বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল । বিদ্যুৎ নেই । চারদিকে ঘোর অন্ধকার । দক্ষিণ দিকের জানালার কাছে বসে ধ্রুপদী ভাবছে আজ আর ঘর থেকে বেরোবেনা । প্রতিদিন একই কাজের জন্যে বাইরে যেতে আর ভালো লাগেনা । ঘরের আলো জ্বালতে ইচ্ছে করেনা ওর । বেশ লাগছে এই অন্ধকারের মুহূর্তটি । জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মানুষ পেরিয়ে যায় আলো অন্ধকারের সময় । একটা বিশেষ সময় মাঝে মধ্যে ফিরিয়ে দেয় সাময়িক সুখ । চিরস্থায়ী সুখের কথা এখন আর ভাবতে পারেনা সে । বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে সুখ নিয়ে খুব ভাবত । প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তেই সুখি হতে চায়তো । উপভোগ্যও ছিল সেই দিন গুলো । যদিও বিয়ের একবছরের মাথায় ধ্রুপদীর সুখের জীবনের সব হিসেব নিকেশ উল্টে যায় । সুখ হয়ে উঠে অসুখ । কি শয্যায় কি সংসারে । জীবনের আনন্দ, হইচই, কোলাহল আশ্বিনের ঝড়ের মতো উড়ে গিয়ে হারিয়ে যায় । সুখ তাই ধ্রুপদীর কাছে মূল্যহীন এক শব্দের নাম । এই নিয়ে আর ভাবতে ভালো লাগেনা ।
আজকের এই সন্ধ্যার আলোহীন সময়টা কেমন যেন কষ্ট দিচ্ছে ওকে । তবুও ভাবতে চায় সে । বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে গিয়ে ধ্রুপদী ছেড়ে এসেছিল যে চরম উপভোগ্য সময়, মুহূর্ত গুলো । ছেড়ে এসেছিল যে মৃদুলের বিশ্বস্ত হাত । তা খুব মনে পড়ে যায় আজ । মনে পড়ে আর ভাবে- যদিও এই ভাবনার মাঝে কোন ভালো লাগা নেই । কারণ, রফিকের সাথে বিয়ে হয়ে যাবার তিন মাস পর যখন হাবিবের কাছ থেকে খবর পেল যে মৃদুল ফুটওভার ব্রিজ ছেড়ে ব্যস্ত সড়ক ধরে রাস্তা পারাপারের সময় জীবনকে উপহার দিলো মৃত্যু নামক এক চরম মীমাংসিত ফলাফল; সেই থেকে এই বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আর কোনদিন ভালো লাগা কাজ করেনি । করবার কথাও নয় ।
মৃদুলের মৃত্যু রহস্যের জট আজো খোলেনি । কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে শেষপর্যন্ত অপমৃত্যু নামক শব্দটি জুড়ে দিয়েছিল পুলিশ ও হাসপাতাল বিভাগ । সেদিনের সেই সংবাদে ধ্রুপদী না পেরেছিল কষ্ট প্রকাশ করে কাঁদতে । না পেরেছিল সহ্য করতে । এক চরম সংকটময় সময় পেরিয়ে এসেছে সে । ভেতরে ভেতরে যে আগুনে পুড়ছিল, কষ্টের যাতনায় নুয়ে পরছিল তা কাউকেই বুঝতে দেয়নি । একটি মুহূর্তের জন্যও রফিকের মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে দেয়নি । নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছে । যখন একেবারেই একা একটি মুহূর্ত পেয়েছে,তাকে বন্ধু মনে করে অঝোরে কেঁদেছে ।
আজ এই সময়টাতে চোখের জল শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে ভাসিয়ে দেয় বুক । মৃদুলের মৃত্যু। পরনারীতে আসক্ত হয়ে ধ্রুপদীকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে ছেড়ে যাওয়া রফিকের সাথে কষ্ট আর বিষিয়ে ওঠা জীবনের কথা এবং একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে নিজেকে এখন পুরুষদের সম্ভোগের পাত্রী করে তোলা জীবনের কষ্ট গুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে ভেঙে চুরমার করে দেয় ধ্রুপদীকে।
নির্মল, সুন্দর একটি কিশোরী বেলা পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করা ধ্রুপদীর জীবন আজ তাঁর নিজের কাছেই অর্থহীন । বিভীষিকার কালো রঙে ঢেকে গেছে যে জীবন, যে সময়, তা আজ সমাজের কাছেও অর্থহীনই নয় অস্বীকৃতও বটে !
রাত আটটা বেজে গেছে অন্ধকার কেটে আলো ঝলমল করছে ঘর। ফ্ল্যাটের নীচে একটি গাড়ি এসে থামে । ধ্রুপদীর মোবাইলে রিং বেজে উঠে । বাইরে যাবেনা বলে যে মন সায় দিয়েছিল অন্ধকার সন্ধ্যায়; সে মন দ্রুত ছুটে চলে সিঁড়ি ভেঙে আলোকে পেছনে ফেলে অন্য এক অন্ধকারের দিকে ।
- ঢাকা -
সুচিন্তিত মতামত দিন