতবর্ষ আর হিন্দুত্ব সমার্থক হয়ে উঠল তাদের কাছে। তাদের চেতনায় ভারতবর্ষই দেখা দিল স্বদেশ হিসেবে। আর হিন্দুত্বই হয়ে উঠল জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। বাংলার ইতিহাসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সম্ভাবনা কবরস্থ হল চিরকালের মতোই।  ( ক্রমশ )

 - বর্ধমান - 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.